হারিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৪:১৭ এএম, ১১ নভেম্বর ২০১৭

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মুবাশ্বার হাসান সিজারকে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে রাতে খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন। বহুদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন সাংবাদিক উৎপল দাস। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার। এ ঘটনায় রোববার মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে পূর্বপশ্চিম কর্তৃপক্ষ।

দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা। কিন্তু নতুন নয়। আনেকদিন ধরেই অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই নিখোঁজ থেকে আবার ফিরে আসছেন, কিন্তু কিছু বলছেন না। নিখোঁজ আছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, কারো নিখোঁজ হওয়াই কাম্য নয়। হ্যাঁ, কাম্য নয় কিন্তু সত্য হলো একের পর এক মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের তৎপরতা এ ব্যাপারে ততটা দৃশ্যমান নয়, যতটা প্রত্যাশিত।

কোনটা নিখোঁজ, কোনটা গুম আর কোনটা অপহরণ এখন বোঝা মুশকিল। কিন্তু সত্য হলো সংখ্যা বাড়ছে। রাজনৈতিক হোক বা অন্য যেকোন কারণেই হোক, অপহরণ-গুম বা এমন নিখোঁজের ঘটনা উদ্বেগের। আতংক তৈরি করে মানুষের মাঝে। নিখোঁজ হওয়াদের স্বজনরা বেশিরভাগ সময়ই অভিযোগ করছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা রহস্যজনক। অনেক সময়ই তারা বুঝতে পারেন অপহৃতদের বিষয়ে ধারণা আছে, কিন্তু পরিবারের সদস্যদের জানাচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন কারো নিখোঁজ হওয়ার সংবাদই কাম্য নয়। কিন্তু তার অধীনস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নামে অনেককে অপহরণের অভিযোগ নানা সময়ে উঠেছে, এখনো উঠছে। গত ৩০ আগস্ট বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবস পালিত হয়েছে। বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। স্বজন হারানো বহু মানুষ সেদিন তাদের প্রিয়জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা ও তাদের ফিরে পাওয়ার আকুল আবেদন জানিয়েছেন।

জানা যায়, গত সাড়ে পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষ বিভিন্নভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। এসব মানুষের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কে-ই বা তাদের অপহরণ করেছে সেসব উদঘাটিত হওয়া দরকার। অন্যথায় রাষ্ট্রের উপর থেকে বিশ্বাস চলে যাবে নাগরিকদের। তখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, ‘কারো কাম্য নয়’।

আগের চেয়ে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে, তারা অনেক আধুনিক হয়েছে। একটি সক্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও এভাবে মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হওয়া ছিল একজন বড় রাজনৈতিক নেতার গুম হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা। রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক অপহরণের ঘটনায় সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ছিল নারায়ণগঞ্জের আলোচিত অপহরণ ও সাত খুনের ঘটনা। তার একটা বিচারিক পর্যায় সমাপ্ত হয়েছে, আরও অনেক পথ যেতে হবে।

এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে। গত ২৮ জুলাই মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে এ সকল গুম ও হত্যার ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তদন্তকারীদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

গুম-খুন-অপহরণের শিকার পরিবার পরিবারগুলোর প্রতি আমরা শুধু সমবেদনাই জানাতে পারি। কিন্তু প্রতিকারদের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। হঠাৎ করে নাগরিকের হারিয়ে যাওয়া, জোরজবরদস্তি করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন ইত্যাদি শব্দবন্ধ আজ সম্পূর্ণ অর্থহীন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের মতো বর্বর জাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক মানবিক বাংলাদেশ তৈরি করবো আমরা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের এ কেমন চেহারা?

বাসা থেকে বেরিয়ে কেউ আবার নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে, নাকি ওত পেতে থাকা অপহরণকারীদের কবলে নিজেকে সঁপে দিতে হবে, কেউ জানে না। বাসায়ও নিরাপত্তা নেই। অপহরণ হচ্ছে নিজ বাসস্থান থেকেও। অপহরণের শিকার হচ্ছেন রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, আইনজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী।

পুলিশ বা র্যাব আন্তরিকভাবেই অপহৃতদের উদ্ধারের চেষ্টা করবে। কিন্তু বিষয়টি শুধু উদ্ধার বা ফিরে পাওয়ার মধ্যে থেকে গেলে রোগের নিরাময় হবেনা। নিশ্চয়ই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র আছে যারা অপহরণ বানিজ্য করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য। এর ভিত্তি ভেঙে দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জড়িত থাকলে শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন। আর যদি রাজনৈতিক কারণে কেউ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য দেশি-বিদেশি শক্তি মিলে পরিকল্পিত ঘটনা যদি ঘটিয়ে থাকে তবে তাকেও গুরুত্ব দিয়ে আমলে নিতে হবে। শুধু ‘কাম্য নয়’ জাতীয় বক্তব্য মানুষকে আশ্বস্ত করেনা।

অপহরণের জন্য বাংলাদেশে আইন আছে, শাস্তির বিধানও আছে। প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও নিরাপত্তা বিধান করা ও তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের তথা মৌলিক দায়িত্ব। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধি অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রে যদি ব্যাপক ও ধারাবাহিক গুম হতে থাকে, তাহলে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ গুম-অপহরণ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ। কোনো অজুহাতেই সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক এ দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই।

কোনও আধুনিক, দায়বদ্ধ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এই অনাচার চলতে পারেনা। বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়। সেখানে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের হামলা যেমন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, তেমনি রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকদের গায়েব করে দেওয়াও স্বাভাবিক ঘটনা। দিগভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত হওযার সুযোগ নেই বাংলাদেশের। সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে যাতে আর একজন নাগরিকও হারিয়ে না যায়। যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আর এমন অপরাধ বন্ধে সরকারের উচিত একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে স্থায়ী সমাধানের প্রচেষ্টা নেওয়া।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

‘অপহরণের জন্য বাংলাদেশে আইন আছে, শাস্তির বিধানও আছে। প্রত্যেক নাগরিকের জীবন ও নিরাপত্তা বিধান করা ও তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের তথা মৌলিক দায়িত্ব।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।