দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া

আহমেদ শরীফ আহমেদ শরীফ
প্রকাশিত: ০৩:৫২ এএম, ০৯ নভেম্বর ২০১৭

দু’দফা বন্যা, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বলা হচ্ছে এ কারণে চাল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক উপকরণের দাম বেড়েছে। তবে এ ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের অজুহাতে বছরের পর বছর ধরে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে আসছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। অতি মাত্রায় লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে চাল, পেঁয়াজ এসব পণ্য মজুত করে পরে মাত্রাতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে।

একটু ভাবলেই বুঝা যায় ঢাকায় বড় ধরনের আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্যের মধ্যে বসবাস করছি আমরা। গুলশান, বনানীসহ কিছু অভিজাত এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ যেখানে প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করে, তাদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম হুট করে বেড়ে গেলে তেমন গায়ে লাগে না। কিন্তু ঢাকায় এখনো ১০/১২ হাজার টাকায় সংসার চালানোর মতো পরিবার আছে অনেক। একটা বিরাট অংশ মাসে ৫০/৬০ হাজার টাকার বেশি আয় করে না। যাদের বেতন বা আয়ের অর্ধেকই চলে যায় সর্বনাশী বাড়ি ভাড়ায়। সরকারি চাকরীজীবীদের বেতন বেড়েছে, এই অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা।প্রশ্ন হলো দেশের কতোজন সরকারি চাকরীজীবী? আর তাদের বা বেসরকারি চাকরীজীবীদের বেতন কি তুলনামূলকভাবে খুব বেড়েছে? বাজারে গিয়ে তাই সব পেশার মানুষই প্রতিদিন হিমশিম খাচ্ছেন।

এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মানুষের আয় বেড়েছে বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে যে হারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে, তার লাগাম টানবে কে? এক্ষেত্রে সরকারের সময়োপযোগী, কঠোর পদক্ষেপ দরকার। এমনিতে প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া দাবড়ে বেড়াচ্ছে। রমজানের আগে সব কিছুর দাম হয়ে যায় আকাশ ছোঁয়া। সত্যি বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র আমাদের অর্থনীতি।

পৃথিবীর কোনো দেশে এতো নির্মম গতিতে, এতো দ্রুত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘটনা সত্যি বিরল।

চলতি বছরের শুরুতে ভারতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্দোলন করে সাধারণ মানুষ। বছরের শুরুতে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মেক্সিকোতে আন্দোলনে নামে সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো আমরা যেন সর্বংসহ। যতো অনিয়মই হোক, আমরা সাধারণ মানুষরা মেনে নিচ্ছি। নুন আনতে পান্তা ফুরালেও জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমে বা যার যার অবস্থানে থেকে প্রতিবাদ জানানোর প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করি না। নাকি আমাদের অনুভূতিই ভোঁতা হয়ে গেছে? মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে বেড়েছে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল। শুধু তা ই না, বাড়ি ভাড়া, কজের বুয়া সব ক্ষেত্রেই খরচ আরো বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে আয় বাড়ছে না। এক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের মানুষরা বাড়িতে বাবা- মা’র জন্যেও কোনো টাকা পাঠানোর সাহস দেখাতে পারছে না এখন।

ঢাকার সমাজ ব্যবস্থাকে আর্থিকভাবে বিভক্ত করলে দেখা যাবে মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা আয়ের মানুষ বেশি। ৫০-৮০ হাজারের মতো আয় করছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। আর খুব কম সংখ্যকই আছে যারা ১-২ লাখ টাকা মাসিক বেতন পান। সেক্ষেত্রে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি বা বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া ঢাকার বেশিরভাগ মানুষকেই ভোগান্তিতে ফেলেছে। একই অবস্থা দেশের বিভিন্ন মফস্বল শহরেও। তবে ঢাকার চিত্রটা দিন দিন বিভীষিকাময় হয়ে উঠছে।

দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার এক রিপোর্ট মতে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরী এখন ঢাকা। ঢাকার মানুষের কাছে সত্যি কি অনেক টাকা এখন? তবে আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে পারছে না বেশিরভাগ মানুষ। অনেকটা সে কারণেই ঘুষ, চাঁদাবাজির মতো দুর্নীতিতে ঝুঁকে পড়ছে কেউ কেউ। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি যে মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে, এ বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে সরকারকে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন পরিবহনের চাঁদাবাজিকে। হ্যাঁ, বিষয়টা উদ্বিগ্ন করার মতোই। চাল, পেঁয়াজ, সবজিসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্য গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে বা রাজধানীতে আসার সময় রাজপথে বা অলিতে গলিতে পুলিশ সহ চিহ্নিত চাঁদাবাজরা যে হারে চাঁদা আদায় করে তা সত্যি অসহনীয়। দুঃখজনক হলো চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। আর বাজারে ভোগ্যপণ্যের যোগান বৃদ্ধি করতে উৎপাদন যেহেতু খুব জরুরি, সেক্ষেত্রে আমরা কতোটা সফল হচ্ছি তা একটা বড় প্রশ্ন। প্রায় প্রতি বছরই বলা যায় উৎপাদনের টার্গেট পূরণ হচ্ছে না। এটা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি) জরুরি প্রয়োজনে দ্রব্যমূল্য মজুত করে কিছু ক্ষেত্রে বাজার মনিটর করছে, তবে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে জোরালো নয়। এ বিষয়ে এখনই গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত নীতি নির্ধারকদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় নাকি ১৪ টি বাজার মনিটরিং টিম নিয়োজিত আছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করা হয়। তবে এসব উদ্যোগও সফল বলে মনে হচ্ছে না এখন। সম্প্রতি কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেছি পেঁয়াজের দাম কোথাও ৭৫, কোথাও ৮০/৮৫ টাকা। সে পেঁয়াজ আমার বাসার গলির দোকানগুলোতে ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ দাম পেঁয়াজের। বেগুন, ঢেড়সসহ সব ধরনের সবজির দামও দ্বিগুণ,৭০-৯০ টাকা কেজি। এ যখন অবস্থা তখন স্বল্প আয়ের মানুষের টিকে থাকা বিরাট চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।

সরকার জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু সেই জনগণই প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া লাগাম ছাড়া হয়ে গেছে। আর তাই বাজারে গিয়ে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার অবস্থা সাধারণ মানুষের। কোথায় যাবে তারা? কাকে বলবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা? সরকারই তো পারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে স্বস্তি দিতে। এক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা, সদিচ্ছা, নিয়মতান্ত্রিক উদ্যোগ খুব প্রয়োজন।

লেখক : সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, এনটিভি।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।