যে বা যাদের কারণে রাজনীতি কলুষিত হয়েছে এদেশে

মাসুদা ভাট্টি
মাসুদা ভাট্টি মাসুদা ভাট্টি , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৬:৫৪ এএম, ০৭ নভেম্বর ২০১৭

দেশের রাজনীতি/গণতন্ত্র কখনও কি সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত ছিল? বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ সব সময়ই যেনো এক রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, এক নিরবচ্ছিন্ন বিপদ ও আতঙ্কের ভেতর দিয়ে এদেশের নাগরিকদের জীবন পার করতে হয়। এদেশে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেও খুনিদের পিপাসা মেটে না, জেলের ভেতর জাতীয় নেতাদের হত্যা করেও ক্ষান্ত হয় না উচ্চাভিলাষ,

বিপ্লব ও সংহতি দিবসের নামে এদেশে পালিত হয় গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে বন্ধ্যা করার দিবস, কারণ এই দিনের পর থেকে এদেশে রাজনীতির নামে যে প্রহসন বা থিয়েটার চালু হয় তা জাতিকে আরো বহুকাল টেনে নিয়ে যেতে হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের লেখার বিষয় সেটি নয়, আজকে এমন কিছু মানুষের কথা বলতে চাই যারা এদেশের রাজনীতিতে দুষ্টগ্রহই কেবল নয়, তারা হলো গিয়ে ভয়ঙ্কর শ্বাপদের মতো, বেশিরভাগ সময় তারা শীতনিদ্রায় থাকেন কিংবা ভান্ ধরে থাকেন অসহায়ত্বের, কিন্তু যে মুহূর্তে একটি নির্বাচন ঘনায়, কিংবা কোনো সরকার তার মেয়াদ শেষ করে আসে অথবা রাজনীতিতে সামান্য কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় তখনই তারা শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠেন। জেগে ওঠে তারা বসে থাকেন না, তারা দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে ঘোঁট পাকাতে শুরু করেন এবং ক্রমশঃ যখন রাজনীতির জল ঘোলা হতে থাকে সেই ঘোলা জলে তাদের কাঙ্খিত রাজনৈতিক মাছটি তারা শিকার করেন, মূলতঃ তাদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থকেই সুসংহত করেন। আমি এদের কারো নাম না বললেও, এদের সকলের সঙ্গেই আপনাদের পরিচয় আছে এবং আপনারা সকলেই তাদেরকে চেনেন।

বঙ্গবন্ধু জনগণের রাজনীতি করতেন, সারাক্ষণ তিনি পরিবেষ্টিত থাকতেন রাজনীতির মানুষ দ্বারা। তিনি তার দলে এবং রাজনীতিতে একাধিক ব্যক্তিকে টেনে এনেছিলেন। তাদেরকে দিয়ে তিনি এদেশের জন্য কিছু করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট তরুণ ও মেধাবীদের মেধাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। বিশাল হৃদয়ের মানুষটি এদের ছোটখাটো অতীত ভুলত্রুটি ক্ষমা করে সুযোগ করে দিয়েছিলেন দেশের জন্য কাজ করার। কিন্তু কী ভয়ঙ্কর এরা হতে পারেন তা প্রমাণ করেছেন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এদেশের মানুষের সঙ্গে, রাজনীতির সঙ্গে বেঈমানি করে।

বিদেশি ডিগ্রিওয়ালা এসব ব্যক্তিরা প্রথমে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের কুৎসা রটিয়েছেন এবং তারপর নিজেরা কেউ মন্ত্রীত্ব নিয়েছেন বা মন্ত্রীত্বের বাইরে থেকে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পরিত্যক্ত বাড়ি দখল থেকে শুরু গোটা বাংলাদেশকেই তারা নিজেদের সম্পত্তি ভেবে এর যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। আর রাজনীতিতে তারা যোগ করেছেন জোচ্চুরি, মিথ্যাচার এবং বার বার দল বদলের উদাহরণ। যখন যেমন তখন তেমন এরকমটাই তাদের রাজনীতির মূলসূত্র।

যাদের বয়স পঞ্চাশ কিংবা কাছাকাছি তারা জানেন যে, এদেশে যখনই রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে চেয়েছে তাদের পাশে তখন কাদেরকে দেখা গিয়েছে, কারা টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়ে অরাজনৈতিক সরকার যে কতো জরুরি সে কথা জাতিকে নসিহত করেছেন। আবার যখন অরাজনৈতিক মেঘ কেটে গিয়ে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা পেয়েছে তখনও তারা এসে সুড় সুড় করে শপথ পড়ে মন্ত্রীত্ব নিয়েছেন এবং তাও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রী হয়েই আইন ও সংবিধানকে ব্যাক্তিগত ডায়েরির মতো ব্যবহার করেছেন যখন যেমন প্রয়োজন। এবং বিরোধী রাজনীতিকে এদেশে দাঁড়াতে না দেওয়ার ষড়যন্ত্রে তারাই সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি পালন করেছেন বলে লক্ষ্য করা যায়। আগেই বলেছি, এদের সকলেই যে মন্ত্রী হয়েছেন বা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন তা কিন্তু নয়, এদের কেউ কেউ নিজেদের আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বিদেশিদের সামনে নোংরাভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, বাঙালি জাতি এখনও গণতান্ত্রিক রাজনীতির যোগ্য নয়। এমনকি আরো অরাজনৈতিক সুশীলদের দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল খোলার কাজও করেছেন কেউ কেউ, কিন্তু এদেশের রাজনীতির ভিত তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের অরাজনৈতিক বৃত্তটি ভেঙে, একথা তারা ভুলে গিয়েছিলেন বলেই তাদের সে তৎপরতা সফল হয়নি।

কিন্তু কোনো একটি রাজনৈতিক অবস্থান করেও এদের ভূমিকা কেমন হয় সে ব্যাপারে একটু জেনে নেয়া যাক। এরা মূলতঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। এক স্বৈরাচারের কাছ থেকে তারা আরেক স্বৈরাচারের কাছে গিয়েছেন এবং পরে তারা স্বৈরাচার-সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের মধ্যমণি হয়ে বসেছেন। কিন্তু যখন এই রাজনৈতিক দলটিও বিপদগ্রস্ত হয়েছে, তাদের দুঃসময় চলেছে নিজের বাড়ি-বাণিজ্য ও স্বার্থকে নির্বিঘ্ন করতে এরা কখনও অন্য পক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন কিংবা চুপ থেকেছেন। এমনকি এরকম বিপদগ্রস্ত সময়ে ঘোলাটে বক্তব্য রেখে পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করতে চেয়েছেন।

ধরুন এই মুহূর্তে আগামী নির্বাচন নিয়ে সকালে একরকম বক্তব্য আর বিকেলে আরেকরকম বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন কে? কার বিরুদ্ধে দলের ভেতরেও সরকারের সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগ আছে? কিন্তু সরকারও যখন তাকে ঠিক সেভাবে পাত্তা না দিয়ে উল্টো তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তার অতীত অপকর্মের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করেছে তখন নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্যই সমানে চেচিয়ে চলেছেন কে? দীর্ঘ শীতনিদ্রা থেকে জেগে ওঠে এখন নিজেকে সবচেয়ে জরুরি মানুষটি প্রমাণে ব্যস্ত হওয়ার প্রবণতা আগেও লক্ষ্য করা গছে, এখনও আবার সেটিই তিনি করছেন, যা অতীতেও তিনি করেছেন।

বাংলাদেশে এরকম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা হাতে গোনা, অতএব তিনি বা তাদের নাম বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। পৃথিবীর অন্য কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এদের মতো রাজনীতিবিদদের দেশ ও দলের স্বার্থেই বাদ দেওয়া হতো। পাঠানো হতো রাজনীতির ভাগাড়ে। কিন্তু এদেশের দুর্ভাগ্য যে, এরকম বারো ঘাটের জল খাওয়া, দেশের দুঃসময়ে রঙ বদলানো এবং সব সময় ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করা রাজনীতিবিদদেরকে এখনও রাজনৈতিক দলগুলো পেলে চলেছে। কেন পালছে সে এক বিস্ময়। ধরেই নেওয়া যায় যে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এখনও সম্পূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল নয় কিংবা অবৈধ শাসনের অবৈধ পন্থায় জন্ম নিয়েছে বলে সত্যিকারের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চেনার ক্ষেত্রে তাদের ঘাটতি থাকতে পারে আর সে কারণেই এরকম বহুরূপীদের দলে রাখার প্রয়োজন তাদের রয়েছে।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ এরকম মানুষেরা সভ্য দেশে অবসর নিয়ে জীবনের শেষাংশে হয় রাজনীতির অতীত নিয়ে লেখালেখি করেন কিংবা একেবারেই অন্তরালের জীবন যাপন করে থাকেন। কিন্তু এদেশতো আর রাজনৈতিক ভাবে অতোটা সভ্য হয়ে উঠতে পারেনি, তাই এখনও এদের মতো রাজনীতির বোঝারাও রাজনীতির নামে নিজেদের স্বার্থ আদায়ের রাজনীতি করে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই পঁচিয়ে ফেলছেন। এ লেখা পড়তে পড়তেও হয়তো দেখতে পাবেন যে, তাদের একজন টেলিভিশনের পর্দায় বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য রাখছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে।

কখনও বলছেন তার দল নির্বাচনে যাবে যে কোনো মূল্যে, যে কোনো পরিস্থিতিতে, কখনও বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাবে না কিন্তু শেষাবধি তিনি কিন্তু আর কিছুই বোঝাচ্ছেন না, নিজের স্বার্থকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতেই তিনি আবার ক্ষমতায় যেতে চাইছেন কেবল। তার একমাত্র লক্ষ্য ক্ষমতা, তা সে যে ভাবেই হোক না কেন। ক্ষমতার বাইরেও তিনি বা তারা খুব একটা খারাপ থাকেন তা নয়, কিন্তু ক্ষমতার চকমকি তাদের স্যুট, লাল টাই বা কোট-রুমাল, চকচকে জুতো থেকে ঠিকরে বেরোয় বলেই তারা ক্ষমতায় থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদগণ এদের জন্য এবং এদের দ্বারাই কলুষিত ও বদনামের ভাগীদার হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

ঢাকা ৭ই নভেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৭

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি।
[email protected]

এইচআর/পিআর

এরা মূলতঃ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রাখেননি বা রাখতে পারেননি। এক স্বৈরাচারের কাছ থেকে তারা আরেক স্বৈরাচারের কাছে গিয়েছেন এবং পরে তারা স্বৈরাচার-সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের মধ্যমণি হয়ে বসেছেন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।