কোন পথে রোহিঙ্গারা?

আহমেদ শরীফ আহমেদ শরীফ
প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

লাখ লাখ অভুক্ত, নিঃস্ব মানুষ। তাদের মাঝে শিশুর সংখ্যাই বেশি। মিয়ানমারের সেনা সদস্য ও মগদের হাতে লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হয়ে পালিয়ে এসেছে তারা। কেউ কেউ আট দশ দিন হেঁটে আমাদের দেশে ঢুকেছে। তাদের কারো কাঁধে বয়স্ক বাবা/ মা, কারো কোলে নিষ্পাপ রুগ্ন শিশু। ঐ শিশুদের করুণ চোখের চাহনি। তারা কোথায় যাবে জানে না। এ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। যা বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। এসব দৃশ্য দেখে দেশি- বিদেশি অনেক সংবাদ কর্মীই তাদের কান্না চেপে রাখতে পারেননি। কেন তাদের এই নির্মম পরিণতি? কী দোষ শিশুগুলোর, বয়স্ক নারী পুরুষদের? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো কেউ দিচ্ছে না।

প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসতে গিয়ে সাগরে নৌকা ডুবেও মারা যাচ্ছে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু। রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠি এখন। প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকে মিয়ানমারে মুসলিম যে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার লড়াই শুরু হয়, জাতিগত নিধনের মাধ্যমেই যেন শেষ হচ্ছে সেই লড়াই। ১৯৪৮ এ বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়া মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ মগদের মাঝে যে বিবাদ দেখা দেয়, তা দিনে দিনে বাড়তে থাকে। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক নির্যাতন। আশির দশকে দেশটির সামরিক সরকার তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। এরপর থেকে রাষ্ট্রহীন এক জাতি হিসেবেই ভাসমান গোষ্ঠি হিসেবে আছে তারা। তবে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাদের সাম্প্রতিক যে বর্বরোচিত হামলা শুরু হয়েছে তা আগের সব নির্যাতনকে ছাড়িয়ে গেছে। পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ ও নিষ্পাপ শিশুদের আগুনে ছুঁড়ে, আছড়ে, পদদলিত করে মারার যেসব তথ্য বেঁচে আসা রোহিঙ্গারা জানাচ্ছে তা দেশি বিদেশি সব মানুষকেই হতভম্ব করে দিয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের উপর হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৮৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে ইতোমধ্যে এ সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। এদের মাঝে ৩ লাখ ২০ হাজারের মতোই শিশু বলে জানা গেছে। আগে বাংলাদেশে ছিলো প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন প্রায় ১০ লাখের বেশি।

এ অবস্থায় চলমান জাতিগত নিধন বন্ধসহ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে, রোহিঙ্গা শিশুসহ আশ্রয়প্রার্থীদের সহায়তায় জরুরি পদক্ষেপ নিতে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটি জানিয়েছে,আগামী ৬ মাসে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্যে প্রয়োজনীয় সাড়ে ৭ কোটি ডলারের মধ্যে যা পাওয়া গেছে তা অপ্রতুল। কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্পে এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার অভিভাবক শূন্য শিশুকে চিহ্নিত করেছে দাতা সংস্থাগুলো। এদের ভবিষ্যত কি হবে, তা অনিশ্চিত। এদিকে, আগামী ৬ মাসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য যে ৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার সহায়তার দাবি করেছে জাতিসংঘ, তার বিপরীতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ ৩৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে বলেই জানা গেছে।

মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল জয়ী নেত্রী অং সান সু চি শুরু থেকেই বলছেন তার দেশে কোনো জাতিগত নিধন চলছে না। সে কথা যে কতোটা ভয়ংকর মিথ্যে তা আমাদের দেশে আসা রোহিঙ্গাদের তথ্য মতেই স্পষ্ট হয়েছে ইতোমধ্যে। এছাড়া সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে রাখাইনে শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ছবি বিশ্লেষণ করে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু এরপরও মিয়ানমার সরকার বলছে তাদের সেনাবাহিনী কোনো ধরনের নির্যাতনের সাথে জড়িত নয়, বরং বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের দমন করা হচ্ছে। এই নির্লজ্জ মিথ্যাকে সমর্থন করছে চীন ও রাশিয়া। মিয়ানমারে চীনের কয়েক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ থাকায়, দেশটি চীনের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠায় এর সব পাপ মাফ করে দিচ্ছে চীন। আর লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে আমাদের দেশে আসায় এতে ব্যাপক এক রাজনৈতিক, আর্থিক চাপের মুখে পড়লো বাংলাদেশ।

এখন যে হারে সব ক্ষেত্রে চীনা সামগ্রী ব্যবহার করছি আমরা, যে বড় বাজার আমাদের দেশে গড়ে তুলেছে দেশটি, সেই ব্যবসায়িক জালে আটকে পড়েছে গোটা বাংলাদেশ। এখন চীনের রাজনৈতিক জালেও ধরা পড়েছি আমরা। সময় এসেছে চীনের সাথে ব্যবসায়িক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বোঝাপড়া করার। অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখছে ভারত। দেশটিরও মিয়ানমারে বড় অংকের বিনিয়োগ আছে। অবশ্য কূটনৈতিকভাবে এখনো বাংলাদেশের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক আছে ভারতের। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় এসে যে আন্তরিকতা দেখিয়ে গেছেন এটা আমাদের জন্য আশার কথা।

মিয়ানমারের রাখাইনে জাতিগত নিধনের বিষয়টি এখন সুস্পষ্ট। বিশ্বজুড়ে মিডিয়ার হস্তক্ষেপে সত্যটা সবাই জেনে গেছে অনেক আগেই। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আশার কথা হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের তীব্র সমালোচনা করছে ও বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করছে। তবে চিন্তার বিষয় হলো এরপর কী হবে? কোথায় যাবে রোহিঙ্গারা? তারা কি বাংলাদেশেই থাকবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারো জানা নেই।

চরমভাবে নির্যাতিত, লাঞ্ছিত এই নিঃস্ব জনগোষ্ঠি এখন বেঁচে থাকার জন্য কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকার পাহাড় কেটে, বন উজাড় করে বসতি গড়ে তুলছে। এসব কারণে স্থানীয়দের সাথেও কোনো কোনো রোহিঙ্গার ঝগড়া, এমনকি মারামারির ঘটনা ঘটেছে। আর সব হারানো রোহিঙ্গারা শুধু কক্সবাজারই নয় ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। এদের এমন পরিস্থিতি যে দু’বেলা খেতে দিলে যে কারো পক্ষ নিয়ে যেকোনো অপরাধও করতে পারবে তারা। তাই নির্দিষ্ট ক্যাম্পেই তাদের রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় অসহায় রোহিঙ্গাদের যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা অনৈতিক কোনো কাজে কোনো দল বা গোষ্ঠি ব্যবহার করতে না পারে, বিপথে ঠেলে দিতে না পারে সে বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে সরকারসহ সচেতন সবাইকে।

লেখক : সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, এনটিভি।

এইচআর/আরআইপি

‘অসহায় রোহিঙ্গাদের যাতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা অনৈতিক কোনো কাজে কোনো দল বা গোষ্ঠি ব্যবহার করতে না পারে, বিপথে ঠেলে দিতে না পারে সে বিষয়টাও খেয়াল রাখতে হবে সরকারসহ সচেতন সবাইকে।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।