পুঁজিবাজার : সূচকের পতন ও বিনিয়োগের বাস্তবতা

ইসমাত জেরিন খান
ইসমাত জেরিন খান ইসমাত জেরিন খান , বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা
প্রকাশিত: ০৪:০৭ এএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের সংশয় চলছে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন কেমন যাচ্ছে বর্তমান পুঁজিবাজার? বাংলাদেশের পুঁজিবাজারকে এগিয়ে নিতে দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার আন্তরিকতার তেমন কোন ঘাটতি না থাকলেও বিনিয়োগকারীরা আবারো আটকে গিয়েছে ব্যাংকের শেয়ারে। এই ব্যাংকের শেয়ারের প্রভাব বিনিয়োগকারীদের বাজার বিমুখ করছে। বাজারে বড় ধরনের ধসের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে স্থবিরতা যেমন রয়েছে লেনদেনও তেমন কমেছে।

অনেকেই বলেছেন, বাজারের এই পরিস্থিতি বেশি সময় স্থায়ী থাকবে না। বাজার ঘুরে দাঁড়াবে তবে ছোট বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ারের ধকল নিতে পারছে না। অনেকেই তাদের পোর্টফোলিও এখন সাজিয়ে নিয়েছেন নানান খাতের শেয়ার দিয়ে। এখন প্রশ্ন হল বাজার কেন এত নিম্নমুখি হল। কারা ছিল এর পেছনে আর কেনই বা প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন শেয়ার দরে। অপ্রোয়জনীয়ভাবে ব্যাংকের শেয়ারগুলো বাজারে একটা বড় উলম্ফন তৈরি করেছিল। কারা ছিল এই দর বৃদ্ধির পেছনে আর কারাই বা এসব বোঝা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তা একটু খোঁজ খবর নিলে জানা যাবে বড় বড় রাঘব বোয়ালদের নাম। যাদের না ধরা যাবে, না কোন বিচারের আওতায় আনা যাবে। তাদের কথা আজ নাই বা বলা হল।

এবছরের শুরুর দিক থেকে বাজার যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে পুঁজিবাজারে ১৭ সেপ্টেম্বর সূচকের রেকর্ড ছিল। এর আগে সর্বশেষ রেকর্ড ছিল সূচকে ৫ডিসেম্বর ২০১০, সাধারণ সূচক ছিল ৮৯১৮। এখন প্রশ্ন হল কেন এত বাজারে লেনদেন ও সূচক বাড়লো? ২০১০ সালের মার্কেট ধসের পেছনে দায়ী করা হত ব্যাংকগুলোকে। কারণ ব্যাংকগুলো সীমার বাইরে গিয়ে পুঁজিবাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল। আর ২০১৭ সালে এসেও একইভাবে ব্যাংকের শেয়ারকেই দায়ী করা হচ্ছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগ করায় বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করেনি বরং এবার সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করার পাশাপাশি জরিমানাও করেছে।

এবার একটু জেনে নেই, কেন ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়লো আর কেনই বা বাজার পড়লো। পুঁজিবাজারে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ব্যাংকগুলোকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দর বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। পুঁজিবাজারে লভ্যাংশ বিতরণকে কেন্দ্র করে আর্থিক খাতের শেয়ারের দর অযৌক্তিকভাবে বাড়াতে থাকে। আর এতে জুলাই মাস থেকে পুঁজিবাজারে মূল্যসূচকও বাড়তে শুরু করলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের মনিটরিং জোরদার করে।

এদিকে দেখা যায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, একটি ব্যাংক তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক, বাজারে অতিরিক্ত লেনদেন পরিস্থিতি দেখে ২১টি ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ তদন্ত করে। আর এতে আইন ভেঙ্গে পুঁজিবাজারে নির্ধারিত সীমার বেশি বিনিয়োগ করায় ৭ টি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়। আর এতে শুধু ব্যাংক খাতেই নয় পুরো পুঁজিবাজারে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ব্যাংকগুলোকে ১০ লাখ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে।

আবার অক্টোবরের মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ তুলে আনতে হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে। আর ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমাতে এবং ডিপোজিটরদের টাকার নিশ্চয়তা প্রদান করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত দু'বছর ধরে ব্যাংকগুলো এভাবে শেয়ার বাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করছে। আর এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের শেয়ার বাজারের বিনিয়োগগুলো খতিয়ে দেখে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়।

মূলত ব্যাংকগুলোর যেকোন সময় বড় ধরনের ঝুঁকি এড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসকল নির্দেশনা দিচ্ছে। যা দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ও বিনিয়োগকারী উভয়ের জন্য মঙ্গল। আর ২০১০ সাল থেকে শিক্ষা নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় দিক নির্দেশনা প্রদান করছে। যাতে বাজার ও বিনিয়োগকারী উভয়ই ভালো থাকে। আর ব্যাংকগুলো তার সীমার মধ্যে থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারে। এছাড়া বাজারে অনাকাঙ্খিত ঝুঁকি এড়াতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে প্রভিশন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সরকারের প্রজ্ঞাপনের উপর ভিত্তি করে চেয়ারম্যানের মেয়াদ নয় বছর বাড়ানো ও একই পরিবারের দুইজনের পরিবর্তে চারজন পরিচালক হওয়ার যে সিদ্ধান্ত এসেছে তাতে অনেকেই মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে পরিচালক হওয়ার জন্য বাজার থেকে প্রচুর পরিমাণে শেয়ার ক্রয় করেন। তার প্রভাবও খুব দ্রত গতিতে ব্যাংকের শেয়ারের উপর পড়তে থাকে। ফলে কোন কোন ব্যাংকের শেয়ার রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই দাম বৃদ্ধির সাথে ব্যাংকের আয়ের ও লভ্যাংশ প্রদানে কোন সঙ্গতি ছিল না বলে বাজারে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী মনে করেন। আর যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে অক্টোবরের মধ্যে শেয়ারবাজার থেকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ তুলে আনার কথা বলেছে এ কারণে শেয়ার ক্রয়ের চাপ অনেক কমে গেছে। ব্যাংকের পরিচালকদের শেয়ার কেনার চাপ কমে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। হতাশায় পড়েছে ছোট বিনিয়োগকারীরা যারা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন।

ব্যাংকের আর্থিক খাতের তৃতীয় প্রান্তিকের শেয়ার প্রতি আয়ের খবর বাজারে আসতে শুরু করেছে। যা বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকের শেয়ারে হতাশা তৈরি করেছে। আর এতে ব্যাংকের শেয়ারের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাবে পুঁজিবাজারে সার্বিক সূচক ও লেনদেন নেতিবাচক রয়েছে। লেনদেন কমে ১০০০ কোটি টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

জুন ক্লোজিংয়ে অন্যান্য খতের শেয়ারগুলোর মধ্যে খাতভিত্তিক কিছু কিছু শেয়ার ভালো লভ্যাংশ দেয়ার কারণে ব্যাংকের দিকে শেয়ার ছেড়ে অন্য শেয়ারেও লেনদেন করছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আর এই সবকিছুই পুঁজিবাজারের উপর প্রভাব ফেলছে। মূলত ব্যাংকের শেয়ারের মূল্যপতনের কারণে সাময়িকভাবে পুঁজিবাজারে সূচক ও লেনদেন নেতিবাচক রয়েছে। শেয়ারের দরের মূল্যবৃদ্ধি ও ব্যাংকখাতের সাথে সাথে অন্যান্য খাত ভিত্তিক লেনদেন এগিয়ে গেলে বাজার আরো ভালো হবে।

পুঁজিবাজার অনেকটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকলে পুঁজিবাজার ভালো থাকবে। সামনে সুষ্ঠু নির্বাচন পুঁজিবাজারের জন্য হতে পারে আশীর্বাদ। তবে ভয় রয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে। কারণ এর প্রভাবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা শংকিত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাড়তি চাপ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন এতে দীর্ঘ সময়ে বাজার ও অর্থনীতি দুটোর উপরই প্রভাব পড়তে পারে। তাই এখনই সরকারকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, না হলে বাড়তি চাপ অর্থনীতির উপরে বড় বোঝা হয়ে যেতে পারে যা বিনিয়োগকারীদেরও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ উৎসাহ দিচ্ছে না। আর একথা অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন যে রোহিঙ্গা ইস্যু অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে শংকিত দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা।

তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগামী একবছর অনেক ব্যবসায়ী সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে ফলে বাজার অর্থনীতিতে অর্থের যোগান কমে আসছে। আর এর প্রভাব পুঁজিবাজারেও পড়তে পারে। তাই বিনিযোগকারীদের খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামী একবছর তাদের শেয়ারের পোর্টফোলিওতে কোন কোন শেয়ার রাখবে। আর বাজারের গতিবিধি নজরে রেখে শেয়ারের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। তবে বাজার পরিস্থিতির পরিবর্তন হোক এটাই সবার কাম্য।

লেখক : বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা। একাধারে সাংবাদিক, লেখক, সংবাদপাঠিকা এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালক। এছাড়াও অর্থনীতি ও পুঁজিবাজার বিষয়ে রয়েছে তার সংবাদ ও টেলিভিশন টক শো। সদস্য, এফবিসিসিআই। কো-চেয়ারম্যান এসএমই, পাট, ইয়াং এন্টারপ্রাইনার ও পুঁজিবাজার বিষয়ক স্টান্ডিং কমিটি। বর্তমানে এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশনের সার্টিফাইড প্রশিক্ষক এবং উদ্যোক্তা।

এইচআর/জেআইএম

‘বাজারের গতিবিধি নজরে রেখে শেয়ারের যত্ন নিজেকেই করতে হবে। তবে বাজার পরিস্থিতির পরিবর্তন হোক এটাই সবার কাম্য।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।