আমড়া গাছে কি আম হবে?

তানজীনা ইয়াসমিন
তানজীনা ইয়াসমিন তানজীনা ইয়াসমিন , কলামিস্ট, গবেষক
প্রকাশিত: ০৪:১০ এএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

ভারতীয় ম্যুভি “ থ্রি ইডিয়েটস” দেখেনি এমন চলচ্চিত্রপ্রেমী খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
তো একটা দৃশ্যটা মনে আছে?
ক্লাশে শিক্ষক মেশিন কাকে বলে এই বিষয়ে লেকচার দিতে দিতে দেখেন ম্যুভির প্রধান চরিত্র আমির খান ব্যাপক বিনোদিত চিত্তে ফিকফিক করে হাসছে ।
ক্লাশে চোখ মুখ সিরিয়াস শক্ত থাকতে হবে, এমনই অলিখিত নিয়ম। স্বভাবতই আমির খান লেকচার আদৌ শুনেছে কিনা কেঁচে ধরতে শিক্ষক মেশিন কাকে বলে জানতে চাইলেন।
আমির জবাব দিলেন , “মেশিন হোল সেই জিনিস যা আমাদের কাজকে সহজ করে দেয় , সময় বাঁচায়।”

প্যান্টের জিপার টেনে দেখিয়ে আমির দেখালেন এই যে একটি ছোট যন্ত্র দিয়ে প্যান্ট খোলা বন্ধ কত সহজ হয়ে যাচ্ছে; তো এমনটাই হলো মেশিন।
স্যার এহেন ফাজলামিতে অগ্নিশর্মা হয়ে ক্লাস থেকে আমিরকে বের করে দিলেন। স্যারের পছন্দ হলো মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী ছাত্রের পুঁথিগত সংজ্ঞার উদগীরণ।
অথচ আমির যখন তাঁর ক্লাশে রেখে যাওয়া বই ফেরত নিতে এলেন এবং স্যার জানতে চাইলেন সে কেন ফিরেছে , তখন বইয়ের পুঁথিগত সংজ্ঞা শোনাতেই স্যার দুর্বোধ্যতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন ,“সরল করে বলতে পারো না?”
আমির জবাব দিলেন ,“একটু আগে সেই চেষ্টাই করেছিলাম স্যার, আপনার পছন্দ হয়নি।”
আমির বলেছিলেন বিষয়টা তো বুঝতে হবে! বইয়ের সংজ্ঞা স্রেফ মুখস্থ করে উগড়ে দিলে কার কি উপকার?

“তারে জমিন পার” শিশুদের ওপর শিক্ষা শোষণের এক কালজয়ী চলচ্চিত্র। ছবিতে নতুন ছাত্র ঈষাণকে সাহিত্যের ক্লাশে পাঠ্যবইয়ের কবিতা শুনিয়ে স্যার জিজ্ঞেস করলেন কবির ভাবনা বলতে। সদ্য ভর্তি হয়ে ক্লাশে আসা শিশু ঈষাণ থতমত খেয়েও সরলভাবে সত্যিকার ভাবার্থ বলতে সক্ষম হলো। কিন্তু শিক্ষকের তো পছন্দ হলো না। এটাতো তাঁর লিখে দেয়া বা নোটে ছাপা দুর্বোধ্য অলংকরণের উত্তর হয়নি। ক্লাশ শেষে সেই ক্লাশের ফার্স্ট বয় ঈষাণকে হতাশ কণ্ঠে বলল, “ সবাই না বুঝে মুখস্থ উত্তর দিয়ে গেল, কিন্তু আসল ভাবার্থটা তুমিই বুঝেছ। কিন্ত লাভ নেই, স্যার খুব কড়া। তাঁর বলে দেয়া উত্তর মুখস্থ করেই পরীক্ষা পার করতে হবে।”

খুব কমন উদাহরণ , “আমার জীবনের লক্ষ্য” বা “নৌকা ভ্রমণ” টাইপ একান্ত নিজস্ব রচনাও কি হরলাল রায় বা অন্য কারো লেখা মুখস্থ ছাড়া আমরা লিখেছি কোনদিন? ভাবাই যায় না! অথচ এটাতো নিউটনের সূত্র না যে মুখস্থ করে উগড়ে দিতে হবে! জীবন বৃথা যায় এই জীবনবোধ বুঝতে। এটা আমাদের সবার শিক্ষা জীবনেরই ফটোকপি। এবং এজন্যই এই ছবিগুলি এত বেশি গভীরে ছুঁয়ে যায়।

আমার ছোট ছেলেটাও হাতেখড়ির বয়সে বাংলা হরফের মারপ্যাঁচ মনে রাখতে পারতো না। ডানে প্যাঁচ নাকি বামে - খালি ভুলে মেরে দিত । আমি চেষ্টা করে বকে বকে হয়রান হয়ে কত গালমন্দ করতাম। কিন্তু আমার ছেলে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো যে কেন আমি রেগে যাচ্ছি। “তারে জমিন পার” দেখেই ধরতে পেরেছি সেও একই ধরনের সমস্যাতে ভুগতো। সেও বুঝতো না হরফগুলি ঠিক কোনটা কোনদিকে বেঁকে। এদিকে আমি বুঝতাম না কেন তারই বড় ভাই এত দ্রুত সব ধরে ফেলতো, আর সে পারে না।

ইংরেজি মাধ্যমের সেরা এক স্কুলে দুই ছেলেকেই দিয়েছিলাম। একই দশা। শিক্ষকেরও একই নালিশ। এমন বড় ভাইয়ের এতো গাধা ছোট ভাই। ভাগ্যিস তখন ততদিনে আমরা সমস্যাটা কিছুটা বুঝতে শিখেছি। আমার দুই ছেলের ব্যাগের বোঝা এত বেশি ছিল যে স্কুলে থেকে বেড়িয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিত। আর সব বাচ্চাদের মতই ড্রাইভার, বুয়া বা নিতে যাওয়া অভিভাবক সেই ব্যাগ টানতো। যাদের বাচ্চাদের একা স্কুলে যাওয়াই গতি- তাদের পিঠে এই ব্যথা ক্রনিক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে বেড়ে উঠতে বাধ্য।

প্রতিবেদন পড়লাম ব্যাগের বোঝা শরীরের চেয়ে বেশি। অথচ জাপানে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাচ্চাদের হেঁটে যাওয়া বাধ্যতামূলক। বাচ্চাপ্রতি গাড়ির জ্যামের এখানে কোন সূযোগই নেই। আর হেঁটে যাবে বলে বাচ্চাকে একই ওয়ার্ডে, বাসভবনের ২০ মিনিট হাঁটার মত দূরত্বের ভেতরে যে স্কুল, তাতেই ভর্তি হতে হবে। তাই সব স্কুলের শিক্ষার গুণগত মান সমান । আর বাচ্চাদের জুনিয়র হাই স্কুল, মানে সপ্তম শ্রেণির আগে কিছুই বাসায় আনতে হয় না, জুনিয়র হাইস্কুলেও নিতে হয় হোমওয়ার্কের খাতা আর নির্দিষ্ট কিছু বই। ক্লাশে যার যার নির্দিষ্ট ডেক্সে পাঠ্যবই, ক্লাশের খাতা রেখে আসতে হয়। তাই ভারী ব্যাগ বহনের অমানবিকতার বিষয়টাও নেই। আমাদের স্কুলগুলিতে কি এই উদ্যোগ খুব অসম্ভব? মুখস্থ বিদ্যার তর্কে ছিলাম; আমরা হাতেখড়িই পাই এসব পরোক্ষ নকল দিয়ে । আমরা নিজে কি বুঝেছি ভেবে নেবার কোন এখতিয়ার নাই জেনেই মস্তিষ্কের সেই অংশ অকার্যকর রেখেই শেখা শুরু হয়। বইতে যা লেখা, শিক্ষক যা শেখাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছেন আমরা তা গিলতে বাধ্য। নাহলে পাশ হবে না।

ভাল ডিগ্রি নিয়েছি, জ্ঞানলাভ জিরো। তাই শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে চাকরিরত অবস্থায় ভ্যালু এডিশনে এমবিএ করছিলাম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে। সত্যি বলতে যেকোন বিষয়কে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে তুলে ধরার সেখানেই হাতেখড়ি। তো এক ভিজিটিং প্রফেসর ইউরোপ থেকে এক সেমিস্টার নিতে আসলেন, বিজনেস্ ইকোনমিক্স পড়াবেন। এসাইনমেন্ট দিলেন ৪ জনের গ্রুপ করে করে। সবাই মিলে কাজ করলেও এসাইনমেন্ট লেখায় সবার গড়িমসী। একজন দায়িত্ব নিল, আমরা বাকিরা তার মতই লিখে দিলাম। স্যার বহু বছর বাইরে পড়াচ্ছেন । রিসার্চ পেপারের বিশ্বমানের নিয়ম-নীতি মেনে এসেছেন। এর ব্যত্যয় দেখেই তো তার চোখ কপালে। ডেকে বসলে সবাই চুপ। সবাই ঢাবি, বুয়েট ছাড়াও প্রথম সারির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা । এই বয়সে এহেন অপদস্তি কি নেয়া যায়?

আমি স্বভাবসুলভ সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা মেনে জিজ্ঞেস করলাম , “স্যার মাফ করবেন, সমস্যাটা কোথায়? আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে পজিশনসহ পাস করে এসেছি। মাস্টার্সের থিসিস গ্রুপে আমার অনেক সহপাঠী /পাঠিনী ছিল যাদের থিসিস সুপারভাইজরের তাদের পেপারে চোখ বুলানোর অবস্থা ছিল না, গাইড করা তো দূরের বিষয়। ল্যাবে গবেষণার ইকুইপমেন্ট, পরিবেশ কিছুই নাই। যুগ যুগ ধরে সিনিয়রের থিসিস এদিক সেদিক করেই সবাই পার পায়। আমাদের এসবেরই হ্যান্ডস-অন-ট্রেনিং নেয়া। এটা যে অন্যায়, অনৈতিক এটা তো আমাদের জানতে হবে। আপনি কি স্যার আজকে আমড়া গাছে আম আশা করতে পারেন ?”

স্যার নিজেও সম্ভবত ঢাবির প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আমার কর্মক্ষেত্র কিউশ্যু ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি গবেষক থেকে সিনিয়র প্রফেসর- সবাইকে গবেষণা, পাবলিকেশনের রীতিনীতির ওপর নিয়মিত আপগ্রেডেট কোর্স করে এমসিকিউ ক্লিয়ার করতে হয়। কারণ সামান্য নীতির বা ডাটা হেরফেরেও চাকরি চলে যাবে, অন্যের লেখা কপি তো বহুদূর।

সাম্প্রতিক গবেষণা-পত্র চুরির আলোড়ন তোলা ঘটনায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যান্সার শেষ স্টেজে এসে উন্মোচিত হয়েছে। কারণ, জগদ্বিখ্যাত লোকের গবেষণা পত্র স্রেফ পুকুরচুরি হয়েছে এবং প্রখ্যাত শিক্ষক প্রধান লেখক হয়েও দায় অস্বীকারও করেছেন!! পচনের মাত্রা বিচারে অভূতপূর্ব উপযোগী কম্বিনেশন!! তবুও কেউ বলছেনা পাতার পর পাতা এমন হুবহু কপিকে প্লেজারিসম বললে প্লেজারিসমকে তীব্র অপমান করা হয়। এমনকি নকল করতেও নকলবাজের এরচেয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়। স্রেফ গুগল করে কপি করে দেয়া হয়েছে এমন একটি কাজ- যা গবেষকদের মাসের পর মাস, বছর খেটে লিখতে হয়।

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অন্তত শিক্ষা, অর্থাৎ জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারখানার এবং এতে জড়িতদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

‘প্যান্টের জিপার টেনে দেখিয়ে আমির দেখালেন এই যে একটি ছোট যন্ত্র দিয়ে প্যান্ট খোলা বন্ধ কত সহজ হয়ে যাচ্ছে; তো এমনটাই হলো মেশিন।’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।