বিএনপির ইতিহাস কান্নার নয়, মানুষকে কাঁদানোর

মাসুদা ভাট্টি
মাসুদা ভাট্টি মাসুদা ভাট্টি , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ২৪ আগস্ট ২০১৬

বিএনপির সদ্য ভারমুক্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন, বলেছেন, তাদের নেতাকর্মীরা ঢাকায় হকারি করে জীবন ধারণ করে আর দেশে কথা বলার সুযোগ নেই বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সম্প্রতি একটি আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া নিয়ে তিনি কান্না ভরা স্বরে বলেন, দেশে এখন আর কারো স্বাধীনতা নেই। বিএনপি মহাসচিবের এই কান্না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আলোচনা চলছে, বেশ কিছু টেলিভিশন তার এই কান্নাকে বার বার হাইলাইট করছে। আমারও মনে হয় যে, মির্জা সাহেবের এই কান্না নিয়ে আলোচনা হওয়াটা খুব জরুরি। কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা বড় একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে বার বার কান্না করতে দেখছি। এই প্রথম বিএনপির মহাসচিব পর্যায়ের একজনকে জাতি কাঁদতে দেখলো এবং তার নেত্রীকে জেলখানা থেকে মুক্তির পর কাঁদতে দেখেছিল দেশের মানুষ কিন্তু এর আগে বিএনপির যে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস সেটি আসলে মানুষকে কাঁদানোর, কান্নার নয়।

রাজনৈতিক কলাম লেখকদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো তাদেরকে রাজনীতির অতীত ঘাঁটতে হয়। বিএনপি নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটির রাজনৈতিক ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাক একটু। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং জাতীয় চার নেতার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে। তিনি সেনা বাহিনীর উপপ্রধান হয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, জেনেছেন যে, দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যার চেষ্টা চলছে, তিনি তাদেরকে অভয় দিয়ে বলেছেন, এগিয়ে যেতে। অথচ রাষ্ট্রপতিকে তথা দেশকে বাঁচানোর শপথ করেছিলেন প্রজাতন্ত্রের চাকর হিসেবে। তিনি সেটিতো পালন করেনইনি, উল্টো এতোগুলো মানুষকে হত্যার কথা জানতে পেরে একজন মানুষ হিসেবেও তাদেরকে বাঁচানোর তাগিদ অনুভব করেননি।

এরপর ক্ষমতায় বসে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করেছেন যাদের প্রথম কাতারে রয়েছেন কর্নেল তাহের। বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দায় নেবে না ভালো কথা, কিন্তু একবারও কি কর্নেল তাহের হত্যার জন্য তার পরিবার ও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছে? চায়নি। অথচ কর্নেল তাহের না থাকলে জিয়াউর রহমানের ইতিহাস শেষ হয়ে যেতো ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরেই। কত মানুষ, কতো পরিবার গত ৪১ বছর ধরে কাঁদছে মির্জা সাহেব? হিসেব নিশ্চয়ই আপনার রাখার কথা নয়!! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে ধরে এনে নির্যাতনের ইতিহাস মির্জা সাহেব ভুলে যেতে পারেন কিন্তু এমন অনেক মানুষ আছে সেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন, সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়েছেন, এমন মানুষের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে, যিনি জিয়াউর রহমানের নির্যাতনের শিকার।

আচ্ছা জিয়াউর রহমানকে দূরে সরিয়ে রাখি, বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের কথা বলুনতো মির্জা সাহেব? দুই বারের (প্রকারান্তরে তিনবারের) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেগম জিয়ার হাতে কতো মানুষের রক্ত লেগে আছে, একটু ঝাঁক মেরে দেখবেন কি? বিখ্যাতদের তালিকায় আইভি রহমান থেকে শুরু করে সাবেক অর্থমন্ত্রী, আহসান উল্লাহ মাস্টার, গোপালচন্দ্র মুহুরী, সাংবাদিক হুমায়ূন কবির বালুসহ তালিকাতো বিশাল। আর অবিখ্যাত, অখ্যাতদের লাশের মিছিল এতোটাই দীর্ঘ যে, কী বলবো। আমরা স্মরণ করতে চাই ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা, নির্বাচনী সহিংসতা বলে যাকে চালানোর চেষ্টা করেছিল বিএনপি, যে সরকারের মন্ত্রী ছিলেন মির্জা সাহেব নিজে, সেই আমলে ভোলা, রামশীল, কোটালিপাড়া, আজিমনগর, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জে যে ব্যাপক ও ন্যক্কারজনক হিন্দু-নিধনের ঘটনা ঘটেছে এবং তা নিয়ে যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার নামে প্রহসন করা হয়েছিল, মির্জা সাহেব নিশ্চিত ভাবে সে গণকান্নার গল্প সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন। প্রশ্ন করতেই পারেন কেউ যে, হিন্দুদের ওপরতো এই সরকারের আমলেও নির্যাতন হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে এবং হচ্ছে, এর বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানাতে হবে এবং অবশ্যই হিন্দুরা বলতেই পারে যে, তাদেরকে রক্ষার জন্য আর কেউ নেই “ভগবান” ছাড়া এদেশে, কিন্তু মির্জা সাহেবের মুখে সেকথা মানায় কি?

মির্জা সাহেব ও তার দল বিএনপি দেশের একটি চিহ্নিত উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আছেন। এই দলটি এদেশে রগকাটা ও ব্রাশফায়ারে মানুষ হত্যায় সিদ্ধহস্ত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে তখন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে যে সরকার-বিরোধী তৎপরতা চালু হয় তা বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে দেশ-বিরোধী ষড়যন্ত্রে পর্যবসিত হয়। আমি কিংবা আমার মতো অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, বিএনপি দল হিসেবে যদি জামায়াতের এই সন্ত্রাসী ও ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে মদদ ও সমর্থন না দিতো তাহলে আজকে বাংলাদেশের রাজনীতি অন্যরকম হতো। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন আজকে মির্জা সাহেবরা নিয়মিত তুলছেন, তা তুলতে হতো না, কারণ নির্বাচনে তখন বিএনপি দলগত ভাবে অংশগ্রহণ করতো, চাইকি ক্ষমতায়ও হয়তো আজকে ফখরুল সাহেবরা থাকতে পারতেন। কিন্তু অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন যে, জামায়াতের কারণেই বিএনপি নেত্রী তখন নির্বাচনে অংশ নেননি।

যাক সে হাইপো থিসিসের কথা। কিন্তু ফখরুল সাহেব যে অনুষ্ঠানে কাল কেঁদে ফেলেছেন সে অনুষ্ঠানটি মূলতঃ ছিল আমার দেশ পত্রিকার বিচারাধীন সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে। এই মাহমুদুর রহমান সাহেবের কুকীর্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বড় একটি ক্ষত হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই, বিশেষ করে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে চরম মিথ্যাচার ছড়িয়ে একের পর এক ব্লগারকে হত্যার পেছনে মাহমুুদুর রহমানকে সরাসরি অভিযুক্ত করা যায়। মির্জা সাহেব কি নিহত ব্লগার, পুরোহিত কিংবা বিদেশিদের স্বজনদের কান্না একদিন কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছেন? কিংবা ধরুন ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রলবোমা-সন্ত্রাসে পোড়া মানুষদের আহাজারিতে মির্জা সাহেবের কি কখনও কাঁদতে ইচ্ছে করেছে? করেনি। করবে কী করে? এসব মানুষের প্রাণের তো কোনো মূল্য নেই, রাষ্ট্রের পুুলিশ কিংবা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের হত্যাতো রাজনীতিতে জায়েজ করে দিয়েছেন মির্জা সাহেবের নেতা জেনারেল জিয়াউর রহমান।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একজন ভদ্রলোক মানুষ, বিএনপির ক্লিন ইমেজের নেতাদের প্রধানতমদের অন্যতম, তিনি বলেন খুব সুন্দর করে, কিন্তু এই সুন্দর করে বলার ভেতর অনেক যে মিথ্যে থাকে এবং সেই মিথ্যেগুলো যে মানুষ ধরে ফেলে সেটা মির্জা সাহেবরা ঠিক বুঝতে চান না। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিন্দা জানিয়েছেন, নৃশংস ঘটনা বলে উল্লেখও করেছেন। এই নৃশংসতা নিয়ে মির্জা সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন কি বলেছেন? একটি ইংরেজি দৈনিকে মির্জা সাহেবের সে সময়কার মন্তব্য তুলে দিয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এরকম ঘটনা ঘটিয়ে জনগণের সিমপ্যাথি আদায় করতে চাইছে। সত্যিই মির্জা সাহেব? ভাবুনতো একবার, আজকে আপনার কান্নাকে যদি কেউ ঠিক এই ভাবে বলে? বলে যে, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের মনকে দ্রবীভূত করার জন্য চোখের জল ফেলছেন, কেমন লাগবে তখন? অথচ দেখুন, ২১শে আগস্ট কতোজন নিহত হয়েছিল? আহতের তালিকা কতো বড়? একবারও খোঁজ নিয়েছিলেন তাদের কারো? কই মন্ত্রী হিসেবে ২১শে আগস্টের আহত-নিহতদের পরিবারের কাউকে সমবেদনা জানিয়েছিলেন কোনোদিন? না না সেটাতো প্রয়োজন পড়েনি, ক্ষমতায় ছিলেন তখন, তাই না?

বাংলাদেশের  রাজনীতিতে দু’দু’টি ন্যক্কারজনক ঘটনা ১৫ই আগস্ট ও ২১শে আগস্ট, দুটিরই টার্গেট আওয়ামী লীগ, আগে যেগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো না হয় বাদই দিচ্ছি। এই দেশে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা যতো চোখের জল ফেলেছে তার মূল্য কি আপনি বা আপনার সরকার কখনও দিয়েছে? দেয়নি, উল্টো ১৫ই আগস্টে আপনার নেত্রী কেক কেটেছেন, তার পুত্র নোংরাভাবে বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করেছে কটুবাক্যে, এমনকি বেগম জিয়ার নাতনি জায়মা রহমান তার ফেসবুকে বঙ্গবন্ধুকে তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করে, মির্জা সাহেবদের একবারও এতে মনে হয় না যে, জিয়াউর রহমানের রক্তের মধ্যেই রয়ে গেছে অবিনয়, হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বীজ এবং অপরাজনীতিরতো বটেই।

আমরা খুঁজে পাই না কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো কোনো বিএনপি নেতা এখনও খুনের শিকার হয়েছেন কিনা? ২০০১ সালের সরকার যতো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে তার হিসেব নিশ্চয়ই ফখরুল সাহেবের কাছে নেই, আছে যারা এর শিকার তাদের কাছে। কিন্তু এতোদিন পরে এসেও বিএনপির পক্ষ থেকে আহত-নিহত নেতাকর্মীদের কোনো তালিকা দেশবাসীর সামনে আসেনি। কিন্তু মির্জা সাহেব তাদের জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছেন। আর বিএনপি কর্মীদের হকারির জন্য তিনি দুঃখ করেছেন,  মির্জা সাহেব কিন্তু এই তথ্য ঠিকই জানেন যে, বিএনপি’র ব্যবসায়ী নেতাদের প্রত্যেকের ব্যবসাই এই আমলেও অবাধ, সুষ্ঠু ও অটুট রয়েছে এবং ফুলে-ফেঁপেও উঠছে। কেন বিএনপি কর্মীদের হকারি করতে হয়, কেন কোনো বিএনপি শিল্পপতি/ব্যবসায়ী তাদেরকে চাকরি দেয় না? এই প্রশ্ন মির্জা সাহেব তোলেন না কিন্তু। লেখা দীর্ঘ হচ্ছে, তাই ইতি টানতে টানতে বলতে চাই যে, একটু দলের রাজনৈতিক ও শাসন-শোষণের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিন মির্জা সাহেব, আওয়ামী লীগের যেটুকু অন্যায্য শাসন সেটুকুর দায় আওয়ামী লীগকে নিতে হবে এবং সে জন্য সমালোচনা করার মতো অনেকেই রয়েছেন। কিন্তু বিএনপি আমলে বিএনপির সমালোচনার সাহস কারো হয় না। সরকারি গোয়েন্দারা কাগজে, টেলিভিশনে ওঁৎ পেতে থাকেন সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা হচ্ছে কিনা, লেখা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করতে আর তেমন কাউকে পাওয়া গেলে তাদের ভাগ্যে থাকে চরম নির্যাতন। এনামুল হক, সালিম সামাদ, প্রিসিলা রাজ, মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবীর কার কার কথা বলবো, তালিকাতো দীর্ঘ। মাহমুদুর রহমান যে পরিমাণ মিথ্যাচার করেছেন, ধর্মকে যতটা নোংরা ভাবে ব্যবহার করেছেন তারপরও তাকে আপনারা সাংবাদিক/সম্পাদক বলতে পারেন কিন্তু সত্যিকার অর্থে তিনি একজন সন্ত্রাসীর চেয়েও ভয়ঙ্কর। মির্জা সাহেবের কান্নাকে মূল্যহীন বলতে চাই না, শুধু মনে হয়, এই কান্না থেকেও যদি কিছু শিক্ষা আমরা পাই তাহলে সামনে হয়তো রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো গুণগত পরিবর্তন হলেও হতে পারে। আশাবাদী হতে দোষ কি বলুন?

ঢাকা ২৪ আগস্ট, বুধবার ২০১৬
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

এইচআর/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।