ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল: কার দায় কে ভোগে?

ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের স্মার্ট পারফরম্যান্স এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পর অপেক্ষা ছিল দু’দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতি দেখার। আশা করা হচ্ছিল, সম্পর্ক অবনতির পারদ কমবে। কিন্তু, দৃশ্যত ঘটলো উল্টোটা। বাংলাদেশের ট্রান্সশিফমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। দেশটির বিমানবন্দর ও বন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সঙ্গে আবার এ কথাও বলা হয়েছে, এ পদক্ষেপের কারণে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তাহলে অর্থ কী দাঁড়ালো?
ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র জেদের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটি আখেরে আত্মঘাতী হয়। কথাটি সব দেশের-সমাজের জন্যই প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রেও একটা সময়ে গিয়ে তা-ই হবে। আবার ফয়সালাও আসবে। ততক্ষণ পর্যন্ত হীনমন্যতার পরিচয় দিল ভারত। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ করার উদ্দেশ্যেই ভারত এ পদক্ষেপ নিয়ে থাকলে বিশ্বায়নের এ যুগে ভারতকেও পস্তাতে হবে। মাঝ দিয়ে কিছুদিন ভুগবে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ভারতের এ বেআইনি এবং অপ্রতিবেশী সুলভ আচরণ মোটাদাগে লেখা থাকবে। যেমনটি লেখা হয়ে গেছে, শুল্ক ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চিঠি এবং এতে ট্রাম্পের সাড়া দেয়ার ঘটনা। চিঠিতে ৩ মাসের জন্য বাংলাদেশের ওপর আরোপিত ৩৭ % শুল্ক প্রস্তাব স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন ইউনূস। এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর প্রতিক্রিয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রধান উপদেষ্টা লিখেছেন, “শুল্ক কার্যকর ৯০ দিন স্থগিত করার আমাদের অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ায় আপনাকে ধন্যবাদ মিস্টার প্রেসিডেন্ট। আপনার বাণিজ্য এজেন্ডাকে সহায়তা করতে আমরা আপনার প্রশাসনের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখব।”
এর মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের খ্যাতি-জ্যোতি এবং বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আবারো প্রমাণ হলো। ভারতকেও একটা ফয়সালায় আসতে হবে। আপাতত যুক্তি হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবারের বিবৃতিতে বলেছে, একটি বড় সময় ধরে বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দিতে থাকায় তাদের বিমানবন্দর ও বন্দরগুলোতে বেশ জট দেখা দিয়েছে। লজিস্টিক্যাল (পরিবহন সরঞ্জাম ও অন্যান্য সুবিধা) সেবায় বিলম্ব এবং উচ্চ ব্যয়ের কারণে তাদের নিজেদের রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্যাকলগ (পণ্যের জট) তৈরি হচ্ছে। সেই কারণে এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আর প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবৃতিটিতে যোগ করা হয়েছে আরেকটি লাইন: এ পদক্ষেপে ভারতের সীমান্ত দিয়ে পরিবহন করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়বে না।’ পরে এক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল।
বিবৃতি বা ব্যাখ্যায় যা-ই বলা হোক, রফতানি প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি ধাক্কা খেয়েছে। আর ভারতও তার স্বরূপ আবার প্রকাশ করেছে। ইউনূস –মোদি বৈঠকে দু’দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়েও কথা হয়েছিল। এরমধ্যেই ভারতে বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হতবাক করা একতরফা সিদ্ধান্ত। যখন খোঁজা হচ্ছিল দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পথ। স্বাভাবিকভাবেই রপ্তানিকারকরা এতে উদ্বিগ্ন। ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারতের ভূমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে কম খরচে ও কম সময়ে এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ। সেখানে একটা ছেদ পড়লো। তাদের এখন বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। এক দুয়ার বন্ধ হলে বিকল্প অনেক দুয়ার খুলে যাওয়ার অনৈক দৃষ্টান্ত বিশ্বায়নের যুগে রয়েছে। ঘটনার পরম্পরায় কী কারণে আমাদের বিমানবন্দরের খরচ অনেক বেশি সেটা খুঁজে বের করা এখনকার অন্যতম কাজ। সরকার কার্গো স্পেসের সমাধান করলে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সমস্যা সমাধানের পথ বের হতে পারে।
বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বড় বাজার আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ওমান ও কাতার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১০০ দেশে ৩৪১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলারের খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরে ছিল ৩৮৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার। ভারত ছাড়াও নেপাল, ভুটানসহ ১৪৫টির বেশি দেশে মসলা, জুস, মুড়ি, স্ন্যাকস ও কনফেকশনারিসহ প্রচুর খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। ভারতের একটি মহলের তা সহ্য হচ্ছিল না। দেশটির অ্যাপারেল এক্সপোর্টার্স কাউন্সিল দীর্ঘদিন ধরে এ সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। কারণ, বাংলাদেশ ও ভারত তৈরি পোশাক খাতে প্রতিযোগিতা করছে।
বিশ্ব বাণিজ্যে পোশাক খাতে ভারতের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের (এফআইইও) মহাপরিচালক অজয় সাহাই বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের ফলে এখন আমাদের কার্গো পরিবহনে অতিরিক্ত সক্ষমতা থাকবে। অতীতে রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার কারণে বন্দর ও বিমানবন্দরে স্থান কম পাওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করতেন। তাদের মনে এখন স্বস্তি বোধ হতে পারে। মনের এ স্বাধীনতা যার যার স্বার্থ ও রুচির ব্যাপার।
ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে একটি বার্তা দিয়েছে। ঝানু কূটনীতিক এবং বনেদি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, ভারতের এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সাময়িক ধাক্কা খেলেও তা কেটে যাবে। গেল ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হয়। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকের পরে দুইপক্ষের মধ্যে ইতিবাচকভাবে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মতো একটি পরিবেশ তৈরি হবে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এক বৈঠকের দুই ন্যারেশন আসে দুই দেশের গণমাধ্যমে। স্যোসালমিডিয়া একে আরো ফুলিয়েফাফিয়ে প্রকাশ করে। দুই নেতার বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিয়ে উভয় দেশের সংবাদমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী খবর পরিবেশন হয়। এরপরই আসে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের সার্কুলার।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়টি জরুরি। আবার ভারতের জন্য সংখ্যালঘু বিষয়টি জরুরি। এই দুটি স্পর্শকাতর বিষয় বৈঠকে আলোচনা হবে, তাও ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরের আলোচনা এবং বাইরে সেটি জানানোর ক্ষেত্রে গোলমাল ঘটেছে। অথচ কূটনীতির নিয়মে স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশে যে সাবধানতা দরকার উভয় দেশের গণমাধ্যমেই তা সেভাবে রক্ষা করা হয়নি। সেইসঙ্গে প্রচার হয়েছে বাড়তি কথা। অথচ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত পরিস্কার ও সংযত। গুনে গুনে কয়েকটি শব্দে কথা বলেছেন তিনি। শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে কী আলোচনা হয়েছে এ প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত কিছু হয়নি। আমি এটুকুই বলবো।’ কিন্তু, তার মতো ‘এটুকুতে’ থাকেনি দুদেশের অনেক গণমাধ্যমই।
অনিবার্য এ ধরনের ইস্যুতে কথায়-লেখায় সাবধানতা-সংযমের ব্যাপক অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়া এ বিষয়টির সঙ্গে অর্থনীতির ব্যাপক সম্পর্ক। কথাশিল্পীরা কিন্তু বলেই খালাস। লেখকরা লিখেই দায়িত্ব শেষ। হাবিজাবি কন্টেন্ট বানিয়ে পগারপাড় ইউটিউবাররা। পুরো জেরটা সইতে হয় দেশকে। ভুগতে হয় বিজনেস কমিউনিটিকে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ এখন বিশ্ব রাজনীতির দ্য গ্রেট গেইম প্ল্যানিংয়ের শুধু দর্শক নয়, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন তথা প্লেয়ারও! এর কারণ গ্লোবাল জিওপলিটিক্স ও ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান। আসছে দিনগুলো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সাথে কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার লড়াইর সন্ধিক্ষণও। তা ক্রমশই আরো স্বচ্ছ-পরিস্কার হচ্ছে চীন, মার্কিন, এমন কি ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলসহ নানা ঘটনায়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
এইচআর/এএসএম