ফুটপাত আসলে কার?

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৫ মার্চ ২০২৫

ঢাকা দেশের রাজধানী, সবচেয়ে বড় নগরী এবং আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বাস। এখানে দেশের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয় ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল। অনেক বিদেশিও নানান কর্মসূত্রে আসছেন, অনেকে বাসও করছেন। সবমিলিয়ে মহা কর্মব্যস্ত এক নগরী ঢাকা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ৪০০ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক ঢাকা নগরী বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। ফলে নাগরিক সুবিধার অনেকটাই এখানে অনুপস্থিত।

আসলে পরিকল্পিত নগর বলতে বোঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। কোথায় স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা; সবই হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এতে তার নাগরিক জীবন হয় মর্যাদাপূর্ণ, গ্রাম কিংবা মফস্বলের তুলনায় উন্নততর, স্বস্তিদায়ক। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। জনজীবনকে তা বিপর্যস্ত করে ফেলে। মানুষের ভোগান্তির কোনো শেষ থাকে না।

বিজ্ঞাপন

অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠার কারণে রাজধানীর মোট দুই হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার রাস্তার অনেকাংশই আবার নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার ফুটপাতগুলো দখলে থাকায় যারপরনাই ভোগান্তির শিকার সাধারণ মানুষ। যানজটের নিগড়ে পিষ্ট মানুষের কাছে এ যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সাধারণত হকাররাই ফুটপাতগুলো দখল করে রাখে। ঈদ, নববর্ষ কিংবা অন্য কোনো উৎসব কেন্দ্র করে মৌসুমি হকারদের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। তখন আরও বেশি করে ফুটপাত দখল চলে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ফুটপাত আসলে কার? এটা কি পথচারীর নাকি দখলদারদের?

এজন্য ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত রাখা দরকার। কিন্তু ফুটপাতে হকারদের বসা না বসা নিয়ে নানা রকম মত রয়েছে। কেউ বলছেন, ছিন্নমূল এসব মানুষজনকে যদি ফুটপাত থেকে উচ্ছেদ করা হয় সেটা হবে তাদের রুটিরুজির ওপর হস্তক্ষেপ। তাই স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ হবে সম্পূর্ণ অমানবিক। বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার সমিতির তথ্য অনুসারে বর্তমানে ঢাকা শহরে ১ লাখ ৩০ হাজার হকার রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ হাজার স্থায়ী এবং ৬০ হাজার অস্থায়ী। এই পরিসংখ্যান বেশ আগের। এখন হকারের সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে নিঃসন্দেহে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সহায়সস্বলহীন এসব মানুষ ঢাকা শহরে এসে কাজের সন্ধানে হকার পেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য পুঁজিতে ফুটপাতে বসে যে কোনো ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করা যায়। পাতি মস্তান, পুলিশ, অন্যান্য চাঁদাবাজ গোষ্ঠীকে বখরা দিয়ে বাকি যে আয় থাকে তাও নিছক কম নয়। ওই দিয়েই একেকজনের আয়ে তিন-চারজনের একটি সংসার চলে।

বিপুল জনসংখ্যার ঢাকা নগরী আসলে এক বিশাল বাজার। এই বাজারে অন্তত ২৫ শতাংশ অর্থনীতি পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয় এই হকারদের মাধ্যমে। হকারদের কাছ থেকে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। কারণ তাদের দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয় না বলে পণ্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে না। ফলে এই উচ্চমূল্যের বাজারে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের লোকজন কেনাকাটার জন্য হকারদের ওপর নির্ভরশীল। এই কারণে হকারদের উচ্ছেদের ব্যাপারটি আসলে একপাক্ষিক কোনো ব্যাপার নয়। তাদের উচ্ছেদ করলে কোথায় গিয়ে তারা দাঁড়াবে, এ বিষয়টিও অবশ্যই ভাবতে হবে। এছাড়া যানজট সৃষ্টির জন্য হকারদের দায়ী করা হলেও তারা আসলে এজন্য কতটা দায়ী সেটিও ভেবে দেখতে হবে।

ঢাকার যানজটের প্রধান কারণ রাস্তার সংকট। ঢাকায় যে পরিমাণ জমি রয়েছে তার জন্য ২৫ শতাংশ রাস্তা দরকার। সেখানে অলিগলিসহ আছে মাত্র ৭ শতাংশ । মেইন রোড আছে ৩ শতাংশ । এই ৩ শতাংশের ৩০ শতাংশ দখল করে আছে দখলদাররা। যার মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে হকার। রাজধানীর ৭০ শতাংশ ফুটপাত প্রাইভেট গাড়ি দখল করে রেখেছে। ভাবতে অবাক লাগে রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তার পাশেই যেসব দোকান ও আবাসিক ভবন রয়েছে তাদের কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই। ফলে রাস্তার অর্ধেকটা তারা দখল করে গাড়ি পার্কিং করে। দিনের পর দিন এ অবস্থা চললেও এগুলো দেখার কেউ নেই। যত দোষ কেবল যেন ওই নন্দ ঘোষ; হকারদের।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যে পুলিশ হকার উচ্ছেদ করে সেই পুলিশই রাজধানীর ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারে পুলিশ বক্স স্থাপন করেছে। ফুটপাত ও রোড ডিভাইডারের ওপর এসব বক্সের কারণে লোকজনের চলাচলে মারাত্মক অসুবিধার সৃষ্টি হলেও কারও কিছু করার নেই। রাজধানীর ভাসমান হকারদের পুনর্বাসনে গত ২৫ বছরে অন্তত দুই ডজন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (এখন তো সিটি করপোরেশন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত)। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ১৯৫২ সালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৯ সালেও বাস্তবায়ন করা হয় দুটি প্রকল্প। ডিসিসির খাতাপত্রে এসব প্রকল্পের আওতায় মোট ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে।

আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কথাই বলি আর হকার পুনর্বাসনের কথাই বলি না কেন, এ দুটি কাজ করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে- এটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

রাজধানীর হকারদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নগরীর সদরঘাট এলাকায় প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ১৯৫২ সালে। ‘সদরঘাট হকার্স মার্কেট’ নামের ওই প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হয় মোট ৮১২ হকারকে। এরপর ১৯৭৯ সালে সদরঘাট এলাকায়ই হকার পুনর্বাসনের ২য় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেট নামের ওই প্রকল্পে ৬৪৫ হকার পুনর্বাসিত হয়। তারপর আশির দশকের শেষার্ধে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপকভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এভাবেই ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৮ হাজার হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। কিন্তু এত প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও নগরজুড়ে হকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, হকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার আদৌ কি কোনো শেষ আছে? আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করার কথাই বলি আর হকার পুনর্বাসনের কথাই বলি না কেন, এ দুটি কাজ করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে- এটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। একটি সমন্বিত পন্থায় এগিয়ে যেতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রসঙ্গত আমরা কলকাতা শহরের হকারদের পুনর্বাসনের নীতিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।

বিজ্ঞাপন

এই নীতিতে হকার পুনর্বাসনের ব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নেয় পৌরসভা। ‘হকার নীতি’ নামে ওই নতুন নীতিতে বলা হয়েছে-
১. পৌরসভা হকারদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। ২. নতুন কোনো হকার ফুটপাত দখল করে বসে পড়ছে কি না তা মাঝে মধ্যেই সমীক্ষা করে দেখা হবে। ৩. পৌরসভা হকারদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্প, রাষ্ট্রীয় বিমা যোজনা ইত্যাদিতে অন্তর্ভুক্ত করবে। ৪. অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু হকারদের পুনর্বাসন দিয়ে বিভিন্ন কর্মশিক্ষা, শিশু শিক্ষা প্রকল্প, জাতীয় শিশুশ্রম প্রকল্পে যুক্ত করা হবে। ৫. হকার সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষা এবং মিডডে মিল পাবে। ৬. ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। ৭. খাবার এবং আতশবাজি বিক্রি করে যারা তাদের লাইসেন্স নিতে হবে। ৮. ন্যূনতম ১৫ বর্গফুট এবং সর্বাধিক ৪০ বর্গফুট জায়গা একজন হকারের জন্য নির্দিষ্ট হবে। যেখানে সম্ভব এবং প্রয়োজন সেখানে নির্দিষ্ট অনুপাতে শহরের তফসিলি জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধী হকারদের জন্যও বিক্রির জায়গা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ৯. হকারদের বেঁধেছেদে রেখে যাওয়া দোকানের মালপত্র যাতে চুরি না যায় সেজন্য জিনিসপত্র সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হবে। ১০. কোথায় কে বসবেন তা পরিচয়পত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে কাঠামোভিত্তিক ফি নির্ধারণ করা হবে। ১১. এছাড়া হকার নিয়ন্ত্রিত ফুটপাতে কঠিন বর্জ্য অপসারণ, শৌচাগার নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগ ও পানীয়জল, বিক্রেতাদের জন্য ছাউনি এবং কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ফুটপাতেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে পৌরসভা।

১২. হকার হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য পৌরসভার নির্দিষ্ট ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদনকারীর বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। পথচারীদের জন্য হকারদের কিছু নির্দেশিকাও মানতে হবে। পথচারী চলাচলের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ ফুটপাত খালি রাখতে হবে। এছাড়া বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় পৌরসভা কর্তৃপক্ষ যে কোনো জায়গায় হকারদের বসা, বিক্রি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ রাখতে পারবে।

এই নীতি যে একটি চমৎকার এবং বাস্তবানুগ সেটি তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এর অনেক নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ। হকারদের যদি পরিচয়পত্র দেওয়া যায় তাহলে তারা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া যে কোনো সিদ্ধান্ত যেমন পুনর্বাসন বা অন্য সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেও হকারদের একটি সঠিক পরিসংখ্যান জানা থাকলে তা সহজ হবে।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া সার্বিকভাবে একটি শৃঙ্খলাও প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি উভয়পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক হবে নিঃসন্দেহে। এজন্য একটি হকার নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা গেলে বিষফোঁড়ার মতো এই সমস্যা থেকে বাঁচা যাবে। এজন্য উদ্যোগটাই জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
drharun.press@gmail.com

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।