‘অখ্যাত’ হাসপাতালে তামিমের ফেরা, দৃষ্টান্ত হোক চিকিৎসায়

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
জান্নাতুল বাকেয়া কেকা জান্নাতুল বাকেয়া কেকা , বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই এবং লেখক ও গবেষক।
প্রকাশিত: ০৮:৩৪ এএম, ২৫ মার্চ ২০২৫

মাত্র কদিন আগেই অবসর নিয়েছেন। তার আগ পর্যন্ত তামিম ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে অবসর নিলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে চলেছেন দাপটের সঙ্গে। তেমনই এক ম্যাচের মধ্যেই আচমকা হার্ট অ্যাটাক। পরিস্থিতি ও তামিমের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে নামিদামি কোনো হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়নি। গাজীপুরের একটি হাসপাতালেই চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা ও সঠিক চিকিৎসায় জীবনের গতিতে ফিরেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই ‘খান সাহেব’।

রাজধানীর অদূরের এক হাসপাতালে জরুরিভাবে তামিম ইকবালের হৃদযন্ত্রে সফলভাবে রিং তথা সেন্ট পরানো হয়েছে। এর আগে হার্ট অ্যাটাকের পর অচেতন হয়ে পড়লে তামিমকে বাঁচাতে সফলভাবে প্রাণরক্ষাকারী সিপিআর ও ডিসি সেবা দেন ডা. জামান মারুফের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক। তামিমকে তারা ঝুঁকি থেকে বাঁচিয়ে তোলেন।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসক দলের তথ্য বলছে, তামিমের বাম দিকের অন্যতম রক্তনালী শতভাগ বন্ধ হয়ে পড়ায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও রক্ত প্রবাহিত হতে পারছিল না। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। অকার্যকর হয়ে পড়ে তার শরীরের মূল রক্তনালীটি। সেই জটিল অবস্থা থেকে তাকে ফিরিয়ে এনেছেন সেই গুণী ও সাহসী চিকিৎসক ডা. জামান মারুফ। সাহসী চিকিৎসক জামান মারুফকে অভিনন্দন।

তামিম ইকবাল এখন নিজেই লাইফ সাপোর্টের ভেন্টিলেশনের বাইরে, যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই শ্বাস নিচ্ছেন! পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপা— সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জীবনে প্রাণের স্পন্দন দানের মালিক পরম সৃষ্টিকর্তা। তারপরও দেশের স্বনামখ্যাত ক্রিকেটারের হৃদযন্ত্রে সফলভাবে স্টেন্ট স্থাপন ও হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতী জটিলতার ত্বরিৎ ও সফল চিকিৎসা দিয়ে গৌরবের অংশীদার হয়েছে বলতে গেলে একদমই অপরিচিত বা অখ্যাত এক হাসপাতাল। গাজীপুর তেতুইবাড়ি, কাশিমপুরের কামপুলান পেরুতান জহর (কেপিজে) হাসপাতাল হিসেবে সাম্প্রতিক নাম দেওয়া এই হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে বঙ্গমাতা শেখ মুজিব ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে হিসেবে। এই হাসপাতালের ডা. জামান মারুফ হৃদরোগের চিকিৎসায় এক সফল নায়ক। তিনি উদ্যমী হয়ে ভিভিআইপি তামিম ইকবালের মতো রোগীকে তার জীবনের খুব মূল্যবান সময়ে সাহসের সঙ্গে সিপিআর ও ডিসির মতো জরুরি সেবা দিয়েছেন।

ডা. জামান মারুফের শিক্ষক ঢাকার জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) কার্ডিওলোজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. এম জি আজম। এক সময়ের এই শিক্ষার্থী চিকিৎসককে নিয়ে দারুণ গর্বিত ডা. এম জি আজম। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত বিকেএসপিতে প্রিমিয়ার লীগ খেলার সময় তামিম ইকবাল বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং মাঠেই বসে পড়েন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।

দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত যে কাউকে এই ‘গোল্ডেন আওয়ারে’র মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসার আওতায় আনা এক বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে হার্ট অ্যাটাকের পর আক্রান্ত জীবনকে ফের জাগাতে দরকার হয় এই দুটি চিকিৎসা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই সুযোগ থাকে না। ফলে আক্রান্তদের বেশির ভাগকেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে হৃদ্‌রোগে আক্রান্তদের সময়মতো সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) ও ডিসি (ইলেকট্রিক শক) দিয়ে অকার্যকর হৃদযন্ত্রকে সচল করা খুবই জরুরি। হার্ট অ্যাটাকের পর ঠিক যে সময়ের মধ্যে সিপিআর বা ডিসি শকের মতো জরুরি সেবা দিয়ে রোগীর মৃত্যুঝুঁকিকে কমিয়ে আনা সম্ভব, সেটিকে চিকিৎসকরা বলে থাকেন ‘গোল্ডেন আওয়ার’।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত যে কাউকে এই ‘গোল্ডেন আওয়ারে’র মধ্যে প্রাথমিক চিকিৎসার আওতায় আনা এক বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে হার্ট অ্যাটাকের পর আক্রান্ত জীবনকে ফের জাগাতে দরকার হয় এই দুটি চিকিৎসা। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই সুযোগ থাকে না। ফলে আক্রান্তদের বেশির ভাগকেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।

তামিম ইকবালের ক্ষেত্রে প্রথমত সে বিষয়টি ঘটেনি। তবে বিপদ হতে পারতো। কর্তৃপক্ষের তরফে তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। হেলিকপ্টারের তোলার পর সেটি রওয়ানা দেওয়ার আগেই আরও একবার তামিমের ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হলে তাকে ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার আর কোনো সুযোগ ছিল না। তামিম ইকবাল ভাগ্যবান, সঠিক সিদ্ধান্তে সময় নষ্ট না করে দ্রুতই তাকে কেপিজে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

এনআইসিভিডির সাবেক অধ্যাপক ও বর্তমানে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম জে আজম জানান, তামিম ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত সাভারের নবীনগরে কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কার্ডিয়াক টিম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ২২ মিনিট ধরে সিপিআর ও তিনবার ডিসি শক দেয়। এরপর এনজিওগ্রাম করলে তার রক্তনালীতে ১০০ শতাংশ ব্লক পাওয়া যায়। পরে ‘রিং’ বা স্টেন্ট পরিয়ে তার বন্ধ রক্তনালী খুলে দেওয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে হৃদরোগজনিত মৃত্যু কমাতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। এর জন্য দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও, অন্তত উপজেলা পর্যায়ে জরুরি অবস্থায় হার্ট সচল করে রোগীর জীবন রক্ষা করা ও পরবর্তী সময়ে রক্তনালীগুলোকে সচল করে রোগীকে স্থায়ীভাবে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার এ রকম অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা জরুরি। এর জন্য প্রাইমারি পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইনভেনশন (প্রাইমারি পিসিআই বা পিপিসিআই) তথা হৃদরোগের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে স্থাপন করতে হবে ক্যাথ ল্যাব, যেখানে রোগীদের এনজিওগ্রাম বা এনজিওপ্লাস্টি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে, প্রয়োজনে রোগীদের রিং বা স্টেন্টও পরানো যাবে। তখন হৃদরোগের চিকিৎসায় ঢাকার ‘ফাইভ স্টার হাসপাতালে’র ওপর নির্ভরশীলতাও কাটবে।

গাজীপুরের কেপিজে হাসপাতালে সিপিআর ও ডিসি শক দিয়ে দেওয়ার পর তামিম ইকবালের সংজ্ঞা ফিরলে তার এনজিওগ্রাম করাতে হয়, এনজিওপ্লাস্টির মাধ্যমে স্টেন্টও পরানো হয়। আগেই বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে দ্বিতীয়বার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের পর তামিমের শরীর এতটাই নাজুক ছিল যে তাকে হেলিকপ্টারে করেও ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। ওই সময় কেপিজে হাসপাতালে তার চিকিৎসার এসব সুবিধা না থাকলে শেষ পর্যন্ত কী হতো, বলা মুশকিল।

ঢাকায় উড়িয়ে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে যখন তাকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হতো, তখন তিনি চিকিৎসার ঊর্ধ্বেই উঠে যেতেন কি না, রয়েছে সে প্রশ্নও। তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাতেই যে তামিম বেঁচে ফিরেছেন, সেটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই কারও। আপাতত তামিমের জন্য দ্রুত সম্পূর্ণ সুস্থতা কামনা করছি।

বিজ্ঞাপন

আবার এসব সুবিধা সত্ত্বেও তামিম ইকবালের মতো একজন ভিভিআইপি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়াটা বাংলাদেশের বাস্তবতা বিচারে সহজ নয়। সেখানে ডা. জামান মারুফ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যেভাবে তামিমকে জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা দিয়েছেন, তার জন্য তাকে অজস্র অভিনন্দন। একইভাবে বাংলাদেশে হৃদরোগের চিকিৎসায় নিবেদিত যারা, তাদের প্রতিও জানাই কৃতজ্ঞতা।

চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে জরুরি সময়ে দূরের ‘ফাইভ স্টার হাসপাতালে’ দৌড়ানোর জন্য মরিয়া হওয়া যাবে না। বরং জীবন রক্ষার ‘গোল্ডেন আওয়ার’ কাজে লাগাতে হবে। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু শুধু চিকিৎসকের কাছে গেলে তো হবে না, চিকিৎসা দেওয়ার মতো যোগ্য চিকিৎসক এবং তার জন্য অবকাঠামো সুবিধাও থাকতে হবে।

তাই কর্তৃপক্ষের কাছে নিবেদন, তামিম ইকবালের ঘটনাকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে নিন। শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে উপজেলা পর্যায়েও হৃদরোগের চিকিৎসাকে ছড়িয়ে দিন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ক্যাথল্যাব গড়ে তুলুন, নিয়োগ দিন দক্ষ জনবল। তাহলে উপজেলাতেও আচমকা হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে আর চিকিৎসার জন্য শহরে নিতে নিতে প্রাণ হারাতে হবে না।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বব্যাপী হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকজনিত মৃত্যু কমাতে উন্নত দেশের পাশাপাশি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোও নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগা বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে তারা নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত হৃদরোগেও আক্রান্ত। জানা যায় তখনই, যখন কেউ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়। ততক্ষণে তার মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

এই ঝুঁকি কমিয়ে রোগীর জীবন রক্ষা করে মৃত্যুর হার কমানো এবং পক্ষাঘাতে আক্রান্ত কষ্টের জীবন ঠেকানোকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে থাকেন চিকিৎসকরা। এর জন্য যে কেউ আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে জীবন রক্ষায় চিকিৎসকদের কাছে গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে রোগীর জন্য ‘প্রাইমারি পিসিআই’ বা ‘পিপিসিআই’ সেবা নিশ্চিত করায় দায় রাষ্ট্রের রয়েছে। সেই দায় পূরণে এগিয়ে আসুক রাষ্ট্র— চাওয়া এটুকুই।

পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন করতে হবে। এর জন্য ‘সাইলেন্স সেভ আ লাইফ’ নামে বিশ্বব্যাপী একটি কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশও ওই কর্মসূচির সঙ্গে একান্ত হয়েছে। এই কর্মসূচির অধীনে সবাইকে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে শোরগোল না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোগীকে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সচেতন করে তোলা হয়। এই কর্মসূচিকেও ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্র, চিকিৎসক ও নাগরিক সবাই মিলে একাত্ম হলে নীরব ঘাতক নামে পরিচিত হার্ট অ্যাটাকের কারণে মৃত্যুঝুঁকিকে কমিয়ে আনা সম্ভব নিশ্চয়ই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।