১৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে তিন কোটি সাশ্রয়!

প্রকল্পটি ছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকার। তিন দফা ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। সেই টাকা থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
বলছিলাম ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্পের কথা। সাশ্রয়ের জন্য ১৯০.৪ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে ১৬৩ কিলোমিটার থেকে সোলার বাতি বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে ল্যান্ডস্কেপিং ও স্লোপ টার্ফিংয়ের কাজ। এর পরিবর্তে নিরাপদ সড়ক পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ ও ফেন্সিংয়ের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
উত্তরবঙ্গে শিল্প কারখানা প্রসারসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়নে ‘সাসেক সড়ক সংযোগ প্রকল্প-২: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ’ প্রকল্প নেওয়া হয়। রংপুর থেকে বুড়িমারি ও বাংলাবান্ধা হয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মহাসড়কটি। ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ করতে ১৯০ কিলোমিটার সড়কটি চার লেনে রূপ দেওয়া হচ্ছে।
আরও পড়ুন
- সহসাই স্বস্তি মিলছে না রংপুরবাসীর, ফের ব্যয়-মেয়াদ বাড়ছে ফোরলেনে
- উন্নয়নে মন্থর গতি, সংশোধিত এডিপিতে কমছে ৫০ হাজার কোটি টাকা
- ‘শুধু ভারতীয় ঠিকাদার কাজ করবে’ নীতির পরিবর্তন চায় বাংলাদেশ
- এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন: ৬ বছর চলার পর বদলাচ্ছে প্রকল্প
বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর করা হয়। নতুন করে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
২০১৪ সালে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলেও তা একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। ২০২১ সালের আগস্টের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয় ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এরপর কাজ শুরুতে দেরি, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা ও করোনা মহামারির কারণ দেখিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় প্রকল্পটির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর করা হয়। নতুন করে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে চলছে উন্নয়নকাজ/ফাইল ছবি
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পনা কমিশনের গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার আলোকে ১৯০ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সম্পূর্ণ রাস্তার পরিবর্তে কেবল প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশে বা স্থানে সোলার বাতি স্থাপন করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়ক বাঁক, গুরুত্বপূর্ণ ওভারপাস ও সেতু এবং বাজার এলাকায় সোলার বাতির সংস্থান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ২৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার, যা সম্পূর্ণ সড়কের ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ মাত্র। সড়ক বাতি থাকবে না ১৬৩ কিলোমিটার অংশে।
আরও পড়ুন
- মেঘনা নদীতে ঝুলন্ত সেতু-হাওরের উড়াল সড়ক প্রকল্প বাতিল হচ্ছে
- সাড়ে ২৯ কোটি টাকার সমীক্ষা, ৯৭ শতাংশই যাবে পরামর্শকের পকেটে!
- দুর্নীতির ফাঁদে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, কাজ ছাড়াই গায়েব ৭ কোটি টাকা
- তিন দেশ সংযোগকারী সাসেক প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি
সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নিরাপদ সড়ক পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ ও ফেন্সিংয়ের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রকল্প ব্যয় দুই কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে।
নির্দেশনা মোতাবেক আলংকারিক বা বিলাসী খাত (যেমন ল্যান্ডস্কেপিং, স্লোপ টার্ফিংয়ের কাজ) বাদ দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নিরাপদ সড়ক পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজ ও ফেন্সিংয়ের কাজ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে প্রকল্প ব্যয় দুই কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা সাশ্রয় হবে। এতে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৩ কোটি টাকা।
সওজের দাবি, প্রকল্পের আওতায় ১৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১৭০ কিলোমিটার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে সড়কের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হবে। বাকি এক বছর সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাখা হবে।
‘চলতি বছরের ডিসেম্বরেই সড়কের শতভাগ কাজ সমাপ্ত হবে। তবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা হাতে এক বছর রাখবো। ১৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭০ কিলোমিটার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। প্রকল্পের মোট কাজের ৮০ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে।’- প্রকল্প পরিচালক ড. ওয়ালিউর রহমান
প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করছেন ড. ওয়ালিউর রহমান। প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় খাত বাদ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় পুরো সড়কে সোলার সড়কবাতি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এগুলো বাদ দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সড়ক বাতি স্থাপন করা হবে। বাস শেডসহ কিছু আলংকারিক কাজ ধরা হয়েছিল, চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের প্রায় তিন কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। এছাড়া সড়কের ল্যান্ড স্কেপিংসহ কিছু আলংকারিক কাজ বাদ গেছে।’
আরও পড়ুন
- শেষ সময়েও ঘাস চাষ শিখতে বিদেশ যাওয়ার বায়না
- নিম্নমানের মালামাল, ৯২ কোটির ডাক ভবন তিন বছরেই বেহাল
- এলেঙ্গা-রংপুর চারলেন প্রকল্পে ৩৪০০ কোটি ঋণ দিল এডিবি
- স্বপ্নের চার লেন প্রকল্প: ৬ বছরে অগ্রগতি ৪৩ ভাগ
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে এমন প্রশ্নে ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘চলতি বছরের ডিসেম্বরেই সড়কের শতভাগ কাজ সমাপ্ত হবে। তবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমরা হাতে এক বছর রাখবো। ১৯০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭০ কিলোমিটার কাজ সমাপ্ত হয়েছে। প্রকল্পের মোট কাজের ৮০ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে।’
এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে চলছে উন্নয়নকাজ/ফাইল ছবি
সওজ জানায়, নানান কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বেড়েছে। ভূমি অধিগ্রহণে ব্যয় বৃদ্ধি, আন্তঃমন্ত্রণালয় ভূমি অধিগ্রহণ, পকেট ভূমি অধিগ্রহণ, জমির শ্রেণি পরিবর্তনজনিত কারণে মেয়াদ বেড়েছে। প্রকল্পের ইউটিলিটি বাবদ ব্যয় বাড়লেও কমছে পুনর্বাসন খরচ। পরামর্শক সেবার ব্যয় কমানো, সম্পদ সংগ্রহের ব্যয় কমানো, ভ্যাট সমন্বয়, মূল্য সমন্বয়ে ব্যয় কমানো, রোড রিসার্চ-ট্রেনিং সেন্টার, টোলপ্লাজা ও এক্সেল লোডসহ রোড অপারেশন ইউনিট নির্মাণ, হাটিকুমরুল ইন্টারচেঞ্জের ভায়াডাক্ট ও সার্ভিস লেনে কংক্রিটের কাজের জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়েছে।
পেভমেন্ট নির্মাণে ব্যয় বৃদ্ধি, নতুন খাত অন্তর্ভুক্তি
সড়কধার ও সড়ক ডিভাইডারে বৃক্ষরোপণ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় লাইটিং, সেফটি ফার্নিচার ও যাত্রী ছাউনি অন্তর্ভুক্ত করায় প্রকল্পের একটি প্যাকেজে সরকারি খাতের ব্যয় বেড়েছে ৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এছাড়া কোড সংশোধন, বেতন-ভাতা ও পরিবেশ ছাড়পত্র ফি’র জন্য সময় এবং ব্যয় দুটোই বেড়েছে।
আরও পড়ুন
- ২০২৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হবে সোনালি ব্যাগ, ব্যয় শত কোটি
- বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নিজেরা ভাঙে বেতার, ঠিকাদারের বকেয়া ১৯ কোটি!
- অপেক্ষা ফুরোচ্ছে না রংপুরবাসীর
- মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে ফের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহায়তায়। তবে প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধিত ডিপিপিতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪৩০ কোটি টাকা কমেছে। প্রস্তাবনায় মাটি ভরাটের কাজের ব্যয় ৫৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া মূল্য সমন্বয় ও কনটিনজেন্সি ব্যয় ৮৭২ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি পেভমেন্ট নির্মাণব্যয় ১৫০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং স্ট্রাকচার নির্মাণব্যয় বাড়ানো হয় ৩৪৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ মোট ৩২৬ হেক্টর অপরিবর্তিতে রেখে আন্তঃমন্ত্রণালয় ভূমি অধিগ্রহণ, পকেট ভূমি অধিগ্রহণ, জমির শ্রেণি পরিবর্তনজনিত কারণে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে পূর্বানুমোদন করা ৩৩৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকাসহ মোট ৮১৬ কোটি টাকা বেড়েছে।
আরও পড়ুন
পরিকল্পনা কমিশন আরও জানায়, প্রকল্পের আওতায় ১৯০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার পেভমেন্ট নির্মাণে ১৭০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে চার হাজার ৮০৬ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রকল্পে ১৪ হাজার ৯৬৬ মিটার ফাউন্ডেশনসহ স্ট্রাকচার খাতে ৩৬৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনসহ স্ট্রাকচার খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। রোড অপারেশন ইউনিট খাতে ১১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২১৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নতুন খাত হিসেবে রোড ফার্নিচার, স্ট্রেট লাইটিং, বৃক্ষরোপণ, ফেন্সিং (বেড়া) প্রভৃতি উল্লেখ করে জিওবি খাতে ৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়।
এমওএস/এমএএইচ/এমএমএআর/এমএস