দেশের ভূখণ্ড রক্ষায় অটল দুই ‘সেরাদের সেরা’
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন তারাছা। সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গম পাহাড়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন নুখিংসাই মারমা। কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও পড়াশোনা বন্ধ করেনি তার বাবা-মা। সীমান্তে বাড়ি হওয়ায় শৈশব থেকে নুখিংসাই মারমা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দেখেছেন খুব কাছ থেকে। সেই শৈশবের স্বপ্ন বিজিবিতে যোগ দেওয়ার।
বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় নারী সৈনিক হিসেবে নুখিংসাই পড়াশোনা চালিয়ে ঠিকই যোগ দেন স্বপ্নের পেশায়। বিজিবিতে যোগদানের পর টানা ছয় মাস হাড়ভাঙা ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। বিজিবির ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের নারী সৈনিক হিসেবে সমাপনী কুচকাওয়াজে ৪৬ জন নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছেন নুখিংসাই।আদিবাসীদের মধ্যে বিজিবিতে প্রথমবার শ্রেষ্ঠ নুখিংসাই মারমা।
দুর্গম পাহাড়ে কৃষক পরিবারের মেয়ে হয়েও কীভাবে এতদূর এলেন নুখিংসাই মারমা? তার পেছনের গল্প বলছেন তিনি।
জাগো নিউজ: বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব কত ছিল?
নুখিংসাই মারমা: বাসা বান্দরবানের তারাছায়। পাহাড়ি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করায় মেয়ে হয়ে পড়ালেখা করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। বাড়ি থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছে। কোচিং-প্রাইভেটও ছিল না।
জাগো নিউজ: বিজিবিতে কেন এলেন?
নুখিংসাই মারমা: শৈশব থেকেই বিজিবির প্রতি আকর্ষণ ছিল। পুরুষ সদস্যরা বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে কাজ করলে নারীরা কেন নয়। সেই থেকে নারী সদস্য হিসেবে বিজিবিতে যোগদানের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো।
পুরুষ সদস্যরা বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে কাজ করলে নারীরা কেন নয়। সেই থেকে নারী সদস্য হিসেবে বিজিবিতে যোগদানের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তব। বাংলাদেশের ভূখণ্ড রক্ষার্থে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো।-নুখিংসাই মারমা
জাগো নিউজ: বিজিবিতে যোগদানে কারা উৎসাহ যুগিয়েছে?
নুখিংসাই মারমা: তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট আমি। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী। বিজিবিতে আসার পেছনে পরিবারের সবার সাপোর্ট ছিল। মা-বাবা অনেক কষ্ট করে বান্দরবান শহরে এনে পড়াশোনা করিয়েছেন।
জাগো নিউজ: বিজিবিতে যোগদানের পর গ্রামের মানুষের মনোভাব কেমন দেখেছেন?
নুখিংসাই মারমা: আমাদের গ্রামের মেয়েরা খুব বেশি শিক্ষিত না। তারা খুব বেশি পড়ালেখাও করতে পারে না। স্কুলজীবন থেকেই বিয়ে হয়ে যায় বেশিরভাগ মেয়ের। আমি বিজিবিতে যোগদানের পর গ্রামের মানুষ অনেক খুশি। আমি তাদের কাছে একজন গর্ব। আমার দেখাদেখি যেন পাহাড়ি গ্রামের সব মেয়েরা চ্যালেঞ্জ নিতে শেখে এবং পড়ালেখা শেষ করে কর্মে যোগ দেয়।
জাগো নিউজ: টানা ছয় মাস ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
- আরও পড়ুন
- বিজিবির ১০২তম রিক্রুট ব্যাচে শপথ নেবেন ৬৯৫ সৈনিক
- ভারতে সীমান্ত সম্মেলন নিয়ে যা জানালো বিজিবি
- সাহসিকতা ও বীরত্বে পদক পাচ্ছেন বিজিবির ৭২ সদস্য
নুখিংসাই মারমা: বিজিবিতে ট্রেনিং পর্যন্ত আসতে পেরে আনন্দ এবং ভয় দুটোই কাজ করছিল। তবে মনে মনে সংকল্প করেছিলাম যে কোনোভাবে হোক ট্রেনিং শেষ করে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে। সেই সংকল্প থেকে ট্রেনিং করতে কোনো সমস্যা হয়নি। সবাই জানেন ট্রেনিং মানে কষ্ট, কিন্তু ট্রেনিং কষ্ট করে না নিয়ে মনের আনন্দে নিয়েছি। ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষকেরা খুবই আন্তরিক ছিলেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
এদিকে ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের ৬৯৫ জনের মধ্যে সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করেন মো. নাঈম মন্ডল। নাঈম মন্ডলের সঙ্গেও কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের।
জাগো নিউজ: ৬৯৫ জনের মধ্যে প্রথম হওয়ার অনুভূতি কেমন?
নাঈম মন্ডল: বিজিবির নবীন সৈনিক হিসেবে শপথগ্রহণ করে এই বাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। ৬৯৫ জনই সেরা। সেরাদের ভেতর থেকে সেরা হওয়াটা অনেক কষ্টের ছিল। ট্রেনিং আমার জন্য ভালো ছিল। ট্রেনিং সেন্টারের সব ট্রেইনার ভালো ছিলেন, তারা সব সময় সহযোগিতা করেছেন।
জাগো নিউজ: পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
নাঈম মন্ডল: আমার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর থানায়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ডিফেন্সের সদস্য হওয়ার। বিজিবিতে যোগদানের বিষয়ে বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল। আজ বিজিবির একজন সদস্য হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
ট্রেনিংয়ে প্রথমবার ফায়ারিংয়ের অভিজ্ঞতা সত্যিই অন্যরকম। কখনো অস্ত্র হাতে নেইনি। ট্রেনিংয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রথমবার গুলির অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ভালো ছিল।-নাঈম মন্ডল
জাগো নিউজ: প্রথম ফায়ারিংয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
নাঈম মন্ডল: ট্রেনিংয়ে প্রথমবার ফায়ারিংয়ের অভিজ্ঞতা সত্যিই অন্যরকম। কখনো অস্ত্র হাতে নেইনি। ট্রেনিংয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রথমবার গুলির অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ভালো ছিল।
জাগো নিউজ: দুর্গম সীমান্তে শত্রুদের মোকাবিলায় অস্ত্র হাতে আপনার ভূমিকা কী থাকবে?
নাঈম মন্ডল: বিজিবির একজন গর্বিত সৈনিক হিসেবে সব ধরনের ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেছে। আমি দেশের ভূখণ্ড রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে প্রথম স্থান অধিকারী বক্ষ নম্বর-১৯৩ রিক্রুট (জিডি) মো. নাঈম মন্ডল এবং অন্য বিষয়ে সেরা সৈনিকদের হাতে তাদের সফলতার জন্য ক্রেস্ট তুলে দেন।
১০২তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ গত ৩০ জুলাই বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজে (বিজিটিসিঅ্যান্ডসি) শুরু হয়। প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে সর্বমোট ৬৯৫ জন রিক্রুটের মধ্যে ৬৪৯ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে।
দীর্ঘ ২৩ সপ্তাহের অত্যন্ত কঠোর ও কষ্টসাধ্য এ প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ ও সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে তাদের সৈনিক জীবনের শুভ সূচনা হলো।
টিটি/এএসএ/এএসএম