সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়ছে অপতথ্য, ড. ইউনূস-শেখ হাসিনাকে নিয়ে বেশি
• অপতথ্য ছড়ানোর হার ক্রমেই বাড়ছে
• অপতথ্য ঠেকানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
• রাজনৈতিক-ধর্মীয় অপতথ্যে বড় শঙ্কা
• অংশীজনদের সক্রিয়-সচেতনতা জরুরি
গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ মাধ্যম। ফেসবুক-টুইটারে যে কোনো বিষয়ে পোস্ট দিলে অধিকাংশ মানুষ সেটা প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করে। এটাই বাস্তবতা। পরে ফ্যাক্টচেকিং শুরু হলে সহজে সামনে আসা শুরু করে সত্য-গুজবের পার্থক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়ানো গুজবের সিংহভাগই রাজনৈতিক।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। আগে ফেসবুকে শেখ পরিবারের সদস্যদের ছবিতে ‘হা হা রিঅ্যাক্ট’ দিলেও মামলার নজির রয়েছে অহরহ। ছিল না সরকার, দল বা সরকারের ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে সমালোচনা করার স্বাধীনতা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অবাধে কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দেয়। বন্ধ করে দেয় সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা নেওয়া।
পাশাপাশি আইনটির ‘কালো’ যতগুলো ধারা ছিল, তা বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ সংশোধন করে তৈরি করা ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া করেছে সরকার। তাতে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। সেখানে সমালোচিত অনেকগুলো ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
সমালোচনা যেমন নিতে হবে, তেমনি সরকারকে অপতথ্য ঠেকাতেও তৎপর থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। তবে সেটা যেন কোনোভাবে নিপীড়নমূলক না হয়।- সুমন আহমেদ সাবির
পরিস্থিতি বিবেচনায় তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্টদের অভিমত—বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া এখন কার্যত ‘নিয়ন্ত্রণমুক্ত’। শুধু সামাজিক মাধ্যমগুলোর কমিউনিটি গাইডলাইন মেনে যে কেউ মনের কথা লিখতে পারছেন, শেয়ার করতে পারছেন। সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবার সমালোচনা করার সুযোগ পাচ্ছেন নেটিজেনরা। এই সুযোগে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা, ভিত্তিহীন অপতথ্য, গুজব- যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যতগুলো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মধ্যে ভুয়া খবর বা অপতথ্য ঠেকানো অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকার এক্ষেত্রে অনীহা দেখালে সাইবার অপরাধ যেমন বাড়তে পারে, তেমনি দেশে ফের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে কার্যকর ও গঠনমূলক পদক্ষেপ জরুরি বলেও মনে করেন তারা।
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার
অন্তর্বর্তী সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ না করার নীতিগত সিদ্ধান্তে অটল। কিন্তু গত সাড়ে তিন মাসে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে।
‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে অপতথ্যের প্রবাহের পরিসংখ্যান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশের তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। ৮ আগস্ট থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ৮৯৬টি ‘অপতথ্য’ শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার।
তাদের প্রতিবেদন তথ্যানুযায়ী, ১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে অপতথ্য শনাক্ত করা হয় ৯৯টি। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নামে ছড়ানো অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে ৯০টি। তাছাড়া রিউমার স্ক্যানার সবচেয়ে বেশি ২৭৬টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে সেপ্টেম্বরে। আগস্টে (৮-৩১ আগস্ট) শনাক্ত হয় ২৪৬টি অপতথ্য। অক্টোবরে ২১৬টি, নভেম্বরে (১-১৫ নভেম্বর) ১৫৮টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
- আরও পড়ুন
গোপালগঞ্জ ঘিরে রাতভর গুজব
সামাজিক মাধ্যমে গুজব প্রতিহতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশ
সেন্টমার্টিন নিয়ে প্রতিনিয়ত গুজব ছড়ানো হচ্ছে
রিউমার স্ক্যানারের ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসের প্রতিবেদনে এক হাজার ৩৮০টি ভুয়া বা অপতথ্য শনাক্তের কথা জানানো হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ২২৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ১৭১টি, মার্চে ২৫৭টি, এপ্রিলে ২৪৪টি, মে মাসে ২৫৩টি এবং জুনে ২২৯টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছিল। এছাড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে উত্তাল মাস জুলাইয়ে ১০৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছিল তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানটি।
সেই হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগের তিন মাসে (মে, জুন ও জুলাই) ৫৮৭টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু ৮ আগস্ট থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১০০ দিনে (তিনমাসের কিছু সময় বেশি) অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে ৮৯৬টি। স্পষ্টই আগের তিনমাসের চেয়েও পরের তিনমাসে অপতথ্যের সংখ্যা বেড়েছে।
এছাড়া ২০২২ সালে ১ হাজার ৪০০টি, ২০২৩ সালের পুরো বছরে ১ হাজার ৮২টি অপতথ্য শনাক্ত হয়। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে বছরের দেড় মাস বাকি থাকতেই (১৫ নভেম্বর পর্যন্ত) ২ হাজার ৩৮১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার, যা বিগত দুই বছরের দ্বিগুণ।
দেশে ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়া চলছে। কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে। তাদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। নিজ নিজ দলের পক্ষে যায় এমন সব তথ্য তারা চোখ বন্ধ করে শেয়ার করবে। ফলে স্পষ্টই রাজনৈতিক অপতথ্য বাড়বে। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প নেই।- অধ্যাপক ড. জেরিনা বেগম
ক্ষমতাসীনদের নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে সব সময় চক্র কাজ করে বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা ক্ষমতাসীন, তাদের দিকে মানুষের ফোকাস বেশি থাকে। তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন আসে, তা বাছ-বিচার না করে শেয়ার দেওয়ার প্রবণতা থাকে। কারণ ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে নিশ্চয়ই কোনো পক্ষ থাকে। তারা এক্ষেত্রে বেশি তৎপর থাকে।’
রাজনৈতিক বিষয়ে অপতথ্য ঠেকাতে করণীয় কী—এমন প্রশ্নে সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘সমালোচনা যেমন নিতে হবে, তেমনি সরকারকে অপতথ্য ঠেকাতেও তৎপর থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। তবে সেটা যেন কোনোভাবে নিপীড়নমূলক না হয়।’
রাজনৈতিক অপতথ্য
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে। তাদের অনেকে সাইবার বিষয়ে তৎকালীন সময়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। আত্মগোপনে থেকে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে নেটিজেনদের বিভ্রান্ত করছেন। শুধু যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে তা নয়, দেশে ভালো অবস্থানে থাকা বড় রাজনৈতিক দলগুলোও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ছড়ানো ভুয়া তথ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজনীতি নিয়ে। শনাক্ত প্রায় ৯০০ অপতথ্যের মধ্যে ২৮৮টি রাজনৈতিক ইস্যুতে, অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ অপতথ্য রাজনীতিনির্ভর। রাজনীতি ঘিরে এ অপতথ্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আগস্টে সরকার পতনের পর সে মাসে অপতথ্য কম শনাক্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্রমে তা বেড়েছে। অক্টোবর ও নভেম্বরের প্রথম অংশে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অপতথ্যের হার বেশি দেখা গেছে রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে।
সামনের দিনে এ রাজনৈতিক অপতথ্য আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজির (আইআইটি) অধ্যাপক ড. জেরিনা বেগম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়া চলছে। কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার বাইরে। তাদের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। নিজ নিজ দলের পক্ষে যায় এমন সব তথ্য তারা চোখ বন্ধ করে শেয়ার করবে। ফলে স্পষ্টই রাজনৈতিক অপতথ্য বাড়বে। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প নেই।’
যেসব ক্ষেত্রে ‘অপতথ্য’ ছড়ানোর শঙ্কা বেশি
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে রাজনীতির পর জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে বেশি অপতথ্য ছড়িয়েছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পাতাকা, জাতীয় সংগীত, সেন্টমার্টিন নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। জাতীয় ইস্যুতে ভুল তথ্য ছড়িয়েছে ২৫১টি। আগামীতেও স্পর্শকাতর এ ইস্যুগুলো নিয়ে অপতথ্য ছড়ানোর অপচেষ্টার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
- আরও পড়ুন
গুজব আসবে, আমাদের কাছে তথ্য আছে: জননিরাপত্তা সচিব
কাল সারারাত ছিল গুজবের রাত
সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের ছড়াছড়ি, করণীয় কী?
গুজব নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ লিখলেন ‘সোর্স: চালাইদেন’
গত তিনমাসে ধর্মীয় ইস্যুতে ৭৮টি বড়োসড়ো অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। ধর্মীয় বিষয় ছাড়া সাম্প্রদায়িক বিষয়েও ৮৪টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। পাহাড়ে সংকট নিয়ে ১৮টি, শহীদ নূর হোসেন দিবস ঘিরে ১৭টি, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ নিয়ে ১৬টি, অক্টোবরের দুর্গাপূজা নিয়ে ১৫টি অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমার স্ক্যানার। স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে আগামী বছর ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা বেশি। এ ইস্যুতে সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া শিক্ষাখাত নিয়ে অপপ্রচারের কাটতি বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশের প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক, তাদের পরিবার-পরিজন, সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার শিক্ষাখাতে সজাগ নজর রাখে। ফলে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট যে কোনো ‘তথ্য-উপাত্ত’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করলেই দ্রুত নেটিজেনদের নজরে পড়ে। তাছাড়া বিনোদন ও খেলাধুলার জগতের তারকাদের নিয়েও অপতথ্য ছড়াতে সক্রিয় সাইবার অপরাধীরা।
অপতথ্য ছড়ানোদের টার্গেটে যারা
৫ আগস্টের পর ছড়ানো অপতথ্যগুলোতে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন নেতা বেশি বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। তাদের ঘিরে বেশি অপতথ্য ছড়াচ্ছে প্রতিপক্ষ। তবে বাদ যাচ্ছেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরাও।
তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ৮ আগস্ট থেকে ১৫ নভেম্বর সময়ের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭২টি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। তারপরের টার্গেটে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সারজিস আলম। তার নামে ২৪টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর নামে ১৮টি, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নামে ১৫টি, উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নামে ১৫টি, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নামে ১৫টি, উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নামে ৮টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নামে শনাক্ত অপতথ্যের সংখ্যা ১১টি।
তাছাড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ৪৭টি, বাংলাদেশ পুলিশের নামে ১৬টি, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নামে ৫টি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নামে দুটি ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নামে একটি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়।
অপতথ্য রুখতে তিন অংশীজনের সতর্কতা জরুরি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবস্থাপনার প্ল্যাটফর্ম নেপোলিয়নক্যাটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারী ৬ কোটি ৭১ লাখ ৭৯ হাজারেরও বেশি। টিকটকে সক্রিয় সাড়ে ৪ কোটি ব্যবহারকারী। ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ৭৫ লাখ, লিঙ্কডইনে ৯৭ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে বাংলাদেশের। ফলে দেশের ৬৫ শতাংশের মতো নাগরিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়।
বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী থাকলেও তাদের অধিকাংশেরই নেই ডিজিটাল লিটারেসি। তারা দায়বদ্ধতা ও পরিণাম সম্পর্কেও অবগত নয়। ফলে চোখের সামনে চটকদার কিছু পেলেই শেয়ার করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক মাধ্যম যৌক্তিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ।
বিগত সময়ে যে অধিকার হরণ করা হয়েছিল, আমরা সেই পথে হাঁটবো না। সেটা কল্যাণকরও নয়। নিয়মের মধ্যে থেকে দায়বদ্ধতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।- বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী
বাংলাদেশে বিপুল ব্যবহারকারীর বড় বাজার থাকায় কমিউনিটি গাইডলাইনের ক্ষেত্রেও সামাজিক মাধ্যমগুলো ছাড় দেওয়ায় অপতথ্য বেশি ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন তথ্যপ্রযুক্তি ও সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মাঈনুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের বড় অংশেরই ডিজিটাল লিটারেসি নেই। তারা সচেতন নয়। কোনটা সঠিক ও কোনটা অপতথ্য তা যাচাইয়ে ব্যবহারকারীরা সক্ষম নন। আবার যারা শিক্ষিত এবং জানাশোনা ভালো, তারাও অসৎ উদ্দেশে জেনে-বুঝে অপতথ্য ছড়াচ্ছেন। ফলে ক্রমে সাইবার জগৎ অনিরাপদ হয়ে পড়ছে।’
সাইবার সুরক্ষা আইনে পরিবর্তন আনায় এ প্রবণতা আরও বাড়ছে কি না, এমন প্রশ্নে অধ্যাপক বি এম মাঈনুল হোসেন বলেন, ‘আইন দিয়ে আপনি সাইবার জগৎ নিরাপদ করতে পারবেন না। আপনাকে সচেতন করার পথে হাঁটতে হবে। ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল লিটারেসির আওতায় আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান এসব নিয়ে কাজ করছে, তাদের তৎপর হতে হবে। কোনো অপতথ্য ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাতে রিপোর্ট করতে হবে।’
‘একই সঙ্গে যে প্ল্যাটফর্মে তা ছড়াচ্ছে, তারা যেন সরকারকে দ্রুত রেসপন্স করে তা নিশ্চিত করতে হবে। সবশেষ দায়টা হলো- ওই প্ল্যাটফর্মের মানে ফেসবুক, টুইটার, টিকটক, ইনস্টাগ্রামসহ যেগুলো আছে। তাদের গাইডলাইন মেনে চলতে হবে। অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, এমন কিছু যাতে তারা ডাউন করে, সেটা নিশ্চিত করলে অনেকাংশ সাইবার অপরাধ কমানো সম্ভব’ বলে মনে করেন এ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত সময়ে যে অধিকার হরণ করা হয়েছিল, আমরা সেই পথে হাঁটবো না। সেটা কল্যাণকরও নয়। নিয়মের মধ্যে থেকে দায়বদ্ধতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ানোর কাজ যেমন চলছে, একই সঙ্গে মেটা, টিকটক, ইউটিউবসহ সব প্ল্যাটফর্মকেও তাদের দায়বদ্ধতার জায়গাটুকু যাতে মেনটেইন করা হয়, তা নিয়ে বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছি। এক কথায় অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ নয়, অপতথ্য ও অপরাধ ঠেকাতে মধ্যস্থতার কাজে নজর দেবে বিটিআরসি।’
এএএইচ/এএসএ/জেআইএম