থার্টি ফার্স্ট ঘিরে উদ্বেগ
আতশবাজি-ফানুস এবারও নিষিদ্ধ, থেমে নেই বিক্রি
• ৭ বছর বায়ুমান সূচক ৫০, শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবল অতিক্রম করছে
• আতশবাজি ফোটানো-ফানুস ওড়ালেই জেল-জরিমানা
• মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারে ফানুস পড়ে হচ্ছে ক্ষতি
• মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণে মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদসহ প্রকৃতিতে প্রভাব
• এবারও কঠোর নির্দেশনা, নিয়ম ভাঙলেই ব্যবস্থা: পুলিশ
ইংরেজি বর্ষবরণের রাতে আতশবাজির বিকট শব্দে ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছিল চার মাস বয়সী শিশু তানজিম উমায়ের। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি শিশুটি। সকাল থেকে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।
২০২২ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের রাতের ঘটনাটি সবার মনে থাকার কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় এ ঘটনায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিবারের মতো পরের দুই বছরও আতশবাজি ফোটানো-ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করে। তবে ‘নিষিদ্ধ ঘোষণা’ পর্যন্তই শেষ।
২০২৪ সালের প্রথম প্রহরও ঢাকার আকাশ ফানুসে ছেয়ে যায়। ওই রাতে বাসার ছাদে ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে তিনজন দগ্ধ হন। একটি শিশু মারাও যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেট্রোরেলের লাইন।
ফানুসের আগুনে নিহত শিশু সিয়ামের বাবা স্বপন বেপারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেলের আবদার পূরণ করতে ফানুস কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সেই ফানুসই কাল হবে ওর জীবন আগে ভাবিনি। এভাবে যেন আর কারও সন্তান পুড়ে মারা না যায়। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করবো আবদার পূরণ করতে আপনার সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন না।’
নিষেধাজ্ঞা থাকে, মানে না-মানায় না কেউ
প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো, ফানুস ওড়ানো একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের নানান বাধা-নিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউই। এর অন্যতম কারণ, বেশির ভাগ মানুষই জানে না আতশবাজি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। আইনশৃঙ্খল বাহিনীকেও কখনো বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি।
২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি)। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছিল ঢাকায় বসবাসরত মানুষের বাসাবাড়ির ছাদও। কিন্তু তাতেও থামিয়ে রাখা যায়নি উদযাপন। আতশবাজি আর ফানুসে ভরপুর ছিল গত কয়েক বছর ঢাকার আকাশ। একযোগে পটকা, আতশবাজি ফোটানোও থেমে ছিল না। বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা মহানগরী। অনেক শিশু ও বয়স্করা সে শব্দে অসুস্থ পর্যন্ত হওয়ার খবর মেলে। ফানুসের আগুন ছিটকে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় আগুন লেগে ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক ফানুস মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারের ওপর গিয়ে পড়ে। দুর্ঘটনা রোধে দুই ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয় মেট্রোরেল চলাচল।
এতসব ঘটনার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ ছিল না। মানুষের সচেতনতা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও শুধু ঘোষণা দিয়ে দায় সারতে পারে না।
গোপনে দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফানুস-আতশবাজি, দাম বেশি
গতবারের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকবে বলে জানা যায়। যদিও এরই মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দোকানে দোকানে ফানুস ঝুলিয়ে বিক্রি শুরু হয়েছে। পটকা-আতশবাজিও বিক্রি হচ্ছে, তবে কিছুটা গোপনে। পটকা-আতশবাজি ঢাকা থেকে না কিনে অনেকেই আবার পার্শ্ববর্তী জেলা থেকেও কিনে আনছেন ঢাকায়। মূলত থার্টি ফার্স্ট নাইটের আগের দিন এসব বিক্রি বেড়ে যায় এবং ক্রেতারাও কেনেন।
আরও পড়ুন
- থার্টি ফার্স্টের ফানুস যেন না হয় মৃত্যুর কারণ
- থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির শব্দে কাঁপছিল উমায়ের, পরদিনই মৃত্যু
- থার্টি ফার্স্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
রাজধানীর একাধিক স্থানে সরেজমিনে দেখা যায়, তাঁতিবাজার, শাঁখারীবাজারসহ পুরান ঢাকার অলিগলিতে কিছুটা লুকিয়ে বিক্রি হচ্ছে আতশবাজি ও ফানুস। শাঁখারীবাজারের বেশ কয়েকটি দোকানে পাওয়া যাচ্ছে ফানুস ও আতশবাজি। পরিচিত মুখ না হলে বিক্রি করছেন না তারা। আগে দামাদামি করে এরপর গোপন স্থান থেকে বিক্রেতারা এনে দিচ্ছে ক্রেতাদের হাতে।
আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলমান। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে অতীতের চেয়ে আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। এসব পণ্য উৎস থেকেই জব্দের চেষ্টা করেছি।- গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাঁখারীবাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, ফানুস ও আতশবাজি এখানের অনেক দোকানেই আছে, কিন্তু কয়েক বছর ধরে পুলিশ সমস্যা করে। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে ধরেও নিয়ে গেছে। এ কারণে প্রকাশ্যে কেউ বিক্রি করে না। অনেকটা গোপনেই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি করছি খুব পরিচিত মানুষের কাছে।
ফানুস ও আতশবাজির দাম বেড়েছে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, কয়েক বছর ধরে ফানুস ও আতশবাজির চাহিদা থাকায় দামও বেড়েছে। আমাদের কিনে আনতে হচ্ছে বেশি দামে। এজন্য বিক্রিও বেশি দামে করা লাগছে। তবে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে বিক্রি করছি।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব শিশু আতশবাজির শব্দে আনন্দিত হয় না, অনেক শিশু ভয়ও পায়। আতশবাজির কারণে অনেক পাখি আতঙ্কে ওড়াউড়ি করে, মারা যায়।
আইন কিংবা শুধু নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দায় এড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করে আমাদের আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ করতে হবে বলে যুক্তি নেন বিশেষজ্ঞরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, আইন করে বন্ধ করলে হয়তো ফাঁকফোকর দিয়ে কেউ না কেউ ফানুস-আতশবাজি ফোটাবে। এর চেয়ে সবার সচেতনতা জরুরি। শিশুসন্তানকে অন্তত ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে বললে তারা শুনবে। সচেতন না হলে আইন দিয়ে বন্ধ করা মুশকিল।
ডিএমপি বলছে, ঢাকা মহানগর এলাকায় সব ধরনের আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ। ফানুস ওড়ানো অবস্থায় অথবা আতশবাজি ফোটানো অবস্থায় কেউ যদি হাতেনাতে ধরা পড়ে তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৭ বছর বায়ুমান সূচক ৫০-এর বেশি
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২৪- এই সময়ের মধ্যে বায়ুমান সূচক কখনোই ভালো অবস্থানে ছিল না। বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে থাকলে ভালো বায়ু বলা হয়, সেক্ষেত্রে গত সাত বছরে নির্দিষ্ট দুদিনে (৩১ ডিসেম্বর এবং ১ জানুয়ারি) কখনোই বায়ুমান সূচক ৫০ এর নিচে ছিল না। তবে ২০২১-২২ সালে করোনাকালে কম আতশবাজি, পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানো হয়েছিল।
ক্যাপসের গবেষণা দলের মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের প্রথম ঘণ্টায় শব্দদূষণ হার আগের দিনের (৩০ ডিসেম্বর) তুলনায় প্রায় ৪২ শতাংশ বেড়ে যায় এবং বেশিরভাগ সময় শব্দের মাত্রা ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবলের মধ্যে ছিল।
হিসাব করে দেখা যায়, গত সাত বছরে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টা (১ জানুয়ারি) পর্যন্ত গড়ে ৯০ শতাংশ সময় শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবল অতিক্রম করেছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
আরও পড়ুন
- থার্টি ফার্স্ট নাইটের রাতে এক ঘণ্টায় বায়ুদূষণ বাড়ে ৩৫ শতাংশ
- কক্সবাজারে এবারও থার্টি ফার্স্টে নেই উন্মুক্ত আয়োজন
- থার্টি ফার্স্টে শব্দদূষণের হাজার অভিযোগ ৯৯৯-এ
নতুন বছরের আনন্দ উদযাপন এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে ছয়টি সুপারিশ জানিয়েছে ক্যাপস। এর মধ্যে রয়েছে, দূষণ সৃষ্টিকারী আতশবাজি ও ফানুসের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। আতশবাজি ও ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশ নেওয়া এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে।
নিয়ম ভাঙার উৎসবে মাতে নগরবাসী
প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও মানে না বেশিরভাগ মানুষ। গত কয়েক বছর ডিএমপি কমিশনারের সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং- III/৭৬) এর ২৮ ও ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে রাত ১২টা থেকে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ফানুস ওড়ানো ও মশাল মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।’ কিন্তু তাতে থামিয়ে রাখা যায়নি উদযাপন।
ফানুস যখন মেট্রোরেলের যম!
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও অংশ উদ্বোধনের মাধ্যমে ঢাকায় মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর থেকে জনসাধারণের চলাচলের জন্য এটি খুলে দেওয়া হয়। দুদিনের মাথায় ২০২৩ সালে বর্ষবরণ করতে নগরবাসী ফানুস ওড়ান। সেসব ফানুস গিয়ে পড়ে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে। প্রথমবারের মতো ফানুসের কারণে মেট্রোরেল বন্ধ হওয়ায় অনেকটা অবাক হয় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। দুই ঘণ্টা মেট্রোরেল বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়।
আগামীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো অভিভাবক সন্তানের হাতে ফানুস-আতশবাজি দেবেন না। যদি কেউ এসব কেনেন এবং ওড়ানোর চেষ্টা করেন তার বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম
২০২৪ সাল বরণে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও থার্টি ফার্স্ট নাইটে ওড়ানো ফানুস আটকে পড়ে উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক তারে। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে রাতেই দীর্ঘ এই ২০ কিলোমিটার রুটে তারে আটকে থাকা ফানুসগুলো অপসারণ করেন ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মীরা। কর্মীরা হেঁটে পুরো রুট থেকে ৩৮টির বেশি ফানুস অপসারণ করেন।
মেট্রোরেলের এক কিলোমিটারের মধ্যে ফানুস না ওড়ানোর অনুরোধ
মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন-৬ এর উভয় পাশে এক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারীদের থার্টি ফার্স্ট নাইট এবং খ্রিষ্টীয় নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে ঘুড়ি, ফানুসসহ যে কোনো বিনোদনসামগ্রী ওড়ানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
২০২৩ সালে এক রাতেই ৩৬৫ অভিযোগ পায় ৯৯৯
ইংরেজি নববর্ষ ২০২২ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনে ফানুস ওড়াতে গিয়ে রাজধানীর অন্তত ১০টি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। একই রাতে ঢাকার বাইরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ১৯০টি।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, এসব ঘটনায় একদিকে যেমন মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়, অন্যদিকে আগুন আতঙ্কে ম্লান হয় নববর্ষ উদযাপন।
২০২৩ সাল বরণ করতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে সারাদেশ থেকে শব্দদূষণ সংক্রান্ত ৩৬৫ ফোন পায় ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’। এর মধ্যে অধিকাংশ অভিযোগই ছিল আতশবাজি নিয়ে। এছাড়া বিভিন্ন তার এবং বাড়িতে ফানুস পড়ে আগুনের খবরও পাওয়া যায়।
৯৯৯ জানিয়েছে, বছরজুড়ে রাতে গানবাজনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নির্মাণকাজ, পটকা, আতশবাজির কারণে পরীক্ষার্থী, বয়স্ক ও অসুস্থ লোকদের সমস্যা হচ্ছে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে জানিয়েও কল আসে ৯৯৯ এ।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে ৫ বছরে আতশবাজি-ফানুসে কোটি টাকার ক্ষতি
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে আতশবাজি ও ফানুসে সারাদেশে এক কোটি আট লাখ ৬৮ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি না ফোটানো এবং ফানুস না ওড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে বাহিনীটি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর কারণে শতাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। যাতে প্রায় ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো থেকে ২০২১ সালে ১৬টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় চার লাখ পাঁচ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ওই বছর আতশবাজির উচ্চশব্দে তানজিম উমায়ের ওরফে মাহমুদুল হাসান নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
২০২০ সালে ৫০টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৭২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১৪ লাখ ৪৭ হাজার এবং ২০১৮ সালে ৪২টি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫৬ লাখ ছয় হাজার টাকার ক্ষতি হয়। এসব অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণের মাধ্যমে ফায়ার সার্ভিস তিন কোটি ৬৯ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদ উদ্ধার করে।
থার্টি ফার্স্টে শব্দদূষণ ১০২ ও বায়ুদূষণ ৩৬ শতাংশ বাড়ে
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাত বছরে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের সময় ক্যাপস পরিচালিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে বলেন, ২০২৩ সালের নববর্ষে রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টার বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৬ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ১০২ শতাংশ বেড়েছিল। অপরদিকে ২০২৪ সালের নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টার বায়ুদূষণের পরিমাণ প্রায় ৩৫ শতাংশ এবং শব্দদূষণ ৪২ শতাংশ বেড়েছিল। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষ, পশু-পাখি উদ্ভিদসহ সার্বিক প্রাণ-প্রকৃতির ওপর ব্যাপক খারাপ প্রভাব ফেলছে।
তিনি বলেন, আতশবাজি ও ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছর উদযাপন করা যেতে পারে। আমরা কখনই চাই না উৎসব-আনন্দে আইনের কঠোরতার মধ্য দিয়ে পার করি। সুস্থ, নির্মল পরিবেশই আমাদের কাম্য।
শব্দদূষণে এলাকার ইকো সিস্টেম ব্যাহত হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার পরিণতি কখনো ভালো হয় না। বায়ুদূষণের ফলে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি এলাকার বায়ুদূষণ অথবা শব্দদূষণের কারণে ওই এলাকার ইকো সিস্টেমে যত পোকা-মাকড় থাকে সেগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে উদ্ভিদের প্রজননের ক্ষেত্রেও একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটি আতশবাজি ফোটানোর কারণে যে এত বড় একটা প্রভাব বিস্তার করে সেটি কল্পনারও বাইরে।
ফানুস ওড়ানো-আতশবাজি ফোটানোর শাস্তি
থার্টি ফার্স্ট নাইটে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর পটকা, বাজি ও ফানুস ওড়ানো বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি এ বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় বলছে, অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণ ও স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, কান ভোঁ ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াসহ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর ৭ বিধি লঙ্ঘন করে অননুমোদিতভাবে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের সময় আতশবাজি ও পটকা ফোটালে তা বিধিমালার ১৮ বিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য বলেও উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়।
এই আইন ভাঙলে প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক একমাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
বরাবরের মতো নিষিদ্ধ থাকবে এবারও
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আসন্ন ইংরেজি নববর্ষ-২০২৫ নির্বিঘ্ন ও নিরাপদে উদযাপনের লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এ উপলক্ষে সব ধরনের আতশবাজি ও পটকা ফোটানো, ফানুস ওড়ানো এবং যে কোনো ধরনের বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবহার বরাবরের মতো নিষিদ্ধ থাকবে। এরই মধ্যে ডিএমপি নানান ধরনের প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। গত ২৬ ডিসেম্বর ১৩ বস্তা আতশবাজি ও পটকাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে ডিবি-লালবাগ বিভাগ।
প্রতি বছর আতশবাজি ফোটানোর কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও অনেকেই তা মানেন না। এবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী হবে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে অভিযান চলমান। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা থাকবে অতীতের চেয়ে আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার। এসব পণ্য উৎস থেকেই জব্দের চেষ্টা করেছি।’
নিয়ম ভাঙলেই ব্যবস্থা
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকদিন ধরে বিপুল পরিমাণ আতশবাজি-পটকা জব্দ করা হয়েছে, অভিযান চলমান। ডিএমপির প্রতিটি থানার ওসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। কোনো ব্যবসায়ী ফানুস-আতশবাজি বিক্রি করতে পারবে না। যদি কেউ বিক্রি করার চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নগরবাসীর উদ্দেশ্যে ডিএমপির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আগামীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কোনো অভিভাবক সন্তানের হাতে ফানুস-আতশবাজি দেবেন না। যদি কেউ এসব কেনেন এবং ওড়ানোর চেষ্টা করেন তার বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
টিটি/এএসএ/এমএস