সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে গুরুত্ব দিতে হবে
উন্নত জীবনমানের আশায় প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু তাদের যাওয়ার পথ বন্ধুর হয় না। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার কিংবা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখলেও প্রতারণার শিকার, শ্রম শোষণ, বেতন বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন তারা।
বর্তমান বৈশ্বিক শ্রমবাজারের পরিস্থিতি, শ্রমিকদের বঞ্চনা এবং বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন অভিবাসন ও শরণার্থীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ। সাক্ষাৎকারটির দ্বিতীয় পর্ব থাকছে আজ।
জাগো নিউজ: ভালো রেমিট্যান্স কীভাবে সম্ভব?
আসিফ মুনীর: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা শ্রমিকদের জন্য অনেক কারিকুলাম তৈরি করেছে, সেক্টরভিত্তিক। ভাষা থেকে শুরু করে কাজের আওতা পর্যন্ত। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন নেই। বিদেশের কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। শ্রমবাজার নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপভিত্তিক গবেষণা করতে হবে। ওই সব দেশের চাহিদা অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বেশি শ্রমিক না পাঠিয়ে অল্প শ্রমিক পাঠিয়ে তাদের বেতন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত কতে হবে। নতুন শ্রমবাজার খুলতে হবে। কর্মীবান্ধব চুক্তি করতে হবে, প্রতিটা কর্মীকে বৈধ ভিসায় পাঠাতে হবে।
- আরও পড়ুন:
দ্বিপক্ষীয় চুক্তি না থাকায় শোষণের শিকার প্রবাসী শ্রমিকরা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে দক্ষ শ্রমিক তৈরির প্রকল্প শুরু
উন্নত দেশ গড়তে দক্ষ মানবসম্পদ জরুরি
আমাদের ট্রেনিং সেন্টারগুলো অন্তত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, চীনে যাওয়ার জন্য ভাষা যদি শেখাতো, তাহলে প্রবাসীদের সেসব দেশে গিয়ে কাজের অভাব হতো না। ভাষায় দক্ষ হলে প্রবাসীরা ভালো আয়ও করতে পারতেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় আমাদের ট্রেনিং সেন্টার কার্যকর নয়। এগুলো জাস্ট পলিটিক্যালি গড়ে উঠেছে। শুধু ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে।
‘টিটিসিগুলো বাইরের মার্কেট অনুযায়ী যুগোপযোগী কাজ শেখাতে পারে না। এগুলো আমাদের দেশের কাজের জন্যই দক্ষ করে তুলতে পারে না, বাইরের দেশে তো দূরের কথা।’
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে ১০৪ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) রয়েছে। তবু জনশক্তির অভাবে ভুগতে হচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আসিফ মুনীর: আমাদের ট্রেনিং সেন্টার মান্ধাতার আমলের। এগুলো সব পলিটিক্যাল। মন্ত্রী, সচিবরা নিজ এলাকায় বানিয়েছেন। সেখানে না আছে ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিজ, না আছে দক্ষ ট্রেইনার। যেসব ট্রেনিং দেওয়া হয় সেটাও ফলপ্রসূ হয় না। টিটিসিগুলো বাইরের মার্কেট অনুযায়ী যুগোপযোগী কাজ শেখাতে পারে না। এগুলো আমাদের দেশের কাজের জন্যই দক্ষ করে তুলতে পারে না, বাইরের দেশে তো দূরের কথা। পর্যালোচনা করে দেখা যাবে গত কয়েক বছরে শুধু ভবনই উঠেছে। দক্ষ শ্রমিক তৈরি হয়নি। ভালো প্রশিক্ষকও তৈরি হয়নি। অথচ সরকার চাইলে বিদেশি শ্রমবাজার উপযোগী শ্রমিক তৈরি করতে পারে। প্রয়োজনে প্রফেশনাল ট্রেইনার আনতে পারে।
জাগো নিউজ: গত দুই বছরের তুলনায় বিদেশে শ্রমবাজারে কর্মী যাওয়া কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আসিফ মুনীর: সিন্ডিকেট, অনিয়ম, চাকরি ও বেতন নিশ্চয়তার অভাবে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে, সৌদিতে শ্রমিক পাঠানো বেড়েছে। কিন্তু ভালো রেমিট্যান্স আসছে না। এজন্য সবসময় কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটির দিকে নজর দিতে হবে। কোয়ান্টিটির চেয়ে স্কিল্ড মাইগ্রেশনকে গুরুত্ব দিতে হবে, বেশি লোক না পাঠিয়ে অল্প লোক পাঠিয়ে তাদের কর্মসংস্থান ও বেতন-ভাতা ঠিকভাবে পাচ্ছে কি না সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকারকে মনিটরিং করতে হবে। মনিটরিংয়ের অভাবে পুরো ব্যবসাটাই করে প্রাইভেট সেক্টর। নতুন নতুন শ্রমবাজার খুলতে হবে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে। জি টু জি পলিসি সক্রিয় হলে কর্মীরা লাভবান হবে।
জাগো নিউজ: আমাদের অভিবাসন ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন। কমানোর কোনো উপায় আছে কি?
আসিফ মুনীর: বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে। অবশ্যই ভিসায় কী কাজে যাবে আর বেতন বিবেচনা করে যেতে হবে। যে কোম্পানিতে যাচ্ছে সে কোম্পানি কী, এর সম্পর্কে অনলাইনে জেনে নিতে হবে। এখানে বিএমইটি ও প্রবাসী কল্যাণকে সাহায্য করতে হবে। ন্যূনতম শিক্ষাটা জরুরি।
‘সব কাজ কর্মীকে নিজে নিজে করতে হবে, সিস্টেমের বাইরে গিয়ে টাকা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’
পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ইনিশিয়াল সব কাজ কর্মীকে নিজে নিজে করতে হবে, সিস্টেমের বাইরে গিয়ে টাকা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকারকে বিদেশে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে জয়েন্ট ওয়ার্কিং মিটিংয়ের সময় এজেন্সি প্রতিনিধি, হাইকমিশন সদস্যসহ ব্যয় চূড়ান্ত করতে হবে যে এর চেয়ে বেশি টাকা নেওয়া ও দেওয়া যাবে না। তাহলে ব্যয় কমে আসবে।
জাগো নিউজ: এক্ষেত্রে প্রবাসী কল্যাণ কী উদ্যোগ নিতে পারে?
আসিফ মুনীর: লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সি ও প্রবাসীকল্যাণ সবার মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে হবে। সর্ষের মধ্যেই ভূত দেখা যায়। ভেতরের সিন্ডিকেট নির্মূল করতে হবে। সরকারি সিস্টেমে দুর্নীতি বন্ধ করলে অনেকটা স্থিতিশীলতা আসবে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার, কিছুটা স্বচ্ছতা ফিরলেও রাজনৈতিক সরকার এলে আবার আগের মতো হয়ে যেতে পারে। মালয়েশিয়া ইস্যুতে সরকারের চার রাঘববোয়াল কোটি কোটি টাকা মেরেছে। এগুলো প্রশাসন জানতো কিন্তু জবাবদিহিতার জায়গা ছিল না। কারণ তারা হাইলি পলিটিক্যাল লোক ছিল।
‘যারা সিন্ডিকেটে থাকে তারা এত পাওয়ারফুল যে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। নিউজ হলেও তারা কর্ণপাত করে না।’
যারা এসব সিন্ডিকেটে থাকে তারা এত পাওয়ারফুল যে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। নিউজ হলেও তারা কর্ণপাত করে না। এগুলো একদিনে পরিবর্তন হবে না। নিয়ন্ত্রণের জায়গায় সরকারকে ও প্রবাসী কল্যাণকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢালাওভাবে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালদের দোষ দিয়ে সমস্যা সমাধান হবে না। আগেও হয়নি।
আরও পড়ুন:
- অস্ট্রেলিয়ায় মানবপাচার চেষ্টা, ইন্দোনেশিয়ায় ১২ বাংলাদেশি উদ্ধার
২০২৪ সালেও শক্তিশালী থাকবে ধনী দেশের শ্রমবাজার
আরও জনশক্তি রপ্তানিতে মালয়েশিয়ার সহযোগিতা চান রাষ্ট্রপতি
জাগো নিউজ: ভিসা বাণিজ্য ও দালালের খপ্পরে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। সমাধান তো হচ্ছে না।
আসিফ মুনীর: লোক প্রেরণের পুরো প্রক্রিয়ায় গ্রাম থেকে প্রবাস পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা দরকার। এখানে হাইকমিশনের মাধ্যমে দেখতে হবে, বিদেশে একটা মানুষ কাজ পেলো কি না, সেখানে কি আসলে কাজ আছে, ওই কোম্পানি কি আসলেই লোক নিচ্ছে, ভালো স্যালারি দেবে, কমিটমেন্ট রাখবে কি না? এসব দেখার মতো লোক নেই। হাইকমিশন সবসময় বলে তাদের লোকবল সংকট। কিন্তু এই লোকবল বাড়বে কবে?
‘লোক পাঠাতে গ্রাম থেকে প্রবাস পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।’
সমাধান বলতে গেলে, এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে সরকারি লোকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কোনো কর্মী যখন বিদেশ যেতে যে তথ্য দরকার, সে তথ্য দালাল ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে সে পাচ্ছে না। তখন সে দালালের কাছে যায়। লোকাল লেভেলের প্রবাসীদের জন্য সরকারি সার্ভিস নেই। আমরা দালালদের দোষ দেই, কিন্তু সার্ভিস দালালরা দিচ্ছে। আমরা দেখি যে জেলা পর্যায়ে যে জনশক্তি অফিস আছে, সেখানেও গিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কর্মীরা তথ্য পান না। সেখানেও লোকবল কম।
জাগো নিউজ: মানুষ অসাধু ব্যবসায়ী আর দালালের দারস্থ হচ্ছে, প্রতারণা কমছে না কেন?
আসিফ মুনীর: মানুষ যখন বিদেশ যেতে মরিয়া, দালালরাও কাস্টমারের জন্য মরিয়া। অসহায় কর্মীরা ভালো জীবিকার জন্য দালালকে টাকা দিতে রাজি হন। দালালরা আশ্বস্ত করেন শ্রমিকদের। এখানে টাকা আদান-প্রদানে সলিড কোনো ডকুমেন্ট নেই। কোনো আইনি নির্দেশনা নেই। ফলে দালালরা বাধাহীনভাবে আয় করে। এজন্য অভিবাসনের পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে হওয়া উচিত। একদম পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ওই দেশে যাওয়া পর্যন্ত। তাহলে ব্যয়ও কমবে, প্রতারণাও কমবে। এখানে সরকার ও বিএমইটিকে তদারকি করতে হবে।
‘বাধ্যতামূলক রিসিট থাকা উচিত। যারা প্রতারণা করবে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে ক্ষতিপূরণ ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
অনেক দালালের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের হাতে বেশি টাকা থাকে না। পাঁচ লাখ টাকা নিলে দালাল রাখে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বাকি সব টাকা কোথায় কত যায়, সেটা দেখতে হবে। এখানে বাধ্যতামূলক রিসিট থাকা উচিত। যারা প্রতারণা করবে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে ক্ষতিপূরণ ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও পড়ুন:
- মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আবারও সিন্ডিকেটের আশঙ্কা
- সচিবালয়কে দালালদের হাটবাজার বানিয়ে ফেলা হয়েছিল
পাসপোর্ট অফিসে দালাল ধরে সেনাবাহিনীকে দিলো শিক্ষার্থীরা
জাগো নিউজ: ইউরোপের শ্রমবাজারে কর্মীরা অবৈধ হয়েই যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। উত্তরণের পথে বাধা কোথায়?
আসিফ মুনীর: প্রথম কথা হলো, ইউরোপের অনেক দেশের অ্যাম্বাসি আমাদের দেশে নেই। আমাদের এই মার্কেটগুলো ওপেন হয়ে আবার বন্ধ হয়ে যায়। কারণ আমাদের শ্রমিকরা ইউরোপের এক দেশে গিয়ে সেখান থেকে অধিক আয়ের আশায় উন্নত রাষ্ট্রে চলে যায়। একজন শ্রমিক রোমানিয়া গিয়ে সেখান থেকে ফ্রান্স চলে যায়। তখন ওই দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা আর থাকে না। পরবর্তীসময় তারা লোক নিতে ইচ্ছুক হয় না।
‘সরকারকে বৈধপথে চ্যানেল খুলতে হবে, প্রশাসনের দুর্বলতা কাটাতে হবে। সরকারের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। হাইকমিশনকে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসবে। আর এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা নিরুৎসাহিত করতে হবে।’
সবকিছুর মূলে হলো ইউরোপে শ্রমবাজার খুলতে হবে। এতে লাভ হবে আমাদের সরকারের। রেমিট্যান্স ভালো আসবে। আমাদের প্রশাসনের দুর্বলতা রয়েছে। ইউরোপের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই। রোমানিয়া, গ্রিসের সঙ্গে বার বার লোক পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়নি। এজন্য সরকারকে সেখানে বৈধপথে চ্যানেল খুলতে হবে। সরকারের প্রচেষ্টা থাকতে হবে। হাইকমিশনকে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস আসবে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাহলে কর্মীরা অবৈধ পথে পাড়ি দেবে না।
আমাদের কর্মীরাও অনেক ভুল করেন। তারাও কোনো ভাষা কিংবা দক্ষতা নিয়ে যাচ্ছেন না। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে লো ক্যাটাগরির চাকরি কিংবা রাস্তায় ফুটপাতে দোকান দেবে তবু বিশেষায়িত স্কিল্ড অর্জন করবে না। আমাদের ইউরোপকেন্দ্রিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ভাষা এবং কারিগরি কাজ শিখতে হবে।
আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম