সচিবালয়
মানা হয়নি ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ, সাজসজ্জায় বেড়েছে অগ্নিঝুঁকি
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। সেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অগ্নিঝুঁকি কমাতে নানান সুপারিশ করেছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরের সংস্কারকাজ এমনভাবে করা হয়েছে, যা আগুন লাগার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দিনগত রাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আগুন লাগার ঘটনায় পুড়েছে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের চারটি তলা। এ চার তলায় ছিল পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের অফিস। বুধবার দিনগত রাত ২টার কিছু আগে আগুন লাগে, ছয় ঘণ্টা চেষ্টার পর বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুন পুরোপুরি নিভতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা।
আগুন কীভাবে লেগেছে- সেটি নিয়ে নানান আলোচনা-গুঞ্জন থাকলেও তা নেভাতে এত সময় লাগার বিষয়টি ভাবাচ্ছে নতুন করে। এটি সচিবালয়ে অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বিষয়টি প্রকট করে তুলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সচিবালয়ে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে ছোটখাটো আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিস সেগুলো নেভাতে আসে। এছাড়া সচিবালয়ে মহড়া হয়েছে, ভবনগুলোর অগ্নিঝুঁকি নিরূপণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সেগুলো খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। এবারও আগুন নেভাতে এসে একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
সচিবালয়ের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো প্রবেশ করানো যায় না। এছাড়া হোসরিল পাইপ, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার ড্রিল এবং সব ফ্লোরে হাইড্র্যান্ট সিস্টেম স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে।
সচিবালয়ের ভবনগুলো দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বেশিরভাগ কর্মকর্তাই নতুন। তারা জানিয়েছেন, আগে কী হয়েছে তারা জানেন না। তারা আসার পর তাদের সামনে এ বিষয়গুলো আসেনি।
মাঝেমধ্যেই আগুনের ঘটনা ঘটেছে
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সচিবালয়ের পুরোনো কোনো ভবনই অগ্নি ঝুঁকিমুক্ত নয়। মাঝেমধ্যেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তবে সেগুলোতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
এর আগে গত ১ আগস্ট সচিবালয় ক্লিনিক ভবনে (৯ নম্বর ভবন) নিচ তলায় সিঁড়িকোঠায় বিদ্যুতের মেইন ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ডে (এমডিবি) আগুন লাগে। তবে সচিবালয়ের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাৎক্ষণিক আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এতে বিদ্যুতের তার পুড়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে ৬ নম্বর ভবনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অগ্নিকাণ্ড হয়। ৬ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৬০৬ নম্বর কক্ষে ফলস সিলিংয়ের সঙ্গে থাকা টিউব লাইটের স্টার্টারে আগুন লাগে। এতেও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
সচিবালয়ে আগুন নেভাতে কাজ করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা
এর আগে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের সপ্তম ও অষ্টম তলার মাঝামাঝি স্থানে বৈদ্যুতিক বোর্ডরুমে আগুন লাগে। গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সচিবালয়ের ক্লিনিকের পেছনে গণমাধ্যম কেন্দ্রের সামনে উত্তর দিকের দেওয়ালে এ আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে নেভান সেই আগুন।
এছাড়া ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৪ নম্বর ভবনের সপ্তম তলায় ৬২৯ নম্বর কক্ষে আগুন লাগে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সচিবালয়ের পুরোনো ৯টি ভবনের মধ্যে ৪, ৬ ও ৭- এ তিনটি ভবন সবচেয়ে বড়। ৭ ও ৪ নম্বর ভবন দুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে। ৬ নম্বর ভবনটির নির্মাণকাল আশির দশকের শেষ দিকে। এই তিনটি ভবনের সবকটিতেই বাইরের দিকে কোনো বারান্দা নেই। ৪, ৬ ও ৭ নম্বর ভবনের দুই পাশে রুম, মাঝে চলাচলের রাস্তা।
- আরও পড়ুন
- সচিবালয়ে আগুন ‘রিমোট কন্ট্রোল’ দিয়ে নাকি অন্য কিছু?
- একই রাতে আগুন লাগে সচিব নিবাসেও
- সচিবালয়ের আগুন সম্পূর্ণ নেভাতে লাগলো ১০ ঘণ্টা
কয়েক বছর আগে ১ নম্বর ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সবচেয়ে বড় ২১ তলাবিশিষ্ট ভবন ৬-এ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও মন্ত্রিসভা কক্ষ স্থানান্তর করা হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অন্যান্য দপ্তর ১ নম্বর ভবনেই আছে।
অগ্নি নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক পানি ছিটানোর ‘ফায়ার হোসরিল’ লাগানো হয়েছে ৬ ও ৭ নম্বর ভবনে। তবে ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার পর ফায়ার হোসরিল কাজ করেনি বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে।
সচিবালয়ের বেশিরভাগ ভবনে আগুন লাগলে ভবনে অবস্থানকারীদের ছাদে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কারণ ছাদে ওঠার মতো কোনো সিঁড়িই নেই।
সুপারিশ আমলে নেওয়া হয়নি
দীর্ঘদিন ধরেই ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, সচিবালয়ের ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো প্রবেশ করানো যায় না। এছাড়া হোসরিল পাইপ, ফায়ার অ্যালার্ম, ফায়ার ড্রিল এবং সব ফ্লোরে হাইড্র্যান্ট সিস্টেম স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে গণপূর্ত বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে।
২০২০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধার সচেতনতার জন্য সচিবালয়ের ৪ নম্বর ভবনে ‘অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার মহড়া’ চালায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। তবে সচিবালয়ের প্রবেশ গেট ছোট হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি।
আগুন নেভাতে পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে গেছে। গাড়ি বের করতে গিয়ে দেওয়ালের কয়েক জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ওইদিন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের তৎকালীন সহকারী পরিচালক ছালেহ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সচিবালয়ে কোনো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবিলা করা কঠিন হবে। কারণ, সচিবালয়ের প্রবেশ গেটগুলো খুবই ছোট। এসব গেট দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ভেতরে নেওয়া যায় না। ফলে যেসব গাড়ি নিয়ে আসা হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশই সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। মহড়ার জন্য যেসব বড় গাড়ি আনা হয়েছিল, সেগুলো সচিবালয়ের বাইরেই রাখতে হয়েছে। সচিবালয়ের ভেতরে যেখানে চারশ গাড়ি পার্কিং রাখার জায়গা রয়েছে, সেখানে এক হাজার ২০০ গাড়ি পার্ক করা হয়। তাই যদি পিক আওয়ারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে ফায়ার সার্ভিসের কোনো গাড়ি সঠিকভাবে সচিবালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয় ফায়ার সার্ভিস। সচিবালয়ের ভেতরের সংযোগ সেতুগুলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলাচলের প্রতিবন্ধক বলেও একাধিকবার জানিয়েছিলেন কর্মকর্তারা।
ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, সব ভবনে সার্ভে করে যে দুর্বলতা আছে তা চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে। এজন্য ৭ নম্বর ভবনে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে তাদের পদে পদে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। ৪ নম্বর ফটক দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি ভেঙে গেছে। গাড়ি বের করতে গিয়ে দেওয়ালের কয়েক জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড তদন্তে গঠন করা কমিটির সদস্য আমি। তাই এখন এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না।
- আরও পড়ুন
- সচিবালয়ের আগুনে পোড়া কুকুরের মরদেহ বলে দেয় এটি ষড়যন্ত্র
- সচিবালয়ের গেট ভেঙে ফায়ারের বড় গাড়ি ঢোকানো হয়েছে: ডিজি
- গান পাউডার ব্যবহার হয়েছে কি না, খতিয়ে দেখতে ‘বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তরে অধীন ইডেন ভবনে থাকা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা হলাম বাস্তবায়নকারী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’
সচিবালয়ে আগুনে পাঁচ মন্ত্রণালয়ের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে
অগ্নিঝুঁকি রোধে ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহনাজ সামাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এসে এ বিষয়গুলো পাইনি। তবে যতটা জেনেছি কিছু কিছু কাজ হয়েছে।’
সাজসজ্জায় দাহ্য পদার্থ, বাড়িয়েছে ঝুঁকি
আওয়ামী লীগ সরকারের সবশেষ সময়ের শেষ দিকে অনেক মন্ত্রণালয়ে সংস্কারকাজ হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাজসজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ। কাঠ দাহ্য পদার্থ হওয়ায় তা আগুন লাগার ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সবশেষ সময়ে অনেক মন্ত্রণালয়ে সংস্কারকাজ হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাজসজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ। কাঠ দাহ্য পদার্থ হওয়ায় তা আগুন লাগার ঝুঁকি অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
তারা বলেন, ৭ নম্বর ভবনের আগুন ছড়িয়ে পড়ার একটি বড় কারণ হলো মন্ত্রণালয়গুলো কাঠ দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছে।
গত ৯ জুন সচিবালয়ের অভ্যন্তরে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে অংশীজনদের অংশগ্রহণে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মো. নবীরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ওই সভা হয়।
সভায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. রাজ্জাকুল ইসলাম বলেন, সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের অভ্যন্তরীণ ডেকোরেশন কাজে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং অগ্নি দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। যাতে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বিনষ্ট হতে পারে। এছাড়াও সচিবালয়ে প্রবেশ গেটের জটিলতার কারণে ফায়ার সার্ভিসের বড় আকারের গাড়ি একটি গেট ছাড়া অন্য কোনো গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারে না।
আরএমএম/কেএসআর/এএসএম