বিমানের ফ্লাইটে ফের যৌন হয়রানির অভিযোগ, আতঙ্কে নারী কেবিন ক্রুরা
পাইলটের পর এবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টরন্টোগামী ফ্লাইটে এক পুরুষ কেবিন ক্রুর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন আরেক নারী কেবিন ক্রু। ঘটনার পর বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন ওই নারী। তবে এখনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। এতে আতঙ্কে আছেন নারী কেবিন ক্রু ও তাদের পরিবারের সদস্যরা।
সম্প্রতি বিমানের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা ককপিটে পাইলটের আসনে আরও দুটি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। এ দুটি ঘটনায় যৌন হয়রানির শিকার হন দুই নারী কেবিন ক্রু। তারা অভিযুক্ত পাইলটদের বিরুদ্ধে বিমান এমডির কাছে অভিযোগ করেন। তবে কোনো ঘটনায়ই এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।
টরন্টোর ফ্লাইটে যৌন হয়রানি
গত ১৯ নভেম্বর বিমানের এমডি বরাবর যৌন হয়রানির অভিযোগ দেন এক কেবিন ক্রু। অভিযোগে বলা হয়, ওই নারী কেবিন ক্রু বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস উপ-বিভাগে ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস হিসেবে কর্মরত। গত ১৮ অক্টোবর তিনি ঢাকা থেকে টরন্টো ফ্লাইটে ওঠেন। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল সেক্টরে তার পজিশন ছিল এ ফোর (A4)। ওই ফ্লাইটে এ টু (A2) ছিলেন আরেক কেবিন ক্রু এফ এস শিশির। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল সেক্টরে গ্যালিতে কাজের সময় এফ এস শিশির প্রথমবার অকস্মাৎ খারাপভাবে তার শরীর স্পর্শ করেন। বিষয়টি শিশিরকে বুঝতে না দিয়ে তিনি এড়িয়ে যান। কিন্তু ফ্লাইটে অন্যদের অগোচরে কাজের ফাঁকে বারবার আকস্মিকভাবে শিশির নারী কেবিন ক্রুর স্পর্শকাতর অঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবে অশালীন স্পর্শ করতে থাকেন, যা কুরুচিপূর্ণ ও যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। ওই নারী কেবিন ক্রু স্তম্ভিত হয়ে ফ্লাইটেই এর প্রতিবাদ করেন।
- আরও পড়ুন
- বিমানের ককপিটে কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানি, অভিযোগ পাইলটের বিরুদ্ধে
- যৌন হয়রানির অভিযোগ, গলায় ফাঁস নিলেন শিক্ষক
- কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশ কেন নয়
- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই যৌন হয়রানির শিকার হন’
ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, ওই ঘটনায় নারী কেবিন ক্রু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যান। বিষয়টি অন্য কলিগদের সঙ্গে শেয়ার করেন। কিন্তু তারপরও ইস্তাম্বুল থেকে টরন্টো যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে আবারও শিশিরের সঙ্গে উড়োজাহাজের মিড পজিশন দেওয়া হয়। এসময় শিশিরের সঙ্গে সখ্য থাকা অন্য পুরুষ ও নারী কেবিন ক্রুরা তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন।
শিশিরের যৌন হয়রানির বিষয়টি প্রথমে গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন দেখি ইস্তাম্বুল থেকে টরন্টো ফ্লাইটে ফের তার সঙ্গে একই সেক্টরে কাজ পড়েছে, তখন আগের ঘটনাটি চিফ পার্সারকে জানাই। তখন চিফ পার্সারসহ শিশিরের পক্ষের কয়েকজন আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পরে টরন্টোতে হোটেলে পৌঁছানোর পর ব্রিফিংয়ে আমাকে তারা স্যরি বলতে বাধ্য করেন। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার চাই।–ভুক্তভোগী নারী ক্রু
একজন পুরুষ কেবিন ক্রু বলেন, ‘ফ্লাইটে এসব ব্যবহার অ্যাকসেপ্ট করতে না পারলে তো এই চাকরি করা যাবে না’। এমন নানান কথা বলে তাকে শিশিরের কাছে ‘স্যরি’ বলতে বাধ্য করেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর থেকে তিনি চরমভাবে হীনম্মন্যতায় ভুগছেন ও ট্রমার মধ্যে আছেন। তাই বিমানের এমডি বরাবর অভিযোগ দেন তিনি।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন কেবিন ক্রু এফ এস শিশির। তিনি বলেন, ‘বিমানের নিয়ম অনুযায়ী টরন্টোগামী ফ্লাইটে ইস্তাম্বুলে ক্রু সেট পরিবর্তন হয়। সেখানে দুদিন থেকে আবার আরেক ফ্লাইটে ওঠেন কেবিন ক্রুরা। এই হিসেবে যেদিন আমরা ইস্তাম্বুল থেকে টরন্টো যাত্রা শুরু করবো, তখন ওই নারী কেবিন ক্রু ফ্লাইটের চিফ পার্সারের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন। তখন চিফ পার্সারসহ অন্য সহকর্মীরা তার প্রতিবাদ জানান। অভিযোগের প্রমাণ দিতে বলেন। কারণ, ঘটনার তিনদিন পর কেন অভিযোগ জানানো হলো। পরে প্রমাণ দিতে না পারায় ওই নারী সহকর্মী সবার কাছে স্যরিও বলেন।’
তবে ভুক্তভোগী ওই নারী কেবিন ক্রু জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশিরের যৌন হয়রানির বিষয়টি প্রথমে গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন দেখি ইস্তাম্বুল থেকে টরন্টো ফ্লাইটে ফের তার সঙ্গে একই সেক্টরে কাজ পড়েছে, তখন আগের ঘটনাটি চিফ পার্সারকে জানাই। তখন চিফ পার্সারসহ শিশিরের পক্ষের কয়েকজন আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন। পরে টরন্টোতে হোটেলে পৌঁছানোর পর ব্রিফিংয়ে আমাকে তারা স্যরি বলতে বাধ্য করেন। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার চাই।’
শিশিরের বিরুদ্ধে ওঠা ওই অভিযোগ তদন্ত করছেন বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শিশিরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। তদন্তের কাজ চলাকালীন এ বিষয়ে মন্তব্য করবো না।’
শিশিরের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির যে অভিযোগ উঠেছে তার তদন্ত চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারবো। তদন্তের কাজ চলাকালীন এ বিষয়ে মন্তব্য করবো না।- বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম
নারী কেবিন ক্রুদের অভিযোগ, বিমানের ফ্লাইটে নারী কেবিন ক্রুরা নিরাপদ নয়। তারা প্রায়ই পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একের পর এক এমন ঘটনায় তোলপাড় চলছে বিমানে। কিন্তু তারপরও অজানা কারণে দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক (সিইও) সাফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নারী সহকর্মী বা কেবিন ক্রুদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বিমান বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি বিমানের আলাদা ফ্লাইটে তিন নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখনো তদন্ত কমিটি কাজ করছে। আমরা বিষয় দুটি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে ২০১৯ সালেও বড় ধরনের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। যদিও সে ঘটনার দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি। একের পর এক নারী সহকর্মী যৌন হয়রানির শিকার হলেও অনেকটা নীরব বিমান কর্তৃপক্ষ। নারী কেবিন ক্রুদের অভিযোগ, বিমানে যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে প্রতিকার পাওয়া যায় না। কিছু ক্ষেত্রে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছেন কেবিন ক্রুরা। চাকরি রক্ষায় প্রতিবাদ করার সাহসও পাচ্ছেন না তারা।
জেদ্দার ফ্লাইটে যৌন হয়রানি
গত ১৪ নভেম্বর বিমানের সিইও বরাবর এক পাইলটের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং অপেশাদার আচরণের অভিযোগ করেন ফ্লাইট সার্ভিস উপ-বিভাগের এক কেবিন ক্রু। ওই অভিযোগে বলা হয়, গত ১০ নভেম্বর বিজি-১৩৫ নম্বর ফ্লাইট (ঢাকা-চট্টগ্রাম-জেদ্দা) অপারেট করেন ওই নারী কেবিন ক্রু। ফ্লাইটে অপারেটিং পাইলট ছিলেন মুনতাসীর ও আবেদ। ফ্লাইটের মাঝামাঝি সময় তারা ওই নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডাকেন। কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে পাইলট আবেদ তার সঙ্গে অপেশাদার (ব্যক্তিগত) কথাবার্তা বলেন। পরবর্তীসময়ে ককপিটের দরজার সামনে তাকে একা পেয়ে জোরপূর্বক হ্যান্ডশেকও করতে চান।
নারী সহকর্মী বা কেবিন ক্রুদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে বিমান বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি বিমানের আলাদা ফ্লাইটে তিন নারী কেবিন ক্রু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ও সিইও সাফিকুর রহমান
পরে গত ১২ নভেম্বর ফিরতি ফ্লাইটে (বিজি-২৩৬ জেদ্দা-সিলেট-ঢাকা) এই কেবিন ক্রুর ‘ওয়ার্কিং পজিশন’ ছিল সামনে। এ কাজের জন্য তাকে বেশ কয়েকবার ককপিটে যেতে হয়। তখন পাইলট আবেদ কৌতুক শোনানোর ছলে তাকে বাংলা ব্যাকরণ (কারক, সমাস, লিঙ্গ পরিবর্তন) নিয়ে কথা বলেন। এক পর্যায়ে আবেদ লিঙ্গ পরিবর্তন ও ধাতু নিয়ে কুরুচিপূর্ণ এবং অশ্লীল মন্তব্য করেন। এছাড়া নোংরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গিও করেন বলে অভিযোগ। ওইদিন রাতেই বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর ইমেইলে পাইলট আবেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন ওই নারী কেবিন ক্রু।
মাসকাটগামী ফ্লাইটেও যৌন হয়রানি
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-মাসকাটগামী ফ্লাইটেও এক পাইলটের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। বিমান সূত্র জানায়, গত ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে মাসকাটগামী বিজি ৭২১ নম্বর ফ্লাইট ছেড়ে যায়। এই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ইউসুফ মাহমুদ। তিনিও এক নারী কেবিন ক্রুকে ককপিটে ডেকে যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ। এ ঘটনায় গত ৭ নভেম্বর বিমানের এমডি ও সিইও বরাবর অভিযোগ দেন ওই নারী কেবিন ক্রু। লিখিত অভিযোগে ওই নারী জানান, মাসকটগামী ফ্লাইটে পাইলট ইউসুফ ওই নারী কর্মীকে ককপিটে ডেকে নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করেন এবং জোর করে কমলা খাইয়ে দেন।
বিমানের ফ্লাইটে ওই ধরনের যৌন হয়রানির ঘটনা দুঃখজনক বলে মনে করেন অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমানের ককপিটে কেবিন ক্রুকে যৌন হয়রানির ঘটনা অপ্রত্যাশিত। এটা পাইলটদের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আকাশপথে এ ধরনের কর্মকাণ্ড খুবই বিপজ্জনক।’
এমএমএ/এএসএ/এএসএম