শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা
নিষ্ক্রিয় যাচাই-বাছাই কমিটি, তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়া স্থগিত
চার ধাপে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রণয়ন করে আওয়ামী লীগ সরকার। একটি যাচাই-বাছাই কমিটি তালিকা প্রণয়নের কাজ করছিল। তালিকাটি চূড়ান্ত করার কথা ছিল এবার ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিষ্ক্রিয় যাচাই-বাছাই কমিটি। তালিকা প্রণয়ন প্রক্রিয়াও স্থগিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে তাদের পক্ষে আর যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। তখন তারা সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে জাতিকে দুর্বল করে দিতে হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানিরা তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তাদের বাসা থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এ গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দি অবস্থায়ও বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত মরদেহ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের মরদেহ শনাক্তও করা যায়নি। কারও কারও মরদেহের হদিসই মেলেনি। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয় সরকার। তালিকা প্রণয়নের জন্য ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করা হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা সম্পন্ন করা আছে। ৫৬০ জনের তালিকা গেজেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। ৫০ বছর পরে এসে এ ধরনের তালিকা করা দুরূহ ব্যাপার। অনেকে বেঁচে নেই, সন্তান-সন্তুতিরাও বেঁচে নেই। বাস্তব প্রেক্ষাপটই হচ্ছে এমন, এটা অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল কাজ।- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক)
চার দফা করা শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় শিক্ষক, রাজনীতিক, সমাজকর্মী, চিকিৎসক, আইনজীবী, চাকরিজীবী, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক, গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রকার, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ রয়েছেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক) জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটা তালিকা সম্পন্ন করা আছে। ৫৬০ জনের তালিকা গেজেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। ৫০ বছর পরে এসে এ ধরনের তালিকা করা দুরূহ ব্যাপার। অনেকে বেঁচে নেই, সন্তান-সন্তুতিরাও বেঁচে নেই। বাস্তব প্রেক্ষাপটই হচ্ছে এমন, এটা অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল কাজ।’
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, তালিকা করার বাছাই কমিটির প্রধান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সচিব। একজন অতিরিক্ত সচিবকে সদস্য ও একজন উপসচিবকে সদস্য সচিব করা হয়।
কমিটিতে গবেষক সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) তৎকালীন পরিচালক বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ।
- আরও পড়ুন
- রাষ্ট্র কী সম্মান দিচ্ছে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জোহাকে?
- আরও ১০৮ শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ
- শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেলেন সেই ‘চা দোকানি’ মধুদা
মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ জহির (বীর প্রতীক)।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, তালিকা করতে যে কমিটি করা হয়েছিল, সেটি আর কার্যকর নেই। কমিটির অনেক সদস্য বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। তাই পরবর্তী তালিকা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।
ওই কর্মকর্তা বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার জন্য কোনো আবেদন আহ্বান করেনি বাছাই কমিটি। বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষণা, আমাদের মন্ত্রণালয়েরও ৪০০ জনের মতো একটা তালিকা ছিল- সেগুলো আমলে নিয়ে তালিকা করা হয়। কমিটিও তাদের বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধান করেছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে যারা আবেদন করেছিলেন, সেগুলো আমলে নেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ চতুর্থ তালিকা প্রকাশের সময় তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আগামী ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। সবশেষ ও চূড়ান্ত তালিকা ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করবো।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার কাজ আপাতত স্থগিত আছে। এ বিষয়ে আগে যে কমিটি ছিল সেটি তো এখন আর নেই। সে কারণে কার্যক্রম আপাতত স্থগিত।’
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করার কাজ আপাতত স্থগিত আছে। এ বিষয়ে আগে যে কমিটি ছিল সেটি তো এখন আর নেই। সে কারণে কার্যক্রম আপাতত স্থগিত।- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় যাদের নাম এসেছে, তা যাচাই-বাছাই হবে কি না- এ বিষয়ে সচিব বলেন, ‘না, আমি মনে করি না, বুদ্ধিজীবীদের তালিকা রিভিউ করার প্রয়োজন আছে। যদি ভাতা বা এরকম সুবিধা দেওয়ার বিষয় থাকে, সেখানে নানান ধরনের কথা হয়। এখানে তো এমন কোনো বিষয় নেই।’
সচিব বলেন, ‘প্রথম যখন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করা হবে ঘোষণা হলো, তখন বহু আবেদন, অনেক লোকের যোগাযোগ ইত্যাদি ইত্যাদি…। এরপর যখন তখনকার মন্ত্রী মহোদয় বললেন, আমরা এটা থেকে কোনো সুবিধা দেবো না। তখন কিন্তু অনেকে নিরুৎসাহিত হলো। এরই মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকার চারটি গেজেট হয়েছে। সেখানে ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম রয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানাসহ মতামত দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। কমিটিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের মধ্যে কারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবেন সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতেও বলা হয়। বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ, পত্রিকা কাটিং, টিভি রিপোর্ট, অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কমিটিকে। একই সঙ্গে কমিটিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থা/জেলা/উপজেলা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের আবেদন যাচাই-বাছাই ও শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করতে বলা হয়।
কমিটি নির্ধারিত শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যে সব সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক সঙ্গীত ও শিল্পকলার অন্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিবেচিত হবেন।
পরে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কমিটির প্রথম সভায় প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২২২ জন বুদ্ধিজীবীর তালিকা অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ১৯৭২ সালে এক হাজার ৭০ জন শহীদের তালিকা, পরবর্তীসময়ে ডাক বিভাগ ১৫২ জন শহীদের ডাকটিকিট প্রকাশ করে সেই তালিকাও অনুমোদন দেওয়া হয় ওই সভায়।
পরের বছরের (২০২১) স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন ২৫ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রথম তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রথম দফা তালিকায় ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম আসে। ২০২২ সালের ২৯ মে দ্বিতীয় তালিকায় ১৪৩ জন, ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা তৃতীয় তালিকায় ১০৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম স্থান পায়।
সবশেষ চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রকাশ করা হয় চতুর্থ তালিকা, এ তালিকায় আরও ১১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম আসে। চার দফায় মোট ৫৬০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকা প্রকাশ করা হয়।
আরএমএম/এএসএ/এএসএম