নবীগঞ্জ

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও শহীদ ধ্রুবের কবর শনাক্ত হয়নি

মতিউর রহমান মুন্না
মতিউর রহমান মুন্না মতিউর রহমান মুন্না , গ্রিস প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:২৭ এএম, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদের সঙ্গে লেখক

১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ শহর মুক্ত করতে পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর সেনানী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও এই বীর শহীদের স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমন কি বছরের পর বছর চলে গেলেও তার শাহাদাতবার্ষিকী পালন করতে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেখা যায় না। অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই বীর সেনানীর শেষ স্মৃতি সমাধিটুকুও।

ধ্রুব’র সহযোদ্ধা ও একাত্তরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রশীদ বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে অশ্রুসিক্ত নয়নে ধ্রুব’র স্মৃতিচারণ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদ একাত্তরের ধ্রুব’র অবদানের বিষয়ে বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার, নবীগঞ্জ বাহুবলে শহীদ ধ্রুব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৫ নভেম্বর নবীগঞ্জে আসে মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। তার পরপর নবীগঞ্জের গজনাইপুরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই যুদ্ধে ধ্রুব’র বন্দুকের গুলিতে চারজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। তারপর ধ্রুব নবীগঞ্জের চৌধুরী বাজারে রশীদ বাহিনীর সঙ্গীয় সদস্য হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পরে বাহুবল উপজেলায়ও মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে বীর সেনানী ধ্রুব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

‘১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশিদের নেতৃত্বে রশীদ বাহিনীর ৩৫ সদস্য সহকারে নবীগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। ৪ ডিসেম্বর ভোরে নবীগঞ্জে পৌঁছায় রশীদ বাহিনী। সেখানে অবস্থানকালে নবীগঞ্জে পাক-হানাদার বাহিনীর মূল ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত নবীগঞ্জ থানায় আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। মুক্তিবাহিনীর রশীদ, ধ্রুবসহ অন্যান্য সদস্যরা নবীগঞ্জ থানার গেটের কাছে যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলে পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে।’

তিনি বলেন, এ সময় পাক হানাদার বাহিনীর একটি গুলি তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র মাথায় লাগে। এতে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে প্রাণ হারায় মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। ওই যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে আরও তিনজন মুক্তিযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরে মুক্তি বাহিনী পিছু হটে। তখন যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র লাশ নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কে পড়ে থাকে। পচন ধরে ধ্রুব লাশে। পরে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৬ ডিসেম্বর নবীগঞ্জ থানাকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও শহীদ ধ্রুবের কবর শনাক্ত হয়নি

মুক্তিযোদ্ধা রশীদ বলেন, নবীগঞ্জ স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমান নবীগঞ্জ থানার গেটের সামনেই চাপ মাটি দেওয়া হয় ধ্রুবকে। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বিভিন্ন মহল থেকে ধ্রুব’র স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার আশ্বাস দিয়ে আসলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়েও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশীদ।

একাত্তরে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রশীদ বাহিনীর প্রধান মুক্তিযোদ্ধা মুর্শেদ জামান রশীদ আরও বলেন, ‘মারা যাওয়ার আগে যদি দেখে যেতে পারি শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে তাহলে মরার পরেও শান্তি পাবো এবং ধ্রুব‘র আত্মাও শান্তি পাবে।’

খোঁজ নিয়ে যায়, দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব’র সমাধিটি আজও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে সম্মান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের। কিন্তু ঠিকানাবিহীন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ধ্রুবের সমাধি আজও অচিহ্নিত অবস্থায় নবীগঞ্জ থানা সংলগ্ন নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের পাশে রাজনগর গ্রামের কবর স্থানের একপাশে পড়ে আছে।

একজন টগবগে যুবক যার তখনও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি কিন্তু দেশ মাতৃকার টানে ধ্রুব অপরিণত বয়সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

অনেকেই বলেন, শ্রীমঙ্গলের কোনো এক চা-বাগানের দরিদ্র শ্রমিক পিতামাতার সন্তান ছিল শহীদ ধ্রুব। একদিকে ঠিকানাবিহীন, অন্যদিকে সমাধি অচিহ্নিত, অবহেলিত এই কি ছিল শহীদ ধ্রুবের স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ।

নবীগঞ্জের দিনারপুর কলেজের অধ্যক্ষ তনুজ রায় বলেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও তার সঠিক সমাধিস্থল নির্ধারণ করা যায়নি এবং তার স্মৃতি রক্ষার্থে কোনো স্মৃতিস্বারক বা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি। নবীগঞ্জবাসীর দাবি অতিদ্রুত শহীদ ধ্রুব’র নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক।’

নবীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র এটিএম সালাম জানান, ‘স্বাধীনতার ইতিহাস নির্মম, নবীগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা ধ্রুব নিহত হন। নবীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বীর সেনানীর নাম ধ্রুব।’ শহীদ ধ্রুবের সমাধিস্থল শনাক্ত করে সরকারিভাবে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে শাহাদাৎবার্ষিকী পালনের জন্য সবার প্রতি দাবি জানান এটিএম সালাম।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ধ্রুব’র সমাধিস্থল শনাক্ত করতে না পারার ব্যাপারে ব্যর্থতা রয়েছে স্বীকার করে নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, ‘শহীদ ধ্রুব সমাধিস্থল শনাক্ত করা যায়নি বলে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি।’

এমআরএম/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।