সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০২:২৩ পিএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪
রাজধানীর নতুনবাজারে উত্তরণ ফুড কর্নারের উদ্যোক্তা তৃতীয় লিঙ্গের শোভা সরকার/জাগো নিউজ

উত্তরণ ফুড কর্নার। রাজধানীর নতুনবাজারে গেলেই রাস্তার পাশে এই ফুড কর্নারে চোখে পড়বে থরে থরে সাজানো বার্গার, চিকেন ফ্রাই, চাওমিন, শর্মাসহ লোভনীয় সব খাবার। এই খাবারের দোকানের বেশিরভাগ ক্রেতা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ব্যবসা পরিচালনা করেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শোভা সরকার। এক সময় বাড়ি থেকে বিতাড়িত শোভা এখন একজন সফল উদ্যোক্তা।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও অন্য আর দশজনের মতো নিজের একটা পরিচয় তৈরি করেছেন শোভা সরকার। হয়ে উঠেছেন পাকা রাঁধুনী। দোকানে খাবার তৈরির পর নিজেই ক্রেতাদের পরিবেশন করেন। রেখেছেন ছয়জন কর্মী। নিজের আয়ের পথ তৈরি করে অন্যদের সহায়তা করতে পেরে খুশি তিনি।

সব বাধা পেরিয়ে সফল হওয়ার গল্প শোনালেন শোভা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ার কারণে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাইকে ছাড়তে হয় এক সময়। বিতাড়িত হতে হয় পরিবার থেকে। পরিবার, সমাজ কেউই দায়িত্ব নেয়নি তার। ভালো রান্না করা সত্ত্বেও চাকরিচ্যুত হন রান্নার কাজ থেকে। সেই শোভা এখন পরিবারের বড় কর্তা।

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

আমি ইনকাম করি বিধায় আমার ভাই-বোন প্রতিদিন ফোন দেয়, কেমন আছ? এখন আমি সবার প্রিয় পাত্র হয়ে গেছি। এখন আমার দোকান আছে, আমি টাকা ইনকাম করতে পারি। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হলে আমাকে ফোন দেয়। এখন আমি বাড়িতে মেইন (প্রধান) লোক, যার সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু হয় না, সেটা এখন আমি।- তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শোভা সরকার

উত্তরণ ফুড কর্নারের এই উদ্যোক্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিবারের লোকজন জন্মের পর থেকে আমাকে দেখতে পারেনি। আমি পড়াশোনা বেশি করতে পারিনি। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বাসায় থেকে পড়াশোনা করি। বাসায় থাকতেই হয়রানির শিকার হই। তারপর আমার নানুর বাড়িতে চলে যাই। সেখানে স্কুলে ভর্তি হলেও ক্লাস করতে পারিনি, শুধু পরীক্ষা দিয়েছি। এভাবেই আমি ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। এরপর আমি একটি সংগঠনে চাকরি নেই, সেখানে রান্নাবান্না করতাম। এখন যদিও তারা হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে, কিন্তু সে সময় তারা আমাকে বের করে দিয়েছিল। তখন আমি নিজেও জানতাম না, আমি হিজড়া কি না, কারণ নিজের জেন্ডার আইডেন্টিটি আমার কাছে ক্লিয়ার ছিল না। পরে আমি বাঁধন হিজড়া সংগঠনের খোঁজ পাই। ওখানেই হিজড়াদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেখানে একমাস রাস্তায় টাকা তোলা ও বাচ্চা হলে নাচ-গান করার কাজে যুক্ত ছিলাম। এরপর আমার আর ভালো লাগেনি, কারণ মানুষ টাকা দিতে অনীহা প্রকাশ করতো।’

আরও পড়ুন:

কীভাবে ব্যবসার শুরু, জানালেন শোভা। বলেন, ‘আমার এক বান্ধবীর উত্তরণ নামের একটি পার্লার ছিল। সেখান থেকেই ফাস্টফুড কর্নারের একটি আইডিয়া এলো। কারণ আমার রান্না সবাই পছন্দ করতো। ম্যানেজার আমাকে বিদায় করেছিল ঠিকই কিন্তু আমার রান্না যারা খেতো তারা খুব প্রশংসা করতো। তারা বের করে দেওয়ার পর আমি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।’

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

কান্নাজড়িত কণ্ঠে শোভা বলেন, ‘আমি উত্তরণ ফুড কর্নার দেওয়ার পর বাবার চিকিৎসা নিজেই করিয়েছি, পরে তিনি মারা যান। এরপর আমার মা আমার কাছে চলে আসেন। কারণ আমার ভাই-বোনরা কেউ তাকে দেখেন না। এখন আমার মা আমার কাছে থাকেন। আমার মা এখন আমাকে অনেক আদর করেন। আগে আদর করতেন না, সেজন্য এখন বেশি আদর করেন। আমি ইনকাম করি বিধায় আমার ভাই-বোন প্রতিদিন ফোন দেয়, বলে কেমন আছ? এখন আমি সবার প্রিয় পাত্র হয়ে গেছি। এখন আমার দোকান আছে, আমি টাকা ইনকাম করতে পারি। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান হলে আমাকে ফোন দেয়। এখন আমি বাড়িতে মেইন (প্রধান) লোক, যার সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু হয় না, সেটা এখন আমি।’

শুরুর দিকে কেমন ছিল ব্যবসা

শোভা সরকার বলেন, ‘প্রথম দুই মাস যখন এই ফুড কর্নার দেই তখন দিনে একশ টাকাও বিক্রি হয়নি। আমার কিছু বন্ধু যখন ফেসবুকে এটা পোস্ট করে তখন ইউনির্ভার্সিটির লোকজন আসে, আশপাশের লোকজন আসে। তখন থেকে আমার দোকানটি ব্র্যান্ড হওয়া শুরু করলো। আমি সুস্বাদু ও ভালো খাবার দেওয়ার চেষ্টা করি, সেজন্য খুব ভালো বিক্রি হয়। আমার দোকানে অনেক কাস্টমার। আমি সবচেয়ে পছন্দ করি নারী কাস্টমারদের, তারা এলে আমি খুব হ্যাপি হই। আমার কাছে কাজটা গর্বের মনে হয়, কাজের মাধ্যমে পরিশ্রম করে খাচ্ছি। দিন শেষে রাতে যখন টাকা গুনি খুব ভালো লাগে। আমার এখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর লোকজনও কাজ করছে। এখন ছয়জন স্টাফ নিয়ে ফুডকার্টটি চালাচ্ছি। তাদের মোট বেতন দিতে হয় লাখ টাকা। প্রতিদিন ১০ থেকে ২৩ হাজার টাকার বিক্রি হয়। বিভিন্ন দিবসে আরও অনেক বেশি বিক্রি হয়।’

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা নিগ্রহের শুরু হয় নিজের পরিবার থেকেই

শোভা সরকার বলেন, রাস্তায় চাঁদা তোলা, নেচে গেয়ে নবজাতক শিশুকে আশীর্বাদ করে অর্থ আয় সাধারণত হিজড়া সম্প্রদায়ের আয়ের বড় উৎস। তবে এসব কর্মকাণ্ড ভালোভাবে দেখে না সমাজের মানুষ। ফলে হিজড়া সম্প্রদায়ের কাউকে দেখলে অনেকটা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন অনেকে। তবে সেই প্রথা ভেঙেছেন তিনি।

আমার কাছে কাজটা গর্বের মনে হয়, পরিশ্রম করে খাচ্ছি। দিন শেষে রাতে যখন টাকা গুনি খুব ভালো লাগে। আমার এখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর লোকজনও কাজ করছে। এখন ছয়জন স্টাফ নিয়ে ফুডকার্টটি চালাচ্ছি। তাদের মোট বেতন দিতে হয় লাখ টাকা। প্রতিদিন ১০ থেকে ২৩ হাজার টাকার বিক্রি হয়। বিভিন্ন দিবসে আরও অনেক বেশি বিক্রি হয়।-তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ শোভা সরকার

এড়িয়ে চলার বদলে তার ফুড কর্নারে আগ্রহ নিয়ে খেতে আসেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরম যত্নে উত্তরণ ফুড কর্নারে তাদের মজাদার খাবার পরিবেশন করেন শোভা ও তার কর্মীরা।

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শোভা সরকার বুঝতে পারেন তিনি সবার থেকে আলাদা। পরিবার, সমাজের লোকজন তার সঙ্গে নানান ধরনের নেতিবাচক আচরণ শুরু করেন। বাধ্য হয়েই ঘর ছাড়তে হয় তাকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাড়ি থেকে বের হন। একসময় যার বাবা-মায়ের সংসারে জায়গা হয়নি আজ সেই শোভা পরিবারের কর্তাব্যক্তি। নাম-ডাকের যেন শেষ নেই তার।

তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি

২০১৩ সালে নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। এখনো সমাজের বঞ্চিত আর নিগৃহীত জনগোষ্ঠী তারা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার।

আরও পড়ুন:

উত্তরণ ফুড কর্নারে কাজ করেন তৃতীয় লিঙ্গের আরেকজন কণা চৌধুরী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যে মানুষের মাঝে চলাফেরা করছি, মানুষের সঙ্গে মিশছি এটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে তারা আমাদের কাছে টেনে নিচ্ছে। আমাদের এখানে যে খাবার আছে সেটা মানসম্মত। এখানে যারা খাবার খাবে আশা করি তারা বলবে খাবারটা ভালো। তবে এখনো সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত আমরা।’

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তৃতীয় লিঙ্গের রাশেদ হোসাইন কাজ করেন শোভা সরকারের এই ফুড কর্নারে। তিনি বলেন, ‘আগে আমি নিজেই এখানকার নিয়মিত ভোক্তা ছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়ার পর আমাকে চাকরি দিয়ে সহযোগিতা করেছেন শোভা সরকার। আমি বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে ভালোও করেছি, কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় চাকরি দেয়নি কেউ।’

হিজড়া সম্প্রদায়ের যারা চাঁদাবাজি করে কিংবা অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের থেকে বেটার হলো একজন উদ্যোক্তা হওয়া। সেই হিসেবে তারা যে কাজকর্ম করছে এটা অত্যন্ত ভালো একটি কাজ। হিজড়া বলে যে তাদের এড়িয়ে চলতে হবে এমন কিছু নয়। তারাও মানুষ আমরাও মানুষ। তাই মানুষের উচিত মানুষের পাশে থাকা।- মাদরাসা শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম

শোভার দোকানে খেতে আসা স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মঞ্জুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তাদের ব্যবসা ইতিবাচকভাবে দেখি। কারণ তারা যে কার্যক্রমগুলো করতো যেমন-মানুষের কাছে হাত পাততো, টাকা আদায়ে বলপ্রয়োগ করতো, সেটি সমাজ ভালোভাবে দেখে না। সেখান থেকে তারা যদি নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করে সেটি আমাদের দেশের জন্য ভালো। তারাও মানুষ, সব শ্রেণির মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। এখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে খাবার বানাচ্ছে কি না সেটি দেখার বিষয়, সেটি হিন্দু-মুসলিম কিংবা কে বানালো সেটি মূল বিষয় নয়। সেদিক বিবেচনায় এখানে মানসম্পন্ন ভালো খাবার পাওয়া যায়।’

সংসার থেকে বিতাড়িত শোভা এখন পরিবারের মুখ্য কর্তা

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নামায়েত সাকিব অন্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা তো নরমাল একটা শপই আমার কাছে মনে হয়। এটা হিজড়া দ্বারা পরিচালিত সেভাবে আমি দেখি না। এটা তো ভালো। বাসে যখন উঠি, দেখি তারা চাঁদাবাজি করে বা অনেক কিছুতেই জড়িয়ে পড়ে পরিস্থিতির কারণে। সেদিক থেকে তো ওনার (শোভা) পরিস্থিতি ভালো, উনি একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করতে পেরেছেন এবং তার সঙ্গে কয়েকজনকে চাকরিও দিতে পেরেছেন। এটা কিন্তু সোসাইটির জন্য ভালো একটা বিষয়।’

আরও পড়ুন:

আরেক শিক্ষার্থী তাওহীদা ঐশী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপনার মনের ভেতরে যদি ধারণা থাকে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রান্না করছে সেই রান্নাটা ফ্রেশ হবে কি না, সেখানে আমার কোনো অভক্তি হবে কি না, সেক্ষেত্রে বলার কিছু নাই। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের কীভাবে আমরা বেড়ে উঠতে দেবো সেটা একটা বড় বিষয়। জিনিসটা স্বাভাবিক হচ্ছে, এটা একটা ইতিবাচক বিষয়। শুধু আমরাই না, অনেকেই প্রতিদিন এখানে খায়। কিছু কিছু দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে তারা অনেকটাই পিছিয়ে আছে, আবার কেউ কেউ কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে এগিয়েও যাচ্ছে।’

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হিজড়া সম্প্রদায়ের যারা চাঁদাবাজি করে কিংবা অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের থেকে বেটার হলো একজন উদ্যোক্তা হওয়া। সেই হিসেবে তারা যে কাজকর্ম করছে এটা অত্যন্ত ভালো একটি কাজ। হিজড়া বলে যে তাদের এড়িয়ে চলতে হবে এমন কিছু নয়। তারাও মানুষ, আমরাও মানুষ। তাই মানুষের উচিত মানুষের পাশে থাকা।’

আইএইচআর/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।