সহিংস আচরণে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে শিশুরা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে সব স্তরের মানুষ। আন্দোলনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। সেসময় মিছিল, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি দেখেছে। রাজপথে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়া দেখেছে। ফলে সেখান থেকে এক ধরনের সহিংস আচরণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে শিশুরা। এখন বিভিন্ন ইস্যুতে এক অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তারা, করছে লুটপাট-ভাঙচুর।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলোতে দেখা যায় শিক্ষককে ঘিরে ধরে পদত্যাগের জন্য জোর করছে শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো জায়গায় শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ ও সংঘাত দমনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপ্রয়োজনীয়’ ও ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বলপ্রয়োগের গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। একজন শিশু ক্ষতিকর হওয়ার কারণ না হলেও তাদের ওপর ভয়াবহ বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে সহিংস হয়ে ওঠে তারা।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি স্কুলের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার (ছদ্মনাম)। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া এই শিক্ষার্থী চলতি মাসে অপর এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। ফলে স্কুল থেকে তার পরিবারকে সতর্ক করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শাহরিয়ারের মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ছেলে ছোটবেলা থেকে কিছুটা চঞ্চল ছিল ঠিকই, কিন্তু মারামারি করার নালিশ কখনো আসেনি। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার আচরণে এতো বেশি পরিবর্তন এসেছে যা ভাবনার বাইরে। সেদিন স্কুলে ওর এক সহপাঠীকে মারধর করেছে। স্কুল থেকে সতর্ক করেছে, সেটি নিয়ে আমি যতোটা না চিন্তা করছি, তারচেয়ে বেশি চিন্তা করছি আচরণগত পরিবর্তন দেখে। এখন চাইলেও অনেক সময় ওকে ঘরে রাখতে পারি না। বাসায় ওর ভাইকেও মারধর করে, অল্পতেই রেগে যায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা খুবই মারমুখী। আমরা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত।’
- আরও পড়ুন
- চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ৪৮২ শিশু নিহত
- আন্দোলনে আহত-নিহতের পরিবারকে সহায়তায় হলো ফাউন্ডেশন
- অভ্যুত্থানে ১০৫ শিশু নিহত, প্রত্যেক পরিবার পাচ্ছে ৫০ হাজার টাকা
- গুটিকতক শিশুর ভালো থাকা নিয়ে আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই
- এবার মোল্লা কলেজে সোহরাওয়ার্দী-নজরুলের শিক্ষার্থীদের হামলা
শাহরিয়ারের মতো অসংখ্য শিশু-কিশোরের মধ্যে আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারও কারও আচরণে ভয়, আতঙ্ক, দুঃখবোধ, অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, অশান্তি, চমকে ওঠা, বাকরুদ্ধ হওয়া, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অসহায়ত্ববোধ, অপরাধবোধ, ক্লান্তিবোধ, রাগ প্রকাশ পাচ্ছে।
শিশু অধিকারবিষয়ক জোট ‘চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ’ (সিআরএসিবি) এর তথ্যমতে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ১৮১ শিশু নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী শিশুর নাম আবদুল আহাদ। ওর বয়স ছিল চার বছর।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় গত ১০ সেপ্টেম্বর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফাইল ছবি
তবে গত ৬ অক্টোবর মহিলা ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ জানিয়েছেন, জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মোট ১০৫ জন শিশু মারা গেছে।
এ ছাড়া আন্দোলন চলাকালে গণগ্রেফতারের শিকার হয়েছে অসংখ্য শিশু-কিশোর। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রেফতার হয়ে ১৫ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ১৩৭ জন শিশু-কিশোর বন্দিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালনায় গাজীপুরের টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
দড়ি বেঁধে পুলিশ ভ্যানে তোলা ও রিমান্ডে নেওয়ার সেই সময়ের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে ওঠে ওই কলেজছাত্র। অপমানবোধ আর নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় তার মনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে ফিরে তার বিষয়টি সামনে এলে মানসিক পীড়ায় ভোগে সে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ২৪ জুলাই রাতে সাদা পোশাকে একদল পুলিশ ঢাকার মাতুয়াইলের বাসা থেকে ঢাকা কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকে (১৭) আটক করে। এরপর তাকে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখায়। শিশু হওয়া সত্ত্বেও দাগি আসামিদের মতো হাতকড়া ও দড়ি বেঁধে কলেজছাত্রকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। ১০ দিনের রিমান্ডে চাইলে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আসে। রিমান্ড বাতিলের পর জামিনে মুক্তি পায় ওই কলেজছাত্র। এরপর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। দেশ চালাচ্ছে শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
কিন্তু দড়ি বেঁধে পুলিশ ভ্যানে তোলা ও রিমান্ডে নেওয়ার সেই সময়ের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে ওঠে ওই কলেজছাত্র। অপমানবোধ আর নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় তার মনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে ফিরে তার বিষয়টি সামনে এলে মানসিক পীড়ায় ভোগে সে।
কলেজছাত্রের বড় ভাই জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওই সময় আন্দোলনের যে পরিস্থিতি ছিল, তখন তার বিশালতা বা প্রগাঢ়তা বুঝতে পারেনি সে। তার মাথায় শুধু এটুকুই ছিল সে আসলে কী কারণে গ্রেফতার হলো? তাকে হাতকড়া পড়িয়ে ও দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে কেন। অপমানবোধ ছিল। কিন্তু এখন আরো গভীরভাবে বুঝতে পারছে যে ওই সময়ে সে কতোটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
‘গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অফিসের ঘটনাগুলো, থানায় তাকে যে নির্যাতন করা হয়েছিল, যখনই রাজনৈতিক কোনো সংঘাত দেখা যায় তখন সেগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক সময় কোনো না কোনো প্রেক্ষাপটে তার সেই সময়ের ঘটনাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলে আসছে। তখনই সে ট্রমায় পড়ে যায়। প্রায়ই সে আফসোস করে, সেই সময়টা তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে এমনটা বলে আমাদের কাছে। এই বিষয়গুলো যে তার জন্য স্বাভাবিক না, সেটি তার মনে পীড়া দেয়। ওর বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে এখনও কিছুটা আইনগত জটিলতা আছে, আশা করি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।’ বলছিলেন শিশুটির বড় ভাই।
‘আমরা জেনেভা ক্যাম্পের শিশুদের নিয়ে বসেছিলাম। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ওই শিক্ষার্থীরা বলছে বের হতে ভয় লাগে। শুধু তারা নয়, অন্য শিশুরাও ট্রমার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যের ভয়টা কাটেনি।’- গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী
রাজনৈতিক সংঘাত প্রভাব ফেলেছে শিশুদের ওপর
গণসাক্ষরতা অভিযান ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (ব্র্যাক-আইইডি) মতবিনিময় সভায় শিশুদের আচরণিক পরিবর্তনের নানা কারণ তুলে ধরা হয়। তারা বলছেন, শিশুদের মনে দীর্ঘ সময়ের প্রভাব হতে পারে সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারি, রাজপথে যারা গুলি ছোড়া দেখেছে, পরিবারে বা আশেপাশে শিক্ষার্থীদের গুরুতর আহত হওয়া বা মৃত্যু দেখেছে। এছাড়াও সরাসরি ঘটনাস্থলে সহিংসতা দেখা বা ভীতিকর অভিজ্ঞতা হওয়া, কারও কাছ থেকে জানা, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা, পত্রিকায় পড়া এবং তা কল্পনা করা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু তাদের মনে প্রভাব ফেলছে।
- আরও পড়ুন
- সায়েন্সল্যাব মোড়ে ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ
- ভবন থেকে ইট ছুড়ছেন সিটির ছাত্র, নিচ থেকে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা
- আইডিয়াল ও ঢাকা কলেজ সংঘর্ষে আহত ১৭ জন ঢামেকে
- ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজের ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, গাড়ি ভাঙচুর
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধূরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জেনেভা ক্যাম্পের শিশুদের নিয়ে বসেছিলাম। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া ওই শিক্ষার্থীরা বলছে বের হতে ভয় লাগে। শুধু তারা নয়, অন্য শিশুরাও ট্রমার মধ্যে দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। তাদের মধ্যের ভয়টা কাটেনি। যেসব এলাকায় বেশি সংঘাত হয়েছে যেমন মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, আশুলিয়ার বাচ্চাদের ওপর এই প্রভাব অনেক বেশি। এখন তো কলেজগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়াচ্ছে। এই যে অস্থিরতা সেটাও তো একপ্রকার ট্রমাই। বিভিন্ন বয়সের শিশুদের মধ্যে এমনটা হচ্ছে।’
‘শিশুরা সহিংসতা দেখে শিখছে। তার যে সহপাঠী বা অন্যের প্রতি মমত্ববোধ সেটি কমে যাচ্ছে। একটা সময় তারা বড় ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বাবা-মায়ের ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’- অধ্যাপক এ. কে. এম. রেজাউল করিম
সহিংসতা দেখে শিখছে শিশুরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ. কে. এম. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত। তারা সেখানে বিভিন্ন সংবাদ বা তথ্য পায়। জ্বালাও-পোড়াও, মারামারি দেখলে তারা ট্রমাটাইজ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করতে পারে যে এ ধরনের ঘটনা তাদের সঙ্গেও ঘটে কিনা। যারা সহিংস আচরণ করছে তাদেরও তো সন্তান-পরিবার আছে, সেদিক বিবেচনায় তাদেরও সচেতন করতে হবে। তবে সামগ্রিকভাবে পরিবারের বড় ভূমিকা আছে। বাবা-মা সহিংস ঘটনা ও তার তথ্য থেকে যদি শিশুদের দূরে রাখতে পারেন, সেটি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে মানসিক স্বাস্থ্যে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশুরা কিন্তু অনুকরণ করে সহিংস হয়ে উঠতে পারে।’
সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। ফাইল ছবি
- আরও পড়ুন
- শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো আছে কি না বুঝবেন যেভাবে
- শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে
- কর্মক্ষেত্রে মা-বাবার মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাব শিশুর বিকাশে জরুরি
- ন্যাশনাল মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজে ব্যাপক হামলা-ভাঙচুর
মানসিক গবেষণার কথা উল্লেখ করে রেজাউল করিম বলেন, দুই দল শিশুর মধ্যে এক গ্রুপকে সহিংস অনুষ্ঠান দেখানো হয় এবং অন্য দলকে সহিংসতাহীন অনুষ্ঠান দেখানো হয়। সেখানে দেখা গেছে, যারা সহিংস অনুষ্ঠান দেখছে তারা একে অপরের সঙ্গে মারামারি করছে। ফলে তারা কিন্তু সেই সহিংস অনুষ্ঠান থেকে এসব শিখেছে। বাংলাদেশেও বর্তমানে সেই প্রেক্ষাপট হয়েছে। শিশুরা সহিংসতা দেখে শিখছে। তার যে সহপাঠী বা অন্যের প্রতি মমত্ববোধ সেটি কমে যাচ্ছে। একটা সময় তারা বড় ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই বাবা-মায়ের ভালোবাসা দিয়ে শিশুদের বোঝাতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে শিক্ষক সমাজকে বড় ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ তাদের কাছ থেকেই শিশুরা অনেক কিছু শিখে।’
‘বর্তমানে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সামনে কী ঘটবে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ তার পরিবার কিভাবে তাদের সাপোর্ট করছে। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের সতর্ক হতে হবে। শিশু কোনো ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। গণমাধ্যমেও সারাদিন অনেক নেতিবাচক বিষয় উঠে আসে যেগুলো শিশুদের মধ্যে প্রভাব ফেলে।’ সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার
মানসিক যে সমস্যায় পড়ছে শিশুরা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যখন কোনো ট্রমা দেখতে পাই, সেটার প্রভাব কম বা বেশি সবার ওপরই পড়ে। বেশি প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপর। এই প্রভাবটির একটি তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে। তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো ট্রমার দিন থেকে শুরু করে তিন-ছয় মাস থাকে। তীব্র মানসিক চাপ থাকে। ঘুমের সমস্যা, আতঙ্ক এবং কারো কারো বিষন্নতাও আসতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়াকে আমরা বলি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। পাশাপাশি ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে তার চিন্তা, আচরণ ট্রমা দ্বারা প্রভাবিত হয়। এটি তার আচরণ, পেশাগত জীবন ও পারিবারিক জীবনকে প্রভাবিত করে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের এখন চিন্তা ও আচরণের জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। সে পুলিশ মাত্রই মনে করছে তার প্রতিপক্ষ। ফলে আচরণগত পরিবর্তনের কারণেই তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে একটা ক্ষোভের জায়গা তৈরি হয়েছে। এটাকে সমাধান করা সম্ভব। আমাদের ফোকাস করতে হবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে।’
সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুরা যখন কোনো ধরনের সহিসংতার শিকার হয় বা সহিংসতা প্রত্যক্ষ করে তখন তার আচরণে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। সেটিই হচ্ছে। শূন্য থেকে ১৮ বছর পুরোটা বয়স শিশু বললেও এখানে ১৭ বছরের শিশু আর ৫ বছরের শিশু তো এক হবে না। তাদের মানসিকতা ভিন্ন। শিশুরা কিন্তু সবচেয়ে বেশি শিখে পরিবার থেকে, তারপর শিক্ষকের কাছে থেকে। এরপর আশপাশের পরিমন্ডল থেকে শিখে। বর্তমানে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সামনে কী ঘটবে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ তার পরিবার কিভাবে তাদের সাপোর্ট করছে। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের সতর্ক হতে হবে। শিশু কোনো ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে। গণমাধ্যমেও সারাদিন অনেক নেতিবাচক বিষয় উঠে আসে যেগুলো শিশুদের মধ্যে প্রভাব ফেলে। একটা মৃত্যুর খবর বা খারাপ খবর যতোটা বড় করে দেওয়া হয়, ভালো খবর কয়টি সেভাবে দেওয়া হয়। অনেক ভালো খবর থাকলেও সেগুলো অনেক সময় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হয় না।’
‘আমার ছেলে একদিন আন্দোলনের মধ্যে পড়েছিল। তখন ব্যাপক হুড়োহুড়ির মধ্যে সে একটি দোকানে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পায়। তখন তো আন্দোলন শুরুর দিকে বলা যায়। এরপর তো ঘরে বসেই অনেক গুলির শব্দ শুনেছে। এখন অনেকটা আতঙ্কিত থাকে সে। স্কুলে যেতে নানান টালবাহানা করে। তবু চেষ্টা করি বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়মিত স্কুলে পাঠাতে।’-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রের মা
ভূমিকা রাখতে হবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
আন্দোলনের পর থেকে বনশ্রীতে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া রাতুল (ছদ্মনাম) প্রায়ই স্কুলে যেতে চায় না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন তার মা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে একদিন আন্দোলনের মধ্যে পড়েছিল। তখন ব্যাপক হুড়োহুড়ির মধ্যে সে একটি দোকানে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পায়। তখন তো আন্দোলন শুরুর দিকে বলা যায়। এরপর তো ঘরে বসেই অনেক গুলির শব্দ শুনেছে। এখন অনেকটা আতঙ্কিত থাকে সে। স্কুলে যেতে নানান টালবাহানা করে। তবু চেষ্টা করি বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়মিত স্কুলে পাঠাতে।’
সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে অনেকটা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে ছিল শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতা কাঠামো শিশুদের আবেগ বা মানসিক অবস্থাকে বুঝতে পারেনি। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজেরা সংগঠিত হয়েছে। সেই মানসিক অবস্থা স্থায়ী রূপ নিলে বিপদ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাজধানীর ড. মাহবুবুর মোল্লা কলেজ ও অন্যান্য কলেজের ছাত্ররা গত ২৪ নভেম্বর সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজে হামলা চালায়। ফাইল ছবি
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যালয়ে কো-কারিকুলার ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম জোরদার করা, শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ও খেলাধুলার সরঞ্জাম দেওয়া, বিদ্যালয়ে পরিবেশ ক্লাব, ডিবেট ক্লাব ও স্বাস্থ্যসেবা ক্লাবের মতো প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, প্রাক-শৈশব শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া, শ্রেণিকক্ষে আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করে পাঠদান করা, শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার কর্মসূচি নেওয়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সু-সস্পর্ক বজায় রাখা, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নিয়মিত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। স্কুলে না যাওয়ার প্রবণতা ও পড়ালেখার প্রতি অনীহা বড় শঙ্কার কারণ বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে শিশুদের বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতনতা জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, শিশুদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ, পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া, পর্যাপ্ত খেলাধুলার উপকরণ সরবরাহ করা, অন্যান্য শিশু বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া, মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে মারামারি ও হিংস্রতা সম্পর্কিত গেম থেকে বিরত রাখা, যতদূর সম্ভব স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা রাখা, স্থানীয়ভাবে অনুষ্ঠিত খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা দরকার।
রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবু সাইদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্দোলনের পর শুরু থেকে আমাদের শিক্ষক, সাইকোলজিস্ট, দুইজন কাউন্সিলর বিভিন্ন সময় অ্যাসেম্বলিতে এবং ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করেন। আন্দোলনের পর এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেছি সবাই লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী আছে। শুরুর দিকেই আমরা শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাউন্সিলিং করেছি। আন্দোলনের পর যখন ক্লাস খুলেছে তখন দুই সপ্তাহ শুধু শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, আন্তহাউজ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মধ্যে তাদের যুক্ত রেখেছি। তারপর আমরা আস্তে আস্তে আমরা সিলেবাসভিত্তিক পড়াশুনার দিকে গেছি। সেজন্য আমাদের এখানে সেরকম কোনো সমস্যা নেই। বাচ্চারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিদিন ক্লাসে আসে। শিক্ষক, কর্মচারীসহ সবাই ওদের সঙ্গে এমনভাবে মিশেছে যার জন্য তারা স্বাভাবিক ব্যবহার করছে। ফাইনাল পরীক্ষা চলছে, শতভাগ উপস্থিতি আছে।’
আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহিংস আচরণ প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ বলেন, ‘মাঝেমধ্যে সেই আন্দোলনের জন্য তাদের উৎসাহ দেই। তবে এটাও বলি লোখাপড়াও করতে হবে। আমরা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাসগুলোতে বলেছি যে সবাই একই ইউনিফর্মের শিক্ষার্থী, কে কোন দলের বা তার পরিবার যে দলেরই হোক না কেন স্কুলে এলে সবাই শিক্ষার্থী। কারো প্রতি যেন বিদ্বেষ না থাকে। প্রথমদিকে একটু সমস্যা থাকলেও এখন সেটি নেই। ওরা বিষয়টি বুঝতে পেরেছে যে আমরা তাদের সঙ্গে সব সময় ছিলাম।’
এডুকো বাংলাদেশের পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার ও সিআরএসিবির ফোকালপারসন হালিমা আক্তার বলেন, ‘আন্দোলনে অনেক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। অনেকে হাত-পা হারিয়েছে। সুতরাং সামগ্রিকভাবে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে এই পরিস্থিতিতে যেসব বাচ্চা বুঝতে পারে কিছুটা, তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক সমস্যার সমাধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বড় একটি দায়িত্ব পালন করতে পারে। কারণ বাড়ির পর দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকছে শিক্ষার্থীরা। সেই জায়গা থেকে শিক্ষকরা যদি মানসিক উন্নতির জন্য শিশুদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও ট্রমা থেকে বের হওয়ার মতো কোনো কর্মকাণ্ডে সমৃক্ত করেন তাহলে ভালো হয়।’
‘এছাড়া বাবা-মা যদি শিশুদের গঠনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন, মানসিক সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তাদের সৃজনশীল কাজে যুক্ত করেন, সেটি ভালো ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি সরকারের একটা দায়িত্ব আছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারে। শিশুদের কল্যাণের জন্য কিছু সম্মিলিত কর্মসূচি নিতে পারে।’ বলছিলেন হালিমা আক্তার।
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ২৫ নভেম্বর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালায় এবং সেখানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ফাইল ছবি
সরকারের জোরালো ভূমিকা জরুরি
সাম্প্রতিক আন্দোলনের ফলে শিশুদের মধ্যে নানা প্রভাব পড়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে আচরণিক। শিশুদের এমন মানসিক চাপের বিষয়ে সরকারের নানান উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
- আরও পড়ুন
- দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৫৬ শিশু অপরিপক্বভাবে জন্মগ্রহণ করে
- হামলাকারীদের অনেকেই শিক্ষার্থী নয় বলে মনে হয়েছে
- ২ ঘণ্টায়ও থামেনি বুটেক্স ও ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ
- সোমবার ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা সোহরাওয়ার্দী-নজরুল কলেজ শিক্ষার্থীদের
তারা বলছেন, টেলিভিশনে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, বারবার পাঠ্যবই পরিবর্তন না করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, পাঠ্যক্রমে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ যুক্ত করা ও ‘ট্রমা কাউন্সেলিং’ কর্মসূচি আয়োজন করতে পারে সরকার।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক মিজ তানিয়া খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শিশু সপ্তাহে এবার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিশুদের সম্পৃক্ত করেছি। এবারের থিমে জুলাই বিপ্লবে শিশুদের যে আত্মত্যাগ, উদ্দীপনা, শিশুদের মানসিক ট্রমার বিষয়গুলো নিয়ে এসেছি। আমাদের সামনে আরো অনেক পরিকল্পনা আছে। উপদেষ্টা ও সিনিয়র সচিব নির্দেশনা দিয়েছেন শিশুদের জন্য যে যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো নিতে হবে। তাদের মানসিক সমস্যা সমাধানে যে সহযোগিতা প্রয়োজন আমরা করব। এই মুহূর্তে আমরা ১০৯ হটলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যেসব শিশু মানসিক চাপ অনুভব করছে, সেক্ষেত্রে তারা কী ধরনের সহায়তা চাচ্ছে সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা পরিকল্পনা পর্যায়ে আছি আরো কী কী করা যেতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু কর্মসূচি চলমান আছে।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের মধ্যে যে ধরনের সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে নানান কার্যক্রম চলছেই। কংক্রিট কিছু তো এখনই বলা সম্ভব না। তবে আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
আইএইচআর/এমএমএআর/এএসএম