দেরিতে কথা বলছে শিশুরা, বাড়ছে বাবা-মায়ের উদ্বেগ
মনিরুল ইসলাম ও সায়লা ইসলাম দম্পতির প্রথম সন্তান সাইমুম ইসলাম। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো সঠিকভাবে কথা বলতে পারে না সাইমুম। অথচ তিন বছর বয়সেই সাধারণ বাক্য ও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারার কথা শিশুটির।
শরিফ শিকদার ও নওশীন আক্তারের দ্বিতীয় সন্তান আবরার হোসেন। আবরারের বয়স তিন শেষে চারে গিয়ে পড়ল। অথচ এখনো কথা বলছে না সে।
এই শিশুরা ভাষা বিলম্ব বা স্পিচ ডিলে রোগে আক্রান্ত। দেরিতে কথা বলা শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে বাবা-মায়ের উদ্বেগ। প্রিয় সন্তানের মুখের ডাক শুনতে হাসপাতালে ছুটছেন বাবা-মা।
সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা) ও শিশু নিউরোলজি বিভাগের সামনে দেখা যায় সাইমুম ও আবরারকে। কথা হয় তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে।
সাইমুমরা থাকে রাজধানীর আজিমপুরে। তার বাবা মনিরুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি করেন। মা সংসার সামলান।
কেন কথা বলছে না সাইমুম? মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গ্রামে বড় হয়েছি একটি ভিন্ন পরিবেশে। কিন্তু ঢাকায় একক পরিবারে বাস করি। আমি চাকরি করি। স্ত্রী সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকে। ছেলেকে সঠিকভাবে সময় দেয়নি। আমার ছেলে সারাদিন কার্টুন দেখায় ব্যস্ত থাকে। এজন্য কথা বলতে পারে না। কিছু দরকার হলে ইশারা-ইঙ্গিতে বলে। মাঝে মধ্যে জেদ ও কান্নাকাটি করে। আমরা নিজেরাই সন্তানের এ অবস্থার জন্য দায়ী। এখন হাসপাতালে এসেছি, দেখা যাক কী হয়।’
একই হাসপাতালে এসেছিলেন শরিফ শিকদার, তার স্ত্রী নওশীন আক্তার ও দ্বিতীয় সন্তান আবরার হোসেন। আবরারের বয়স তিন শেষে চারে গিয়ে পড়ল। অথচ এখনো কথা বলছে না।
আবরাররা থাকে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকায়। ওর একটি বড় বোন আছে, নাম মাহিন। মাহিন একটু দেরিতে কথা বলেছিল। তাই আবরারের বাবা-মা মনে করছিলেন, সেও দেরিতে কথা বলবে। আশা আর সম্ভাবনার দুয়ারে কড়া নাড়তে নাড়তে একদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা। জানতে পারেন, আবরারের আচরণ, ভাষা ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশেও সীমাবদ্ধতা আছে। শুধু সন্তানের দেরিতে কথার বিষয়টি দেখতে গিয়ে আরও অনেক কিছুই খেয়াল করেননি তারা।
বিএসএমএমইউর শিশু নিউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. কানিজ ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে ভয়াবহভাবে স্পিচ ডিলে বেড়ে চলেছে। এজন্য প্রধানত দায়ী মোবাইল ফোন। পাঁচ বছরের আগে শিশুদের হাতে মোবাইল দেওয়া উচিত নয়। পাঁচ বছরের আগে শিশুরা এর সঠিক ব্যবহারও জানে না। বাবা-মা বাসায় থাকলেও কোয়ালিটি সময় দেয় না শিশুদের। শূন্য থেকে পাঁচ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে শিশুদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে।’
ডা. কানিজ ফাতেমা আরও বলেন, ‘তবে এখন মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে, সেটা হলো তিন বছরে কথা না বললে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু ফোনের কারণে শিশুদের যে স্পিচ ডিলে হচ্ছে অনেক বাবা-মা এটা জানেন না। অটিজমের কারণেও শিশুদের স্পিচ ডিলে হয়। তবে মোবাইল ফোনের কারণে ব্রেইনে শিশুদের সমস্যা হচ্ছে। ফলে এখন নিউরোলজি বিভাগে ১০০ রোগীর মধ্যে ১০ জনের স্পিচ ডিলে ধরা পড়ছে। সংখ্যাটা কিন্তু একেবারে কম নয়, ভয়াবহ। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদের সুস্থ পরিবেশে বড় করা।’
শিশুর ভাষাগত দক্ষতার মাইলস্টোন
একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, তখন পরিবারের সবার মনে এক অনাবিল আনন্দের আবির্ভাব হয়। ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে কি না, নাভি পড়ল কি না, কবে দাঁত উঠল, তাকালে হাসে কি না, কবে ঘাড় সোজা করে বসল, হাঁটি হাঁটি পা করে আদরের শিশু কবে একটা দৌড় দিয়ে কোলে আসবে তা নিয়ে যেন আগ্রহের কমতি নেই সবার। সবচেয়ে বেশি অধীর আগ্রহ নিয়ে যে বিষয়টি আনন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তা হলো শিশুর মুখের ভাষা।
সোসাইটি অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের (এসএসএলটি) সভাপতি ফিদা আল-শামসের তথ্যমতে, বিকাশের ধাপ অনুযায়ী একটি শিশু তার জন্মের চার-ছয় মাস বয়সের মাঝে আধো আধো বোলে মা, বা, উ, আ, ইত্যাদি ধ্বনি উচ্চারণ করা শুরু করে। নয় থেকে ১৮ মাস বয়সের মধ্যে প্রথম অর্থবোধক শব্দ বলা শুরু করে এবং মোটামুটি আট থেকে দশটি অর্থবোধক শব্দ বলতে পারে। শিশুর যখন ২৪ মাস বা দুই বছর বয়স তখন ৫০টির মতো শব্দ বলতে পারে। এর মধ্যেই শিশু দুই শব্দবিশিষ্ট ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করা শুরু করে। শিশুর মুখের হাসি আর সঙ্গে তাদের খেলায় সে মাতিয়ে রাখে গোটা পরিবার।
কিন্তু সব ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। এখন অনেক শিশুই দেরিতে কথা বলছে বা কথা বলতেই পারছে না। ভাষা বিলম্ব বা স্পিচ ডিলে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে আদরের শিশুরা। নানা কারণে এমনটি হচ্ছে। যেমন: বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারণে গৃহপরিচারিকার তত্ত্বাবধানে বড় হওয়া। এই সময় গৃহপরিচারিকা বাসার নানান কাজে ব্যস্ত থাকে আর শিশুটি মনের ভাব প্রকাশ করার মতো কোনো মানুষ খুঁজে পায় না। এমনকি কবুতরের খাঁচার মতো সারাদিন বহুতল ভবনের কোনো রুমে বন্দি অবস্থায় থাকে শিশু। ফলে সূর্যের আলোরও দেখা পায় না তারা।
বিষাক্ত পরিবেশের কারণে শিশুর কণ্ঠে সঠিক সময়ে নির্গত হয় না মা, বা, দা, উ, আ ইত্যাদি ধ্বনি। আর শিশুটিকে মগ্ন রাখার জন্য তার সামনে রাখা হয় টেলিভিশন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট পিসি। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোবাইল ফোন। পরিণতিতে এসব যন্ত্রের মাঝেই সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকে শিশুটি। এছাড়া জিনগত ত্রুটি, কানে কম শোনা, বিকাশজনিত বিলম্ব, মনোসামাজিক দৈন্যতা, অটিজমসহ বিভিন্ন স্নায়ু বিকাশজনিত বৈকল্যও শিশুর কথা না বলা অথবা দেরিতে কথা বলার পেছনে কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল।
প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে গড়ে ১৭ জন অটিজম স্প্রেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা এএসডিতে আক্রান্ত। এই শিশুদের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো দেরিতে কথা বলা। প্রতি ৫৮৯ শিশুর মধ্যে একজন এএসডিতে আক্রান্ত। অটিজমের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ছেলে শিশুরা, প্রতি ৪২৩ জনের মধ্যে একজন। অন্যদিকে প্রতি ১ হাজার ২৬ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন অটিজমের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে।
শহরের শিশুদের মধ্যে এএসডি বেশি
২০১৭ সালে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের আট বিভাগের ৩০ জেলায় জরিপ চালায় বিএসএমএমইউর ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম। এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহীন আখতারের নেতৃত্বে ‘অটিজম স্প্রেকট্রাম ডিজঅর্ডার অ্যামং সিক্সটিন টু থার্টিন মানথ চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ: অবজারভেশনাল ক্রস-সেকশনাল স্টাডি’ শিরোনামে জরিপ করা হয়। ৩৭ হাজার ৯৮২ পরিবার থেকে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশু এবং তাদের বাবা-মায়েদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে ৩৮ হাজার ৪৪০ জন শিশুর তথ্য নেওয়া হয়। শিশুদের মধ্যে ৭১ শতাংশ গ্রামের, ২৯ শতাংশ শহরের।
জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে গড়ে ১৭ জন অটিজম স্প্রেকট্রাম ডিজঅর্ডার বা এএসডিতে আক্রান্ত। এই শিশুদের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো দেরিতে কথা বলা। প্রতি ৫৮৯ শিশুর মধ্যে একজন এএসডিতে আক্রান্ত। অটিজমের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ছেলে শিশুরা, প্রতি ৪২৩ জনের মধ্যে একজন। অন্যদিকে প্রতি ১ হাজার ২৬ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে একজন অটিজমের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে।
গ্রামের তুলনায় শহরের শিশুদের মধ্যে এএসডির ব্যাপকতা বেশি। শহরে প্রতি ১০ হাজারে ২৫ জন ও গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন শিশু এএসডিতে আক্রান্ত।
অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং শিশুদের হাতে ডিভাইস তুলে দেওয়ায় এ সমস্যা প্রকট হচ্ছে। শহরের শিশুদের তেমন সময় দিতে পারেন না বাবা-মা। অন্যদিকে একক পরিবারে বড় হচ্ছে শিশুরা। যে কারণে শহুরে শিশুদের এএসডি সমস্যা বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামের বাবা-মায়েরা তুলনামূলক বেশি সময় দেন শিশুকে। দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনের সংস্পর্শ পায় গ্রামের শিশুরা। এছাড়া গ্রামের শিশুরা খেলার সঙ্গী বেশি পায়।
জরিপে দেখা গেছে, এএসডি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে ২৬ মাস থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে, প্রতি ১০ হাজারে এর সংখ্যা ২৪ দশমিক ৮১ জন। ২১ থেকে ২৫ মাস বয়সী প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে এএসডি ধরা পড়ে ১৪ দশমিক ৭১ জনের। অন্যদিকে ১৬ থেকে ২০ মাস বয়সী প্রতি ১০ হাজারে ১২ দশমিক ৬৫ জন শিশুর মধ্যে এএসডি সমস্যা রয়েছে।
বাংলাদেশ থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশনে ২০১৬-১৭ সালে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১৫০ জন শিশু রোগী ভর্তি হতো। ২০২৩-২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে মাসে ৩৫০ থেকে ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে।
গত ৮ বছরে ভাষা বিলম্বের সমস্যা আরও বেড়েছে
বিএসএমএমইউর ওই জরিপ ছিল ২০১৭ সালের। গত আট বছরে দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ায় শিশুদের মধ্যে ভাষা বিলম্বের সমস্যা আরও বেড়েছে। বিএসএমএমইউর শিশু নিউরোলজি বিভাগের বহির্বিভাগে বর্তমানে ১০০ জন চিকিৎসা নিলে তার মধ্যে ১০ জনের ভাষা বিলম্বের সমস্যা ধরা পড়ছে। ফলে হাজারে এই সংখ্যা শতাধিক।
একই চিত্র মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকের ১১ নম্বর রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশনে (বিটিআরএফ)। ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ১৫০ জন শিশু রোগী ভর্তি হতো। ২০২৩-২৪ সালে এ সংখ্যা বেড়ে মাসে ৩৫০ থেকে ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের সংখ্যাও বেড়ে ৪০০ জনে দাঁড়িয়েছে। অন্য রোগীর মতো ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে একজন স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে শিশুদের দেখানো যায়। এছাড়া শিশুদের সমস্যা বেশি হলে বিটিআরএফে দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা নেওয়া যায়।
‘আমরা খোলামেলাভাবে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। অথচ আমার মেয়েকে সময় দেওয়ার কেউ নেই। আমরা নিজেরাই মেয়ের জন্য বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছি। যে কারণে মেয়ে আমার ফোনে আসক্ত। সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকে, কথা বলে না। ফোন না দিলে হাত-পা ঝাপটায়।’- মুস্তাকিন আলম
ভাষা বিলম্ব সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগেও। গত ১৩ নভেম্বর এই বিভাগের সামনে দেখা গেছে দীর্ঘ সারি। সেই সারিতে ফুটফুটে এক মেয়েকে কোলে নিয়ে মন ভার করে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বাবা। বাবার কাঁধে মাথা রেখে একবার এপাশ, আরেকবার ওপাশ করছিল শিশুটি।
বাবার নাম মুত্তাকিন আলম। গাজীপুরের মাওনা থেকে হাসপাতালে এসেছেন মেয়ে রুকাইয়াকে নিয়ে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও কথা বলতে পারে না শিশুটি। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে দেরিতে কথা বলা রোগে ভুগছে।
একক পরিবারে মুত্তাকিন আলমের বসবাস। মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। সংসার চালাতে ছোট ব্যবসা করেন স্ত্রী। ফলে রুকাইয়াকে সময় দিতে পারেন না তারা। রুকাইয়ার একমাত্র সঙ্গী মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় কার্টুন দেখে সে। অন্যদিকে বাবা-মা বাংলায় কথা বলেন। তিনটি ভাষার কোনোটিই আয়ত্ত করতে না পারায় রুকাইয়ার ভাষা বিলম্ব বা স্পিচ ডিলে দেখা দিয়েছে। কোনো কথাই বলতে পারে না সে।
মুস্তাকিন আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর। আমরা খোলামেলাভাবে যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। অথচ আমার মেয়েকে সময় দেওয়ার কেউ নেই। আমরা নিজেরাই মেয়ের জন্য বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছি। যে কারণে মেয়ে আমার ফোনে আসক্ত। সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকে, কথা বলে না। ফোন না দিলে হাত-পা ঝাপটায়। মেয়ের জন্য আমরাই বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করেছি। ডাক্তার বলেছেন, সারতে সময় লাগবে। মেয়ের জন্য দরকার হয় গ্রামে চলে যাবো।’
একই হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সামনে কথা হয় আরিফুল ইসলাম ও সাবিনা খাতুন দম্পতির সঙ্গে। তাদের জন্মস্থান মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায়। চাকরির সুবাদে থাকেন মিরপুরের পল্লবী এলাকার ১৩ তলা ভবনের ১০ তলার একটি ফ্ল্যাটে। বিয়ের চার বছরের মাথায় ফুটফুটে একটি ছেলে হয় তাদের। আদর করে নাম রাখেন আইমান ইসলাম। কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং তার। দেখতে আসতো অনেক মানুষ।
হঠাৎ আরিফুল ও সাবিনা খেয়াল করলেন, তাদের সন্তান কথা বলে না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে হয় হাত ধরে টানে, না হয় অন্য কোনো ইশারায় মনের কথা বোঝায়। বয়স আড়াই বছর হলেও বাবা-মা ডাক শুনতে পারেননি তারা। এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এই দম্পতি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড নিউরোরিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের স্পিচ থেরাপিস্ট শেখ মোহাম্মদ সেলিম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নানান কারণে শিশুদের স্পিচ ডিলে হয়। তবে এর মধ্যে অন্যতম এনভায়রনমেন্টাল কজেজ। আমরা শিশুদের সময় দেই না। শিশু সারাদিন ফোনে পড়ে থাকে। এটা শিশুর জন্য এক ধরনের বিষাক্ত পরিবেশ। এই পরিবেশ থেকে শিশুদের বের করে একটা সঠিক পরিবেশে বড় করতে হবে। শিশুদের বাইরে নিয়ে যেতে হবে, ফোন দেওয়া যাবে না। শিশুদের সঙ্গে বেশি করে কথা বলতে হবে, তাদের নানা বিষয় হাতে-কলমে চেনাতে হবে। একটি সুস্থ পরিবেশ শিশুদের উপহার না দিলে তার মননের কোনো বিকাশ ঘটবে না।’
নারীদের তুলনায় পুরুষের মাঝে এবং শহর এলাকার তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় প্রতিবন্ধিতা ও ফাংশনাল ডিফিকাল্টি দুটোই বেশি। শিশুদের বিশেষ করে যোগাযোগ ও মনে রাখার ক্ষেত্রে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের হাঁটা, মনে রাখা ও যোগাযোগের ফাংশনাল ডিফিকাল্টি রয়েছে।
ভাষা বিলম্বে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা
২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ-২০২১’ এর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দেশের জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধিতা নিয়ে বসবাস করে। একই সঙ্গে ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ ব্যক্তি ফাংশনাল ডিফিকাল্টি নিয়ে বাস করছে।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ। এর মধ্যে ২ দশমিক ৮০ শতাংশ হিসাব করলে ৪৬ লাখ প্রতিবন্ধী, যাদের অন্তত এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, মোট ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।
নারীদের তুলনায় পুরুষের মাঝে এবং শহর এলাকার তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় প্রতিবন্ধিতা ও ফাংশনাল ডিফিকাল্টি দুটোই বেশি। শিশুদের বিশেষ করে যোগাযোগ ও মনে রাখার ক্ষেত্রে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের হাঁটা, মনে রাখা ও যোগাযোগের ফাংশনাল ডিফিকাল্টি রয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতা, একাধিক প্রতিবন্ধিতা এবং দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তির বৈকল্য প্রভৃতি প্রতিবন্ধিতার উল্লেখযোগ্য ধরন।
বিবিএস জানায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্ধেকই আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবিহীন এবং তাদের খুব অল্পই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। বয়সের ভিত্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় গড়ে ২ দশমিক ৩৮ বছর পিছিয়ে থাকে।
২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিবন্ধীর মধ্যে স্পিচ ডিজঅ্যাবিলিটির হার শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়ে শিশুর হার শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ এবং ছেলে শিশুর হার শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ।
বিবিএসের ২০১৫ সালের তথ্যমতে, দেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বড় অংশের কথা বলা সংক্রান্ত সমস্যা এবং ৬ শতাংশের অটিজম প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। তাদের সবার কথা, ভাষা ও সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া অন্য প্রতিবন্ধিতা (যেমন শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা) মিলিয়ে বাকি ৮১ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষের একটি অংশের কথা, ভাষা, সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা এবং খাবার গলাধঃকরণ জাতীয় সমস্যা থাকতে পারে।
২০২৩ সালের ১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
বৈশ্বিক ধারণা অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী পাঁচ কোটি ২৯ লাখ শিশুর বিকাশজনিত অক্ষমতা রয়েছে এবং তাদের ৯৫ শতাংশই নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে বাস করে। উপযুক্ত সহযোগিতা ও সুবিধাজনক পরিবেশ না পাওয়ায় শিশুর বিকাশে সমস্যা হচ্ছে।
শিশুর কথা বলার ক্ষমতা তৈরিতে বেশ কিছু ধাপ শুরু থেকেই থাকা উচিত। প্রথম থেকেই শিশুকে সময় দিতে হবে। তার সামনে বেশি বেশি কথা বলতে হবে, খেলতে হবে। শিশুদের সামনে অবশ্যই খুব সহজ বক্তৃতা এবং ভাষার দক্ষতা তৈরি হয় এমন কাজ করতে হবে।
গ্যাজেটে বাড়ছে ভাষা বিলম্ব
গ্যাজেট কীভাবে শিশুদের ভাষা শেখায় প্রতিবন্ধিতা তৈরি করে তার ওপর একটি গবেষণা করেন ইন্দোনেশিয়ার নেগেরি মেদান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অ্যামেলিয়া গ্রাসেলা পাসারিবু, উসনাদি উসনাদি ও মুহাম্মদ তাকউয়িন মাসমুদ। তাদের গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘ইমপ্যাক্ট অব গ্যাজেট ইউজ অন স্পিচ ডিলে: কেস স্টাডি অব টডলার্স ইন তানজাং গুস্তা ভিলেজ’। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এ গবেষণা প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এডুকেশনাল প্রাকটিস অ্যান্ড পলিসিতে।
গ্যাজেট হচ্ছে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র। মোবাইল, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ, ট্যাবলেট পিসি, ভিডিও গেম এই গ্যাজেটের মধ্যে পড়ে। গবেষণায় উঠে আসে, ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যার ১৪২ শতাংশই গ্যাজেট ব্যবহারকারী। যার অর্থ ইন্দোনেশিয়ার ২৬ কোটি ২০ লাখ লোকের মধ্যে ৩৭ কোটি ১৪ লাখ গ্যাজেট ব্যবহারকারী রয়েছে।
প্রতিটি বাসিন্দা গড়ে ১ দশমিক ৪টি টেলিফোন ব্যবহার করে। একজন ব্যক্তি কখনও কখনও এক থেকে দুটি গ্যাজেট ব্যবহার করে। এ কারণেই মূলত মানুষের চেয়ে গ্যাজেটের সংখ্যা বেশি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, গ্যাজেটের অত্যধিক ব্যবহারের প্রভাবে ভাষা বিলম্বের সমস্যায় পড়ছে শিশুরা। যেসব শিশু গ্যাজেটের স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় কাটায়, তারা ভাষা বিলম্বসহ নানা সমস্যায় পড়ছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মৌখিক মিথস্ক্রিয়া, খেলা ও হাতে-কলমে শিক্ষা শিশুর বিকাশের জন্য অপরিহার্য। শিশুর কথা বলার ক্ষমতা তৈরিতে বেশ কিছু ধাপ শুরু থেকেই থাকা উচিত। প্রথম থেকেই শিশুকে সময় দিতে হবে। তার সামনে বেশি বেশি কথা বলতে হবে, খেলতে হবে। শিশুদের সামনে অবশ্যই খুব সহজ বক্তৃতা এবং ভাষার দক্ষতা তৈরি হয় এমন কাজ করতে হবে। শিশু যদি এসব বিষয় না বোঝে তবে তার সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। এজন্য একটি পরিবেশ দরকার। পরিবেশ থেকে আসা বিভিন্ন শব্দ শিশু অনুকরণ করে এবং একটি কথা বলার ক্ষমতাও চলতে থাকে। এরপরে শিশুটি ধীরে কিছু সংক্ষিপ্ত শব্দ যা বোঝা যায়, তারপর বেশ কয়েকটি সহজ শব্দ একত্রিত করতে সক্ষম হতে শুরু করে। ভাষা এবং কথা বলার দক্ষতা, অবশেষে শিশু সম্পূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়।
শিশুদের পর্যবেক্ষণ, মনোযোগ, কল্পনা, মূল্যায়ন এবং তাদের চিন্তার বিকাশে গ্যাজেট সরাসরি প্রভাবিত করে। শিশুরা গ্যাজেট নিয়ে খেললে শান্ত হয় এবং অন্য লোকদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না, যা তাদের ভাষা দক্ষতা বাধাগ্রস্ত করে। তাদের আচরণ গ্যাজেটগুলোর নানান খেলার ওপর নির্ভর করে। গ্যাজেট আসক্তি শিশুদের স্পিচ বিলম্বের ওপর প্রভাব ফেলে।
গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়, শিশুর মধ্যে ভাষা বিলম্ব সমস্যা বাড়ছে। শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে শিশুর দক্ষতা, ভাষা এবং বিলম্বে সামাজিক আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ১২ থেকে ১৬ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ২৪ শতাংশ, আর্জেন্টিনায় ২২ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৩ থেকে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি শিশুর বিকাশই বিশেষ এবং ভিন্নতা রয়েছে। শিশুর বিকাশ হলো শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিপক্বতা, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (সিএনএস)। একটি শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো প্রথম তিন বছর, যখন বিকাশ দ্রুত হয় এবং শিশুর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেয়। পরোক্ষভাবে গ্যাজেট শিশুদের বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিশুরা প্রায়শই পাঠের চেয়ে গ্যাজেটে বেশি মনোযোগী হয়। ফলে পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। লেখালেখিতে অলস হয়ে পড়ে। কারণ শিশুরা অন্য ক্রিয়াকলাপের তুলনায় প্রায়ই ইউটিউব দেখে। এই শিশুরা কম সামাজিক হয়ে ওঠে। কারণ পরিবেশ এবং অন্য মানুষের সঙ্গে তাদের মেলামেশা কম হয়। শিশুদের মধ্যে গ্যাজেট নির্ভরতা বাড়ে। অতিরিক্ত গ্যাজেট ব্যবহারের ফলে মস্তিস্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শৈশবে জ্ঞানের বিকাশ ব্যাহত হয়। কারণ শিশুরা খুব কমই অধ্যয়ন করে। শিশুদের পর্যবেক্ষণ, মনোযোগ, কল্পনা, মূল্যায়ন এবং তাদের চিন্তার বিকাশে গ্যাজেট সরাসরি প্রভাবিত করে। শিশুরা গ্যাজেট নিয়ে খেললে শান্ত হয় এবং অন্য লোকদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না, যা তাদের ভাষা দক্ষতা বাধাগ্রস্ত করে। তাদের আচরণ গ্যাজেটগুলোর নানান খেলার ওপর নির্ভর করে। গ্যাজেট আসক্তি শিশুদের স্পিচ বিলম্বের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি একটি গুরুতর সমস্যা।
এজন্য অবিলম্বে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট চিকিত্সকের কাছে যাওয়া উচিত। কারণ এটি একটি বড় প্রভাব ফেলবে, যা শিশুর জ্ঞানীয় ক্ষমতা এবং বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়।
অন্য যেসব কারণে দেরিতে কথা বলে শিশুরা
পরিবেশগত কারণে শিশুরা সঠিক সময়ে কথা বলতে পারছে না। এজন্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছাড়াও খাদ্য ও বাতাসে অতিরিক্ত সিসা দায়ী বলে দাবি শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞদের। এছাড়া নানা কারণে শিশুরা দেরিতে কথা বলে।
সেরিব্রাল পালসির কারণে অনেক শিশু জন্মের সময় কান্না করে না। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যায়। ফলেও শিশুদের কথা বলতে দেরি হয়।
ডাউন সিনড্রোমের কারণে শিশুর শরীর তুলতুলে থাকে। ফলে এই শিশুদের বুদ্ধি হয় না, হাঁটা, বসা, চলাফেরা করতে পারে না এবং তারা কথাও দেরিতে বলে।
অটিজমের কারণে শিশুরা বসতে বা চলতে পারে না। অনেক সময় আচরণগত অসুবিধা দেখা যায়। ফলেও শিশুরা দেরিতে কথা বলে। অনেক শিশুর জন্মের পর জিহ্বা বড় থাকে। ফলে শিশুরা কথা বলতে পারে না।
স্কুলে ভর্তির আগেই স্মার্টফোনে আসক্ত ৮৬ শতাংশ শিশু
বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশুর মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে চারজনই সন্তানের স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে জানেন না।
তিন-পাঁচ বছরের ৪০০ প্রি-স্কুল শিশুর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার মূল প্রবন্ধটি গত বছর এলসভিয়েরের ‘জার্নাল অব ইফেক্টিভ ডিসঅর্ডার’-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার ফলাফল নিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক, সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন ও আর টি এম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ফারুক আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল গবেষণা কর্মটি পরিচালনা করেছে।
মা-বাবার প্রতিদিনের স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাত্রা তাদের সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তির কারণ। কেননা যেসব মা ও বাবা প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, খেলার মাঠের অভাবে ৫২ শতাংশ ও খেলার সাথীর অভাবে ৪২ শতাংশ শিশু স্মার্টফোনের দিকে আসক্ত হচ্ছে। ৭৯ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু কার্টুন বা কল্পকাহিনি দেখার জন্য, ৪৯ শতাংশ গেম খেলার জন্য, ৪৫ শতাংশ শিশু টেলিভিশন/ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অন্যদিকে, শুধু ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যায়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নির্বাচিত ৪০০ শিশুর প্রত্যেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ তাদের বাবা-মায়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে।
এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক সুপারিশ করা সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুণ।
অভিভাবকরা কেন সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন—এই প্রশ্নের জবাবে, ৭৩ শতাংশ মা বলেছেন, তারা তাদের শিশুদের স্মার্টফোনের সঙ্গে ব্যস্ত রাখতে চান, যাতে তারা তাদের কাজ বিনা বাধায় করতে পারেন। ৭০ শতাংশ মা তাদের শিশুদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ৬৭ শতাংশ মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য এবং ৩১ শতাংশ মা শিশুকে ঘুম পারানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মা-বাবার প্রতিদিনের স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাত্রা তাদের সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তির কারণ। কেননা যেসব মা ও বাবা প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। পেশাজীবী মায়ের বাচ্চারা অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে, কেননা তারা তাদের সন্তানদের প্রয়োজন অনুসারে সময় দিতে পারছেন না। পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থান ও প্রি-স্কুল শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তির কারণ। অধিক আয়ের পরিবারের (মাসিক ২৫০০০ টাকা বা তার বেশি) বাচ্চারা অধিক হারে স্মার্টফোনে আসক্ত।
১০ বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৭ গুণ
দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত ১০ বছরে সাত গুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালে যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। পরিবার পর্যায়ে মোবাইল ফোনে ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করে ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া ইন্টারনেট ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ, স্মার্টফোন ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ, রেডিও ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ, টেলিভিশন ৬২ দশমিক ২ শতাংশ এবং কম্পিউটার ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ল্যান্ডফোন ব্যবহার করে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পরিবারের লোকজন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহার জরিপ-২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গত বছরের ১৭ জুলাই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত পরিসংখ্যান ভবনে এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
যেখানে শিশুর ভাষা বিলম্বের চিকিৎসা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল, বিএসএমএমইউর ইপনা, বাংলাদেশ থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশনে দেরিতে কথা বলা শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এছাড়া সরকারিভাবে জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩৪টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র আছে।
‘দুই বছর পার হয়ে গেলো, সন্তান কোনো কথা বলে না। শিশু ফোনে আসক্ত। ফোন না দেখালে পেটে একটা দানাও দেওয়া যায় না। এখন কী করবো ভেবে পাচ্ছি না।’- শামীম হোসেন
শিশুর মুখের ভাষা ফেরাতে স্পিচ থেরাপি
একজন ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক চিন্তার জগৎ ফুটে ওঠে তার কথা, ভাষা ও লেখনীর মাধ্যমে। ব্যক্তির যদি এই মাধ্যমগুলোর এক বা একাধিক ক্ষেত্রের বিকাশ না ঘটে বা বিভিন্ন কারণে যেমন দুর্ঘটনা, বিপর্যয় বা রোগের কারণে তা হারিয়ে ফেলেন; তখন একজন দক্ষ স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়। তিনি শিশুর বিকাশ এবং ব্যক্তির যোগাযোগ দক্ষতা পুনরায় অর্জনের জন্য সমস্যার ধরন, অবস্থা ও প্রকৃতি নির্ণয় করে মৌলিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং সহায়ক ও বিকল্প উপায়ে যোগাযোগে স্বনির্ভর এবং কর্মক্ষম করে তোলেন।
শিশুর মুখে প্রথম মা-বাবা ডাক শুনতে অধীর প্রতীক্ষায় থাকেন বাবা-মায়েরা। একটি শিশুর বয়স দুই বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু সে অর্থবোধক কোনো কথা বলছে না, তাহলে চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় বাবা-মায়ের। তেমনি একজন বাবা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম হোসেন। একমাত্র সন্তান আহনাফ হোসেন কথা বলতে পারছে না বলে তিনি একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের শরণাপন্ন হয়েছেন।
শামীম বলেন, ‘দুই বছর পার হলো, সন্তান কোনো কথা বলে না। বাচ্চা ফোনে আসক্ত। ফোন না দেখালে পেটে একটা দানাও দেওয়া যায় না। এখন কী করবো ভেবে পাচ্ছি না।’
স্পিচ থেরাপি দিতে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশ থেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ফাউন্ডেশনে এসেছেন মাইদুর রহমান ও শাহিন আক্তার। তারা দুজনই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, জন্মস্থান ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায়। থাকেন ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে। অফিস করেন মতিঝিল এলাকায়। সকাল ৮টায় বাসা থেকে বের হন। অফিস শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক সময় রাত ৮টা থেকে ১০টা বেজে যায়। ফলে দীর্ঘ সময় বাসার দুজন গৃহপরিচারিকার কাছেই বেড়ে উঠছে তাদের একমাত্র সন্তান মুত্তাকিনুর রহমান।
শিশুর বয়স যখন দেড় বছর তখন থেকেই বাবা মাইদুর খেয়াল করলেন যে তাদের সন্তান কথা বলে না। নানা জিনিসের বায়না ধরে প্রচণ্ড জিদ করছে। ছেলের এ অবস্থা দেখে চাকরিই ছেড়ে দিলেন শাহিনা আক্তার। তিনি ভাবছেন বাড়িতে নিজেরা বেশি সময় দিলেই শিশু হয়তো কথা বলবে। একটি শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রেও সন্তানকে দেওয়ার কথা ভাবছেন এই দম্পতি। যদি অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে কথা শিখে যায়। প্রতিদিন নিয়ম করে স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে শিশুকে নিয়ে আসছেন এই দম্পতি।
বিটিআরএফে শিশুদের মুখের ভাষা ফেরাতে কাজ করছেন ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট আনিকা তাসনিম অমি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা শিশুকে সঠিকভাবে সময় দিচ্ছি না। আগে যৌথ পরিবারে শিশুরা মানুষ হতো, এখন একক পরিবার বেড়ে গেছে। আমরা শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাই না, সময়ও দেই না। আমরা সবাই ডিভাইসের প্রতি আশক্ত হয়ে পড়েছি।’
‘শিশুদের সময় দেওয়ার মানে এটা নয় যে বই দেখিয়ে পড়ালাম, এটা আম, এটা ক ইত্যাদি। সময় দেওয়া মানে শিশুকে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে, কীভাবে আমরা বাজার করি, কীভাবে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে থাকি, এগুলো দেখাতে হবে। ভ্যান থেকে কীভাবে সবজি কিনে থাকি, খোলা মাঠে কীভাবে জগিং করছি। এগুলো বাচ্চা দেখলে তারাও জানবে এভাবে ব্যায়াম করা যায়। পরিবেশটা বোঝাতে পারবে। আগে শিশুরা খোলা মাঠে খেলতো কিন্তু এখন প্লে গ্রাউন্ডে দিয়ে দিচ্ছি। ফলে এত রাইডস হয়, শিশুরা সঠিকভাবে খেলতে পারে না। এতে তাদের মনোজগৎ সঠিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। শিশুকে সঠিকভাবে সময় না দেওয়ায় তাদের মনন বিকশিত হচ্ছে না।’
আনিকা তাসনিম অমি বলেন, ‘দেড় থেকে দুই বছর বয়সে একটি শিশুর ৫০ শব্দ শেখার কথা। কিন্তু এটা শিখছে না। শিশু বিভিন্ন ডিভাইসে আশক্ত হয়ে পড়ছে। সঠিকভাবে তাদের আই কন্ট্রাক্ট হচ্ছে না। নাম ধরে ডাকলেও রেসপন্স করছে না।’
শিশু বসতে শিখলেই ধরিয়ে দিচ্ছি ডিভাইস
নিউরো ডেভেলপমেন্টস ডিজঅর্ডার ও অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. তোশিবা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিশুদের দেরিতে কথা বলার ঘটনা বর্তমানে বাড়ছে। শিশু যখন বসতে শেখে তখন তার হাতে আমরা ডিভাইস ধরিয়ে দিচ্ছি। শিশু মোবাইলে আনন্দ পাচ্ছে, মিক্সড ভাষা শিখছে। মোবাইলে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা শিখছে। অন্যদিকে বাবা-মা বাংলায় কথা বলছেন। এতে শিশুর ব্রেইন কাজ করে না। ফলে তারা কথা বলতে পারছে না।’
‘আমরা ইট-কাঠের শহরে শিশুকে সময় দিচ্ছি না। শিশু তার মতো করে ডিভাইসে পড়ে থাকছে। অন্যদিকে মা-বাবা রিলাক্সে থাকছেন। এতে শিশুর প্রকৃত বিকাশ হচ্ছে না। শিশুকে স্মার্ট বানাতে মা-বাবা চান, শিশু যাতে ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় কথা বলে। এতে শিশুকে বাহ্বা দেন তারা। এটা কিন্তু শিশুর জন্য ভালো নয়। তাদের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে। শিশুকে বেশি বেশি সময় দিতে হবে।’
ডা. তোশিবা রহমান আরও বলেন, ‘শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে তখন কিছু চেকআপ প্রয়োজন হয়। মায়ের গর্ভে শিশুর বয়স যখন ৮ মাস, তখন সে কিছুটা শুনতে পায়। মায়ের কিছু অভ্যাসগত কারণ যেমন ধূমপান ও অ্যালকোহলে শিশুর শ্রবণ সমস্যা হয়। এছাড়া শিশুদের তালুকাটা থাকে। জিহ্বার নিচের অর্গান লাগানো থাকে। সেই ক্ষেত্রে জিহ্বা বের করতে পারে না। তখন কথা বলতে সমস্যা হয়। এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশগত কারণ যেমন: ভেজাল খাদ্য ও বাতাসে সিসার উপস্থিতি বেশি থাকলেও বাচ্চা দেরিতে কথা বলে।’
শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সটি গুরুত্বপূর্ণ সময়
সোসাইটি অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টের সভাপতি ফিদা আল-শামস জাগো নিউজকে বলেন, ‘মা-বাবার যতটুকু সময় দেওয়া দরকার, গ্যাজেটের কারণে হোক বা কর্মব্যস্ততার কারণে হোক সেই সময়টুকু দিচ্ছেন না। শূন্য থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সময় শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই সময়ে শিশুরা ভাষা শেখার সঠিক পরিবেশ পাচ্ছে না। ফলে শিশুর ক্ষেত্রে ভাষা বিলম্ব বা বৈকল্য দেখা দিচ্ছে। এমনকি আমাদের কাছে এমন তথ্যও আছে সারাদিন শিশু ঘরের মধ্যে বন্দি থাকে। সূর্যের আলোর দেখাও পায় না।’
ফিদা আল-শামস আরও বলেন, ‘শিশু সঠিক সময়ে কথা না বললে একজন স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। অনেক শিশু আছে পরিবার থেকে ভাষার শিক্ষাটা পাচ্ছে না। অনেক শিশু খেলার উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না। শহরের অনেক শিশু অবকাঠামোগত কারণ ও পরিবারের সদস্যদের সময়ের অভাবে সঠিকভাবে খেলার পরিবেশ পাচ্ছে না। খেলার মাধ্যমে শিশুরা শিখতে পারে কিন্তু বর্তমানে এটা বিঘ্নিত হচ্ছে।’
‘বর্তমানে পরিবারগুলোতে শিশুদের সুস্থ পরিবেশ নেই। এক ধরনের বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সবাই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করতে চায়। ফলে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রতিবেশীরাও ব্যস্ত।’- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির
ফিরে যেতে হবে সহজ-সরল জীবনে
সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ নিজেদের একটা ফ্রেমে বন্দি করে ফেলছে যে এর নিচে যাওয়া যাবে না। হলিডে পালন করতে রিসোর্টে যেতে হবে, জন্মদিনের পার্টিতে এত টাকার পোশাক কিনতে হবে, সবাই আনহেলদি ফ্রেইম তৈরি ফেলেছে। ফলে টাকার প্রতি আসক্ত বাড়ছে। চাহিদা পূরণে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী। সবাই টাকার পেছনে ছুটছেন। সন্তানদের শুধু মৌলিক চাহিদা পূরণ করলেই হবে না, তাদের সঙ্গে গুণগত সময় দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এটা হচ্ছে না। সামাজিকীকরণ হারিয়ে যাচ্ছে। সেই চেনা প্রতিবেশী, সেই অরণ্য, সেই খেলার মাঠ নেই। বাবা-মায়ের সময় না দেওয়া, গ্যাজেটে আসক্ত এবং শিশুদের বাইরে ঘুরতে না নিয়ে গিয়ে চার দেওয়ালের মধ্যে সব সময় এক ধরনের বন্দি করে রাখা হয় শিশুদের। ফলে শিশুরা একটা অসুস্থ পরিবেশে বড় হচ্ছে। এটাকে এক ধরনের বিষাক্ত পরিবেশ বলেও অভিহিত করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে শিশুদের বের করতে হলে হারানো দিনে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে পরিবারগুলোতে শিশুদের সুস্থ পরিবেশ নেই। এক ধরনের বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সবাই স্ট্যান্ডার্ড লাইফ লিড করতে চায়। ফলে আমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। প্রতিবেশীরাও ব্যস্ত। আগে দলে দলে একে অপরের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসতো। ফলে সবাই মিলে একটা দারুণ আড্ডা হতো। আড্ডায় শিশুদের সামনেও নানা ধরনের কথা বলা হতো। এতে শিশুদের ভাষা শেখায় উপকার আসতো। এখন কিন্তু আত্মীয়-স্বজন আগের মতো আসে না। সবারই সময়ের অভাব। সামাজিকীকরণ আগের মতো নেই, বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। একক পরিবার বাড়ছে। যৌথ পরিবার দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। পরিবার থেকে শিশুদের কথা শোনার ভূমিকা কমে যাচ্ছে। তাহলে শিশুরা কীভাবে ভাষা শিখবে?’
রাশেদা ইরশাদ নাসির আরও বলেন, ‘বর্তমানে ডিভাইস ব্যবহার বেশি। শিশুরা এখন ডিভাইসে ছড়া বলে। অথচ আমরা ছোট বেলায় সহপাঠীদের সঙ্গে ছড়া বলতাম। শিশুরা এখন একা একা বড় হচ্ছে। ফলে শিশুরা কথাও দেরিতে বলছে। আমাদের আবারও সহজ-সরল জীবনে ফিরে যেতে হবে। তাহলে শিশুদের জন্য সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ পাবে।’
সন্তানদের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতে সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. রওশন আরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবা-মা যেন সন্তানকে সঠিক পরিবেশে বড় করে এজন্য আমরা সচেতনতামূলক কাজ হাতে নেবো। একটা চলমান প্রকল্পের আওতায় এ কাজ করা হবে।’
এমওএস/এমএমএআর/জিকেএস