যেসব অভিযোগে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ মোট চারটি অপরাধের দায়ে জামায়েতের আমির মতিউর রহমান নিজামী মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আপিল বিভাগের রায়ে নিজামীকে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন এবং তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় বলে জানান আদালত।
ট্রাইব্যুনালে চার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, চারটিতে যাবজ্জীবন এবং আরও তিনটি অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে অন্যান্য অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি প্রসিকিউশন।
প্রমাণিত অভিযোগের মধ্যে ৩টিতে মৃত্যুদণ্ড ও ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তিনটি অভিযোগ থেকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
ট্রাইব্যুনালে যে চার অভিযোগে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো :
২) নম্বর অভিযোগ : সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামে প্রায় সাড়ে ৪’শ মানুষকে গণহত্যা ও প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ।
৪) নম্বর অভিযোগ : করমজা গ্রামে ১০ জনকে গণহত্যা, একজনকে ধর্ষণসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
৬) নম্বর অভিযোগ, ধুলাউড়ি গ্রামে ৫২ জনকে গণহত্যা এবং ১৬ নম্বর অভিযোগ, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির দায়ে নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
অন্য চার অভিযোগে দায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়:
১) নম্বর অভিযোগ, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে হত্যা।
৩) নম্বর অভিযোগ, মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র।
৭) নম্বর অভিযোগ, বৃশালিখা গ্রামের সোহরাব আলী হত্যা এবং ৮ নম্বর অভিযোগ, বদি রুমী ও জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচণার দায়।
যেসব অভিযোগ থেকে খালাস পান নিজামী :
৫, ৯ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে ১, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগ থেকেও খালাস পান নিজামী।
রায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলেন, ১৯৭১ এ নিজামী ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি। ছাত্রসংঘই পরে আলবদর বাহিনীতে পরিণত হয়, আর গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মিলে জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবী নিধন চালায়।
আলবদর বাহিনীর অপরাধ ও কৃতকর্মের দায়-দায়িত্ব নেতা হিসেবে নিজামীর ওপর বর্তায়। রায়ে বলা হয়, এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে, স্বাধীনতার সক্রিয় বিরোধিতাকারী এমন এক ব্যক্তিকে এই রাষ্ট্রের মন্ত্রী করা হয়েছিল। তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা দুই লাখ নারীর গালে সরাসরি চপেটাঘাত।
এ ধরনের লজ্জাজনক কাজ গোটা জাতির জন্য অবমাননাকর। ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) আব্দুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনা আপিলের রায় গত ৬ জানুয়ারি ঘোষণা করেছে আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জনাকীর্ণ আদালতে জামায়াতের এ শীর্ষ নেতার বিষয়ে রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ প্রকাশ করেন।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এবিষয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনারা দুই মাসও এদেশে অবস্থান করতে পারত না, যদি না তাদেরকে আলবদর ও তাদের সহযোগীরা সহযোগিতা করত।
তিনি বলেন, আমরা বিচারের নামে তামাশা চাই না। কারণ এই মানবতবিরোধী অপরাধের বিচার সারাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছে। এজন্য সকল আইনি সুযোগ সুবিধা দিয়ে এবং যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয় সে বিষয়টি লক্ষ্য রেখেই এ বিচার করা হচ্ছে।
এফএইচ/এসকেডি/আরআইপি