আতঙ্কের জনপদ মোহাম্মদপুর, বিষফোড়া ‘জেনেভা ক্যাম্প’
অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অশান্ত মোহাম্মদপুর। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অবৈধ মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, বাজার-ফুটপাত-প্রতিষ্ঠান দখলে নিতে মরিয়া একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। হত্যা, ছিনতাই, গুলিবিনিময় নৈমিত্তিক ঘটনা। গত দুই মাসে রীতিমতো রাজধানী ঢাকার আতঙ্কের জনপদ হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর।
পুলিশে বদলির পর নতুন যারা যোগদান করেছেন তারা মোহাম্মদপুরের অনেক অলিগলি চিনছেন না। ফলে অপরাধীরাও সহজে ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় পুলিশ, র্যাবের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প।
মোহাম্মদপুরের মাদক কারবার এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধে গত কয়েকদিনের বিশেষ অভিযানে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। র্যাবের দাবি, গত ৪৮ ঘণ্টায় মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
যেসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন মোহাম্মদপুরবাসী
গত ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন এক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণী। এ ঘটনার সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ফুটেজে দেখা যায়, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক তরুণী। পেছন থেকে কয়েকজন তরুণ দৌড়ে তার পথরোধ করে। চাপাতি বের করে কথা বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওই তরুণীর ব্যাগ টানাটানি শুরু হয়। তরুণী ব্যাগটি না ছাড়ায় তার হাতে কোপ দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তরুণীর ওড়না ও কাঁধের ব্যাগ ছিনতাইকারীদের হাতে চলে যায়। সব ফেলে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন ওই তরুণী।
ছিনতাইয়ের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায়ও একা নারীরা ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।
২৪ অক্টোবর মোহাম্মদপুর বসিলা ৪০ ফুট এলাকার একটি মুদি দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্রের মুখে দোকানিকে জিম্মি করে দুষ্কৃতকারীরা ক্যাশের সব টাকা নিয়ে যায়। এর আগে ২০ অক্টোবর সকালে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডে দিনদুপুরে ফিল্মি স্টাইলে নেসলে কোম্পানির গাড়ি আটকে অস্ত্রের মুখে ১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে ছয় দুর্বৃত্ত। ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে।
মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার বাসিন্দা খন্দকার রাফি জানান, গত ১৯ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মেস বাসার তিন সদস্য হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ করে পেছন থেকে ৯-১০ জন অল্প বয়সী ছেলে বড় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এসময় তাদের কাছে থাকা দুটি মোবাইল ফোন ও পকেটে থাকা প্রায় ৯ হাজার টাকাসহ সবকিছু কেড়ে পালিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা।
রাতে বের হতে ভয়
মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকদিন ধরে চলা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার পর সাধারণ মানুষ রাতে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। জরুরি কাজে একা বের না হয়ে দলবদ্ধভাবে অনেকেই বের হচ্ছেন। বিশেষ করে মোহাম্মদপুরে চলাচলরত কর্মজীবী নারীরা বেশি আতঙ্কে আছেন।
চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযান জোরদারে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় ঘর থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যার পর বের হচ্ছেন না কেউ। বের হলেও দামি মোবাইল, ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও বেশি টাকা সঙ্গে রাখছেন না তারা।
রিকশাযাত্রীদের বেশি ভয়
মোহাম্মদপুরের বেশকিছু এলাকায় রিকশাযাত্রীদের কাছ থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ, মানিব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় রিকশাযাত্রীরা আতঙ্কে রয়েছেন। অনেক সময় রিকশাচালককে থামিয়ে ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোবাইল-মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে একজন ভুক্তভোগী জানান, ১৮ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে বসিলা ৪০ ফিট এলাকায় রিকশায় করে যাওয়ার সময় কয়েকজন যুবক তাকে আটকে মোবাইল ও মানিব্যাগ কেড়ে নেয়।
মোহাম্মদপুরে ২ মাসে ১০ খুন
গত ৫ আগস্টের পর থেকে শুধু মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে ১০ জন। এসব খুনের নেপথ্য কারণ আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ ও বাজার দখল। প্রকাশ্যে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া, গোলাগুলি যেন এই এলাকায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন
- ঢাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ঠেকাতে নাজেহাল পুলিশ
- সেনা-র্যাব-পুলিশ-বিজিবির পোশাক কেনা যায় মার্কেটে, বাড়ছে অস্থিরতা
- আইনশৃঙ্খলায় স্বস্তি ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ
মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার বধ্যভূমি সংলগ্ন বেড়িবাঁধে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর দুজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন নাসির বিশ্বাস (২৯) ও মুন্না (২২)। বিগত সরকারের নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে নাসির মোহাম্মদপুর-হাজারীবাগ এলাকায় আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে পরিচিত।
গত ১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিল্লাল গাজীকে। বিল্লাল স্থানীয় আকাশ নীলা ওয়েস্টার্ন হাউজিংয়ের স্টাফ ছিলেন। এ হত্যার মিশনে ছিল ৯ জন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে গ্রিন ভিউ হাউজিং এলাকায় বাসায় ঢুকে শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবককে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৭ অক্টোবর ভোরে মোহাম্মদপুরের বসিলায় আরাম হাউজিং এলাকায় হাত-পা বেঁধে সিএনজি অটোরিকশাচালক শাহরিয়ার আশিককে (২১) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
জেনেভা ক্যাম্পেই ৫ খুন
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য ধরে রাখতে ৫ আগস্টের পর থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে। এ সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে বা মাদক বিক্রিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় খুন হয়েছে পাঁচজন। সবশেষ ১৩ বছর বয়সী সাজ্জাদ হোসেন নামে এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
এর আগে ১৬ অক্টোবর মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হন ক্যাম্পের ৮ নম্বর ব্লকের বাসিন্দা শাহনেওয়াজ কাল্লু (৩৮)। কাল্লু স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। এ হত্যার বিচার দাবি করে তার বোন নাসরিন আখতার বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই। যারা নিজেদের অবৈধ ব্যবসার জন্য আমার ভাইকে মেরেছে, তাদের কেন পুলিশ ধরে না।
বিষফোড়া জেনেভা ক্যাম্প
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুর থানার ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত জেনেভা ক্যাম্প। বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল। জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা যেন এখন মোহাম্মদপুর এলাকার বিষফোঁড়া। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা লুট করে মাদক কারবারি ও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। জেনেভা ক্যাম্পের বিভিন্ন মাদক কারবারি গ্রুপের মধ্যে গুলিবিনিময়ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। বিশেষ করে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র চলে যায় জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপরাধীদের কাছে। অস্ত্র পাওয়ার পর তারা নিজেদের অধিপত্য বিস্তার করতে চুরি, ছিনতাই ও খুনের মতো নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে মোহাম্মদপুর এলাকায় নানান অপরাধমূলক কার্যক্রম বাড়ছে। অপরাধীদের কাছে মোহাম্মদপুর নিরাপদ এলাকা। কেননা অপরাধ করে এ এলাকার বিভিন্ন দিক দিয়ে সহজে পালানো যায়।
কিশোর গ্যাং
মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের কালচার বেশ পুরোনো। এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বহু আগে থেকেই বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকতো। ক্ষমতার পালাবদলে তারা রূপ পাল্টেছে। বিগত সরকারের আমলের চাঁদা ও মাসোয়ারা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিতে জড়াচ্ছে তারা।
কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সেনাবাহিনী
গত ২৭ অক্টোবর দিনগত রাতে মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযানে নামে সেনাবাহিনী। অভিযানে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৪০ জনের মতো সদস্যকে ধারালো অস্ত্রসহ আটক করা হয়। আটকদের অনেকের হাতে ট্যাটু ছিল। এর মধ্যে কারও কারও হাতে ডাবল স্টার খোঁচানো ট্যাটুও দেখা যায়। একেকটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একেক ধরনের ট্যাটু ব্যবহার করে বলেও জানায় সেনাবাহিনী।
মূলত মাদক কারবারির আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে এগুলো ঘটেছে। আমরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছি। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রেফতার হয়েছে, যারাই জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।- ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান
২৩ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের উপঅধিনায়ক মেজর নাজিম আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, মোহাম্মদপুরে ২৭-২৮টি কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য পেয়েছে সেনাবাহিনী।
মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ে এলাকা ভাগ
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে কিছু এলাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী চাঁদ উদ্যান, সাতমসজিদ হাউজিং, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, ঢাকা উদ্যান, তুরাগ হাউজিং, বসিলা ৪০ ফিট, কাটাসুর, গ্রিন হাউজিং, বসিলা গার্ডেন সিটি, একতা হাউজিং, চাঁন মিয়া হাউজিং, মোহাম্মদীয়া হাউজিং লিমিটেড, মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটি, নবোদয় হাউজিং, বোটঘাট, সাদেক খান রোড, ক্যানসার গলি, রায়েরবাজার, পুলপাড় বটতলা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
সরেজমিনে মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুরে দীর্ঘদিন পুলিশের অনুপস্থিতি ছিল। পুলিশ থানায় দায়িত্ব গ্রহণের পরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। থানা পুড়িয়ে দেওয়া, অস্ত্র লুট, বিট অফিস পুড়িয়ে দেওয়া, জনবল সংকটসহ নানান কারণে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ঢাকার বাইরে থেকে বদলি হয়ে এলেও তারা এলাকার অলিগলি এখনো পুরোপুরি চিনতে পারেনি।
মোহাম্মদপুরে সেনাক্যাম্পের পর জনমনে স্বস্তি
নিরাপত্তাহীনতায় নিমজ্জিত মোহাম্মদপুরবাসীর জীবনে স্বস্তি আনতে অস্থায়ী সেনাক্যাম্প করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই ক্যাম্প করার খবরে স্বস্তিবোধ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রোববার (২৭ অক্টোবর) ঢাকা উদ্যানে তাদের ক্যাম্পের কার্যক্রম শুরু হয়। সন্ত্রাস দমন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকবে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে জনসাধারণের জানমাল ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ, আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে দেশব্যাপী পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রাপ্তির পর থেকে মোহাম্মদপুর, আদাবর এবং শেরেবাংলা নগর থানাধীন প্রায় ২০০ অপরাধী, ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৭১ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১৭২ ধরনের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অস্ত্র, একটি গ্রেনেড এবং বিপুল পরিমাণ নেশাজাত দ্রব্য উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী।
যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলমান অভিযানে অপরাধপ্রবণ এলাকা অর্থাৎ ক্রাইম জোনে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশের স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশি টহল জোরদার ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল পেট্রোল ও মোটরসাইকেল পেট্রোল টিম বাড়ানো হয়েছে। সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযান জোরদারে পুলিশের সব ইউনিটপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি ময়নুল ইসলাম।’
তিনি বলেন, ‘ডিএমপি এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও মোবাইল চেকপোস্ট কার্যকর। ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কাজ করছে। এছাড়া দেশব্যাপী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।’
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) রুহুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাং একটি অভিশপ্ত কালচার। এ কালচার বহুদিন ধরে চলমান। তবে কিশোর গ্যাং এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তারপরও তাদের অস্তিত্ব ফেরাতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা রাজনৈতিক মদতদাতাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মোহাম্মদপুরে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে দিনরাত কাজ করছে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী।’
জেনেভা ক্যাম্পে সম্প্রতি খুনের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মূলত মাদক কারবারির আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে এগুলো ঘটেছে। আমরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছি। অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রেফতার হয়েছে, যারাই জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
গত ৪৮ ঘণ্টায় মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি
জানতে চাইলে র্যাব-২ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোয়াজ্জেম হোসেন জাগো নিউজেক বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে র্যাব। পাশাপাশি সেনাবাহিনীও কাজ করছে। গত ৪৮ ঘণ্টায় (২৯ সেপ্টেম্বর, রাত সাড়ে ৮টা) মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এই সময়ে সেনাবাহিনী ও র্যাব বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেফতার করেছে, যারা ছিনতাই, ডাকাতি ও কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘আমি নিজে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করছি। সার্বিক পরিস্থিতি উন্নতিতে র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাজ করছে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওই পাড়ের এলাকার কিছু লোক মোহাম্মদপুরের কন্ট্রোল নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা বিগত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজন। তবে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, র্যাবের টহলের কারণে তারা সুবিধা করতে পারেনি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে আগে থেকেই চুরি, ছিনতাই ও কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধ বেশি ছিল। জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক কারবার এখন কারা নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা নিয়ে এক ধরনের সংঘাত-সহিংসতা চলছে। ৫ আগস্টের পর অনেক পেশাদার অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। এসব অপরাধী পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
টিটি/এএসএ/এমএস