ঢাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই ঠেকাতে নাজেহাল পুলিশ

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৩৮ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থা হয় দেশের আইনশৃঙ্খলার। লম্বা সময় মাঠে ছিল না পুলিশ। বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র লুট, আসামি পলায়নের ঘটনাও ঘটে। এখনো শতভাগ নিয়ন্ত্রণে আসেনি সেই আইনশৃঙ্খলা। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে নাজেহাল পুলিশ।

ছিনতাই বেশি বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রাজধানীবাসী। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত, এমনকি দিনে-দুপুরেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাই প্রতিরোধে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত। রাজধানীতে রাতে, বিশেষ করে ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ উদ্বিগ্ন খোদ ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তারাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছিনতাই-ডাকাতির শিকার হয়েছেন এমন অনেকে পুলিশি সহায়তা নিচ্ছেন না। অর্থাৎ জিডি কিংবা মামলা করছেন না। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, থানা-পুলিশ-আদালতের ঝামেলা এড়াতে পুলিশের শরণাপন্ন হননি তারা। অনেক ভুক্তভোগী আবার ডাকাতির শিকার হয়ে থানায় গিয়ে ছিতাইয়ের মামলা করেছেন। পুলিশ বলছে, জিডি-মামলা না করলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা মুশকিল, একইসঙ্গে অপরাধীদের শনাক্ত করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব এলাকায় বেশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটবে সেসব এলাকার ওসিসহ দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত চুরি-ছিনতাই বেশি

পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, বেশিরভাগ চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ঘটছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। গত দুই মাসে যেসব ছিনতাই ঘটেছে সবই এ সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা বেশি হানা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আর ভোরের দিকে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও নিরিবিলি-অন্ধকার সড়কে রিকশাযাত্রীদের নিশানা বানিয়েছে ছিনতাইকারীরা।

ডিএমপির তৈরি করা এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছিনতাইকারী বেশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে।

ঢাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মহোৎসব, নাজেহাল পুলিশ

পুলিশ মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে।

থানার তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে শাহবাগ, ভাটারা ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায়। আর সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়।

মোহাম্মদপুরে আগের চিত্র হলো চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনের মতো ঘটনার ছড়াছড়ি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কন্ট্রোলে। অপরাধ চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে অপরাধ হলে যাতে চিহ্নিত করা যায় এবং অপরাধীদের শনাক্তের পর আইনের আওতায় আনা হবে।- অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. ইসরাইল হাওলাদার

ডিএমপির একটি সূত্র বলছে, গত দুই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি বেড়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি থানার ওসিকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি হবে সে এলাকার ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিগত কয়েক বছরের অপরাধের চিত্র

২০২২ সালে ডিএমপিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ১৬৫টি, চুরির ঘটনা এক হাজার ৬০৩টি। ২০২১ সালে ঘটেছিল এক হাজার ৩৪৩টি। ২০২০ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল ১৭৬টি, চুরির ঘটনা এক হাজার ২১৭টি। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় ৪৪টি এবং চুরির ঘটনা ঘটে ৪৮৬টি।

২০২২ ও ২০২৩ সালের অপরাধ ও মামলার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সবচেয়ে কম হয়েছে রমনা বিভাগে। তেজগাঁও বিভাগে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৩৩৩টি মামলা হয় আর রমনা বিভাগে সবচেয়ে কম দুই হাজার ৩০০টি। ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে তেজগাঁও বিভাগে সবচেয়ে বেশি এক হাজার ৬৩১টি এবং রমনা বিভাগে সবচেয়ে কম ৬৬৬টি মামলা হয়।

২০২২ সালে তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল ছয়টি থানা মিলে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৭৮৬টি অস্ত্র-মাদক-চোরাচালান মামলা হয়। এছাড়া এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৩৯টি দস্যুতা, ৩৩টি ছিনতাই এবং ৩৫৯টি চুরি, ১৪৬টি সিঁধেল চুরি, ১৩২টি জখম সংক্রান্ত, এক হাজার ৪৪৮টি অন্য ঘটনায় মামলা হয়। ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে সবচেয়ে বেশি ৭৮৪টি অস্ত্র-মাদক-চোরাচালান মামলা হয়।

অশান্ত মোহাম্মদপুর

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে অবৈধ মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, বাজারসহ নানা খাত দখলে নিতে মরিয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একাধিক গ্রুপ। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অশান্ত মোহাম্মদপুর। নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে লিপ্ত হচ্ছে সংঘর্ষে। এসব সংঘর্ষে প্রদর্শন ও ব্যবহার করছে অবৈধ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, হচ্ছে রক্তপাত। ঝরছে জীবনও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর এলাকার পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রও।

আরও পড়ুন

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ১১ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনা সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তবে ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ডাকাতিতে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র‍্যাব ও ডিবি।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরেই দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সকাল সোয়া ১০টার দিকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ডাকাতদলের সদস্যরা।

ঘটনাস্থলের আশপাশের কয়েকটি ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ডাকাতির পর জনসমক্ষেই পালিয়ে যায় ডাকাতেরা। মোটরসাইকেলযোগে বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে ঢাকা উদ্যান এলাকার দিকে যেতে দেখা যায় তাদের।

ঢাকায় চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মহোৎসব, নাজেহাল পুলিশ

গত ১০ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা।

ঘটছে গোলাগুলির ঘটনাও

গত ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে মো. শাহনেওয়াজ (৩৮) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন।

১৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ কাঁচাবাজার মার্কেট দখল কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে। মার্কেটের সভাপতি আবুল হোসেন (৫০) ও তার ছোট ভাই মাহবুবকে (৪২) গুলি করে দুর্বৃত্তরা।

সংশ্লিষ্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবল ও টহল ভ্যান সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতায় এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। লোকবল ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পেলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে।

চলতি সময়ে রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগে যে টহল কার্যক্রম ছিল বর্তমানে সেটি লক্ষ্য করছি না।-অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক

এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কুতুবখালী এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ার জেরে মো. রাসেল শিকদার (২৫) নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

নিহতের ভাই রুবেল শিকদার অভিযোগ করেন, দুই দিন আগে এলাকায় ছিনতাইকালে বখাটেদের বাধা দেন রাসেল। ওই ঘটনার জেরে রাসেলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

খোদ পুলিশ সদস্যদের বাসায় চুরি

১৯ অক্টোবর রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় জুবায়ের হোসেন অলক নামে ডিএমপির এক কনস্টেবলের বাসায় চুরি হয়েছে। বাসার আলমারির ড্রয়ারে থাকা একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল, একটি স্বর্ণের চেন ও নগদ ১১ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তবে এ ঘটনার পরদিন শাহজাহানপুরের শান্তিবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে চুরির ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় চুরি হওয়া একটি স্বর্ণের চেন ও একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল।

ডাকাতির ঘটনায় মামলা নিতে অনীহা পুলিশের

গত ১৮ অক্টোবর দিনগত রাতে কমলাপুর স্টেশন থেকে বাসায় ফেরার পথে মগবাজার রেলক্রসিং সংলগ্ন স্থানে ডাকাতির শিকার হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবলুল হক শোভন নামে এক শিক্ষার্থী। তার গলায় চাপাতি ধরে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে তিনটি মোটরসাইকেলে করে সাতজন তার কাছে থাকা আইফোন ১৫ প্লাস, এসএসডি (স্কলারশিপের আবেদনের জন্য জমা দেওয়ার ফিল্মের সব ফুটেজ), সাউন্ড ইক্যুপমেন্ট, মানিব্যাগসহ সবকিছু ডাকাতি করে পালিয়ে চলে যায়।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শিবলুল হক শোভন দুদিন তিনবার থানায় গিয়েও ডাকাতির মামলা করতে পারেননি। প্রথম থেকেই পুলিশ এটি ডাকাতির মামলা নিতে অপারগ ছিল। পুলিশের দাবি এটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। পরে অবশ্য তৃতীয়বার থানায় গিয়ে শোভন ডাকাতির মামলা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনোকিছুই উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শিবলুল হক শোভন জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকদিন থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনার বিষয়ে ভাবছিলাম। দেশের বাইরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবো ঠিক করেছিলাম। আবেদনের সব প্রস্তুতিও প্রায় শেষের দিকে ছিল। কিন্তু ডাকাতির ঘটনার পুরো কাজের ফুটেজ হারিয়ে ফেললাম। জীবনে নিজেকে সবচেয়ে অসহায় মনে হলো যখন ছেলেটা চাপাতিটা ধরলো গলায়, আর আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হলো, আর কিছুই করার নেই।’

আরও পড়ুন
ঢাকায় ১৬ মাসে ২২৪ খুন, বেশি ওয়ারী-মিরপুরে

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শোভন বলেন, ‘হাতিরঝিল থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) প্রথমে মামলা নিতে গড়িমসি করেন। তিনটি মোটরসাইকেলে ছিল সাতজন কিন্তু ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে বারবার বলেন একটি মোটরসাইকেলের কথা এজাহারে লিখতে। আমি বলেছি, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে তিনটি মোটরসাইকেল, আমি নিজেই ভুক্তভোগী। কীভাবে একটি মোটরসাইকেলের কথা এজাহারে লিখবো। পরে অবশ্য হাতিরঝিল থানার ওসি মামলা নিতে সহায়তা করেন।’

এ বিষয়ে হাতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাজু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ওসি হিসেবে থানায় জয়েন করেছি ২০ অক্টোবর। আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজ করছি জনগণের জন্য। ডাকাতির মামলা না নেওয়ার বিষয়ে হয়তো ওসি তদন্তের বোঝার ভুল থাকতে পারে, আমি জানি না। তবে কাজ হবে স্মার্টলি, কতটুকু পারবো জানি না। ডাকাতির শিকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবলুল হক শোভনের মোবাইলসহ আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে।’

যে কারণে ডাকাতির মামলা নিতে চায় না পুলিশ

ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের (আইনের ভাষায় দস্যুতা) ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ। মোবাইল বা মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানা পুলিশ মামলা নেওয়ার বদলে জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেয়। অনেক সময় ভুক্তভোগীরাও ঝামেলা এড়াতে জিডি করেই চলে আসেন। অথচ দণ্ডবিধি বা পুলিশ প্রবিধানে ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী মামলা বা জিডি নেওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা কেন নিতে চায় না পুলিশ?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা জানান, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা একটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। থানার ওসিকে প্রতি সপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে হয়। ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসির ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ।

ছিনতাই-চাঁদাবাজি প্রতিরোধে সাঁড়াশি অভিযান

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো. ইসরাইল হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে সবার মধ্যে স্বাধীন স্বাধীন ভাব ছিল। প্রত্যেকটি থানায় পাঁচ থেকে আটটি করে টহল গাড়ি ছিল। এ গাড়িগুলো ৫ তারিখের পর অনেক থানায় ছিল না। যে থানায় বেশি গাড়ি ছিল সেখান থেকে অন্য থানায় বণ্টন করে টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়।’

‘আটটি টহলের জায়গায় একটি টহল কার্যক্রম প্রথম দিকে শুরু করা হয়। দুই মাসের মাথায় বর্তমানে সব থানায় মোটামুটি টহল কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। একটা ঘটনা ঘটার পর তদন্তে দিনরাত পরিশ্রম করে আমরা আসামি শনাক্তের পর আসামিও ধরেছি। এটাও পুলিশের একটি সাকসেস। সমাজে অপরাধ যাতে না হয় সেজন্য পুলিশ অনেক প্রিভেন্টিভ কাজ করে।’

মোহাম্মদপুরে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে আগের চিত্র চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনের মতো ঘটনার ছড়াছড়ি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের কন্ট্রোলে। অপরাধ চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে অপরাধ হলে যাতে চিহ্নিত করা যায় এবং অপরাধীদের শনাক্তের পর আইনের আওতায় আনা হবে।’

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সমাজে যে কোনো ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র‍্যাব কাজ করছে। চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই প্রতিরোধে র‍্যাবের টহল টিম, গোয়েন্দা টিমসহ চেকপোস্ট কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এসব অপরাধে বেশ কয়েকজন আসামিও ধরেছি আমরা। এছাড়া আদালত থেকে জামিন পাওয়া চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের মামলার আসামিদের গোয়েন্দা নজরদারিও করে র‍্যাব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘চলতি সময়ে রাজধানীতে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগে যে টহল কার্যক্রম ছিল বর্তমানে সেটি লক্ষ্য করছি না। এসব অপরাধ কমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।’

টিটি/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।