হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষের ডিএনএ টেস্ট কেন-কীভাবে?

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫২ এএম, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

তিন বছর আগে করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা যান বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ৬৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার মৃত্যুর বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে জোরপূর্বক সাভারের একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে কবর দিতে বাধ্য করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরবর্তীসময়ে জানা যায়, হারিছ চৌধুরীকে ‘মাহমুদুর রহমান’ নামে সাভারে দাফন করা হয়। সরকার তার প্রকৃত পরিচয় অনুযায়ী কোনো মৃত্যুসনদ দেয়নি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও তিনি পাননি। তবে মাহমুদুর রহমানই হারিছ চৌধুরী কি না সেটা নিয়ে বিভ্রান্তি পুরোপুরি কাটেনি।

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পরে সমাহিত বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর মরদেহ তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

রিটে সাভারের মাদরাসা প্রাঙ্গণে হারিছ চৌধুরীর অবশিষ্ট (মরদেহের) যা আছে, তা তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করে তার প্রকৃত পরিচয় নির্ধারণ এবং তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য সম্মানসহ নিজ বাড়িতে দাফন করার প্রার্থনার কথা জানান রিটের পক্ষে থাকা আইনজীবী মাহদীন চৌধুরী।

গত ১৬ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ কবর থেকে তোলা হয়। পরে ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি। ডিএনএ পরীক্ষার পর মরদেহটি হারিছ চৌধুরীর কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া যাবে। ২১ অক্টোবর সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে ডিএনএ নমুনা দেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী।

ডিএনএ কী, যে কারণে ডিএনএ টেস্ট করা হয়

মানুষের পরিচয় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হলে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড) টেস্ট করা হয়। এজন্য করতে হয় ডিএনএ প্রোফাইল। ডিএনএ প্রোফাইল টেস্টের এ পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।

প্রথমে বাবা-মা ও সন্তানদের নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। তাদের না পাওয়া গেলে ভাই-বোন, তাও না পাওয়া গেলে দাদা-দাদি, নানা-নানি। সেটিও না হলে তৃতীয় ধাপের রেফারেন্স স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয় পরিচয় নিশ্চিতে।

ফরেনসিক সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, যেসব মৃত ব্যক্তির পরিচয় স্বাভাবিক নিয়মে নিশ্চিত হওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্ট করেই তাদের শনাক্ত করতে হয়। এজন্য ডিএনএ টেস্টের গুরুত্ব অনেক বেশি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নিহত ব্যক্তির সঙ্গে বেঁচে থাকা স্বজনদের অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। নিহত ব্যক্তিকে সহজে শনাক্ত করা না গেলে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। নানা আইনি জটিলতা নিরসনেও ডিএনএ টেস্টের কোনো বিকল্প নেই। ডিএনএ টেস্টের জন্য নিহত ব্যক্তির দাঁত ও হাড় নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। অন্যদিকে ভিকটিমের পরিবার বা রক্তসম্পর্কীয় স্বজনের রক্ত বা মুখের লালা সংগ্রহ করা যায়। কোনো কোনো সময় দুটিই সংগ্রহ করা হয়। শুধু ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমেই সুনিশ্চিতভাবে পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব।

নমুনা সংগ্রহের তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, বাবা-মা, সন্তান ও ভাই-বোন। দ্বিতীয়ত, দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ। সেটাও সম্ভব না হলে নিকটাত্মীয়দের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষের ডিএনএ পরীক্ষা

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষের হাড় ও দাঁত থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা সংগ্রহের পর ম্যাপিং প্রক্রিয়া চলছে। হারিছের মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরীর রক্ত নেওয়া হয়েছে ডিএনএর নমুনা হিসেবে। এরপর কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ডিএনএ ম্যাচিং করা হবে। এই পদ্ধতিতেই জানা যাবে মরদেহ হারিছ চৌধুরীর কি না। তবে এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এক মাসেরও বেশি সময় লাগতে পারে ডিএনএ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে।

হারিছ চৌধুরীর ডিএনএ টেস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি মো. জামশের আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিএনএ টেস্ট একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। দুজনের নমুনা ম্যাচিং শেষে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে। মরদেহের হাড় ও দাঁত থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তার মেয়ের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।’

ডিএনএ টেস্ট একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। দুজনের নমুনা ম্যাচিং শেষে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে। মরদেহের হাড় ও দাঁত থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তার মেয়ের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।- সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের ডিআইজি মো. জামশের আলী

হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবা মারা গেছেন, কিন্তু বিগত সরকার এটা মেনে নেয়নি। তাহলে কি আমার বাবাকে আমি জীবিত রেখে দেবো, তা না হলে কাউকে আমার বাবাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার বাবা তো নিরুদ্দেশ থাকতে পারেন না। কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে এটার একটি সার্টিফিকেট লাগবে। তিনি তো যেমন-তেমন মানুষ ছিলেন না। তার মৃত্যুর বিষয়টা তো প্রমাণিত হতে হবে। যে কোনো যেমন-তেমন মানুষেরও মানবিক অধিকার থাকে। আমার বাবার মানবিক অধিকার রক্ষা হয়নি।’

ওই সময় হারিছ চৌধুরীর মরদেহকে অন্য পরিচয়ে কেন দাফন করা হয়েছিল প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাবার মরদেহ আমার দাদুর বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি দেখলাম গণমাধ্যম অহরহ রিপোর্ট করছে মাহমুদুর রহমান নামে হারিছ চৌধুরীর দাফন। এটা আসলে সঠিক নয়। আমার প্রশ্ন, কে মাহমুদুর রহমান নামে দাফন করেছে?’

আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে বলেন, ‘আগের সরকারের হিংসার পাত্র ছিল আমার বাবা। তখনকার সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক মামলা হয়েছে। আমার বাবা গত সরকারের আমলে নির্যাতিত হওয়াদের মধ্যে অন্যতম একজন। এ কারণে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন, কিন্তু দেশ ছেড়ে যাননি।’

যেভাবে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ পাওয়া যায়

দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, রেজিস্ট্রার অফিসে সরাসরি গিয়ে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ সংগ্রহের জন্য আবেদন করা যায়। বিদেশে অবস্থানকালে বাংলাদেশ দূতাবাসে মৃত্যু নিবন্ধন করা যায়। অনলাইনেও এর জন্য আবেদন করা যায়।

অনলাইনে মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য জন্মসনদ নম্বর প্রয়োজন। মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, মৃত্যুর স্থান, লিঙ্গ, বাবা-মায়ের নাম, স্বামী-স্ত্রীর নাম এসব তথ্য সরবরাহ করতে হয়। এসব তথ্য নির্ধারিত কার্যালয়গুলোর ডাটাবেজে ওঠার পর মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই এটি দেওয়া হয়।

মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করলে কোনো ফি লাগে না। এরপর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ২৫ টাকা, তারও পরে করলে ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা রয়েছে।

কেন মৃত্যুসনদ জরুরি

ব্যাংকে মৃত ব্যক্তির জমা রাখা অর্থ, লাইফ ইনস্যুরেন্সের অর্থ প্রাপ্তির জন্য মৃত্যুসনদ জমা দিতে হয়। তার জমিজমা, বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানির মালিকানা এরকম সব ক্ষেত্রে নামজারি অথবা নিজের নামে সম্পদটি রেকর্ড করতে হলে এলাকার রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি অফিসে কাগজটি অবশ্যই দিতে হবে।

মৃত ব্যক্তি চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত হলে তার পেনশন ও অন্য সুবিধাদি দাবি করতে হলেও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন।

বাবা মারা গেছেন, কিন্তু বিগত সরকার এটা মেনে নেয়নি। তাহলে কি আমার বাবাকে আমি জীবিত রেখে দেবো, তা না হলে কাউকে আমার বাবাকে খুঁজে দিতে হবে। আমার বাবা তো নিরুদ্দেশ থাকতে পারেন না।- হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী

হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন কি না, মারা গেলে তার মৃত্যু লন্ডনে না ঢাকায়- এ নিয়ে অস্পষ্টতার মধ্যে ২০২২ সালের ৬ মার্চ মানবজমিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘হারিছ নয়, মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী দীর্ঘ ১৪ বছর দেশেই আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি তার নাম-পরিচয় বদল করেন। নতুন নাম নেন ‘মাহমুদুর রহমান’। এই নামেই তিনি নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করেন। তিনি প্রায় ১১ বছর ঢাকার পান্থপথে ছিলেন। নিজেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতেন। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে মৃত্যুর পর তাকে সাভারে দাফন করা হয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর হারিছ চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হারিছ চৌধুরীর সাত বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার একজন আসামি তিনি। এমন একজন ব্যক্তির ১৪ বছর ধরে আত্মগোপনে থাকার বিষয়ে আদতে পুলিশের কাছে সে সময় কোনো নিশ্চিত তথ্য ছিল না।

‘মাহমুদুর রহমান’ নামে যে ব্যক্তির কথা গণমাধ্যমের খবরে এসেছে, তাকে ২০১৩ সালে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়। পাঁচ বছর পর একই নামে পাসপোর্ট নবায়ন হয়। এই পাসপোর্ট নম্বর পরীক্ষা করে সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, মাহমুদুর রহমান নামে ইস্যু হওয়া পাসপোর্টের বিপরীতে কোনো দেশ ভ্রমণের তথ্য নেই।

টিটি/এএসএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।