নির্দেশিকা না ছাপিয়ে সরকারি টাকা তুলে নিয়েছে মৃত্তিকার সিন্ডিকেট

নাজমুল হুসাইন
নাজমুল হুসাইন নাজমুল হুসাইন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:২৬ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

সারা বছর কী কাজ করে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)? সাধারণ মানুষের অনেকেই সেটা জানেন না। তবে প্রতিষ্ঠানটির বছরব্যাপী কার্যক্রমের একটি বড় অংশ হলো আকাশচিত্র বিশ্লেষণ, মাঠ জরিপ ও গবেষণাগারে মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণ। এসব ফলাফলের ভিত্তিতে পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলার জন্য নির্দেশিকা তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। যার ভিত্তিতে সারাদেশের ফসলের শ্রেণিবিন্যাসসহ ভূ-প্রাকৃতিক বিভিন্ন কার্যক্রমের বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজেও এসআরডিআই দুর্নীতি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত অর্থবছর উপজেলা নির্দেশিকার বই না ছাপিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শুধু গত বছর নয়, এসআরডিআইয়ের মহাপরিচালক মো. জালাল উদ্দীনসহ একাধিক কর্মকর্তার সিন্ডিকেট প্রতি বছর এসব বই ছাপানোর টাকা নয়-ছয় করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।

জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দেশের ৩৫ উপজেলায় নির্দেশিকার বই ছাপানো বাবদ ৪২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। প্রতিটি উপজেলার জন্য ২৫০ কপি নির্দেশিকা ছাপানোর কথা। যেজন্য ই-টেন্ডার করে এরপর ১৩ জুন রিমিনি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়, যা পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে ছাপিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, যা ওই সময়ের মধ্যে সরবরাহ না করলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিলসহ জামানত বাতিল হওয়ার কথা।

এরপর জুনেই বরাদ্দের ওই টাকা সরকারের কোষাগার থেকে তুলেছে এসআরডিআই। কার্যক্রম হালাল করতে কাগজপত্রে ওই প্রতিষ্ঠানকে চেকও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রিমিনি ইন্টারন্যাশনাল একটি নির্দেশিকাও ছাপায়নি। তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা বাবদ টাকা নিয়েছে এসআরডিআই সিন্ডিকেট।

‘এখনো নির্দেশিকা ছাপানো হয়নি, এটা সত্য। তবে এর মানে এই নয়, ছাপানো হবে না। ইতিমধ্যে আটটি উপজেলার নির্দেশিকা ছাপানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’- আব্দুল হালিম

বক্তব্য দেননি এসআরডিআই মহাপরিচালক

টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেননি এসআরডিআই মহাপরিচালক জালাল উদ্দীন। তিনি কোনো বক্তব্যও দেননি। বারবার তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের সঙ্গে কথা বলতে বলেন প্রতিবেদককে। আব্দুল হালিম এসব নির্দেশিকা সম্পাদনার প্রধান দায়িত্বে ছিলেন।

আব্দুল হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো নির্দেশিকা ছাপানো হয়নি, এটা সত্য। তবে এর মানে এই নয়, ছাপানো হবে না। ইতিমধ্যে আটটি উপজেলার নির্দেশিকা ছাপানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’

ছাপানো না হলেও সরকারি বরাদ্দের সব টাকা কেন উঠিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল হালিম বলেন, ‘সরকারি টাকা খরচ করা অনেক কঠিন। একবার বরাদ্দের টাকা ফেরত চলে গেলে সেটা আর ফিরে পাওয়া যায় না। যে কারণে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।’

‘তবে এ টাকা কারও আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই। আমরা ওই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আরেকটি গ্যারান্টি চেক নিয়ে রেখেছি, যেটা আমাদের সিকিউরিটি। যখন তখন ছাপাতে পারবো।’ যোগ করেন আব্দুল হালিম।

অর্থাৎ বইটি যে ছাপানো হচ্ছে না, সে বিষয়টি স্বীকার করলেন না এ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। প্রকাশনার জন্য এসব বইয়ের পান্ডুলিপি প্রস্তুত বলে দাবি করা এ সম্পাদকের কাছে এক কপি খসড়া নির্দেশনা দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি। এমনকি বইগুলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ছাপাতে দেওয়া হয়েছে তারও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি কোন কোন উপজেলার জন্য নির্দেশিকা তৈরি হয়েছে, সেটা জানতে চাইলেও তিনি জানাতে পারেননি। আকাশ চিত্র বিশ্লেষণ, মাঠ জরিপ ও গবেষণাগারে মৃত্তিকা নমুনা বিশ্লেষণের প্রতিবেদন সম্পর্কেও জানাতে পারেননি।

‘অনেক উপজেলার প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। এখনো খসড়া রেডি করা যায়নি। সেজন্য দেরি হচ্ছে। তবে সব নির্দেশিকাই ছাপানো হবে।’- নীলিমা আক্তার কোহিনূর

এখনো খসড়া রেডি করা যায়নি

নির্দেশিকা ছাপানোর প্রধান দায়িত্ব এসআরডিআইয়ের নির্দেশিকা সেলের বলে সেখানে যোগাযোগ করতে বলেন আব্দুল হালিম। ওই সেলের প্রধান নীলিমা আক্তার কোহিনূর।

সরেজমিনে তার লালমাটিয়ার দপ্তরে গিয়েও এসব নির্দেশিকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নীলিমা আক্তার কোহিনূর বলেন, ‘খসড়া আমরা মেইল করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে পাঠাচ্ছি।’ মেইলের প্রমাণ দেখতে চাইলে তিনি এটি ব্যক্তিগত বলে দেখাতে অস্বীকৃতি জানান।

এরপর নীলিমা আক্তার কোহিনূর জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক উপজেলার প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। এখনো খসড়া রেডি করা যায়নি। সেজন্য দেরি হচ্ছে। তবে সব নির্দেশিকাই ছাপানো হবে।’

আইন অনুযায়ী ওই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার কথা। তারপরও কেন প্রতিষ্ঠানটিকে টাকা দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে নীলিমা আক্তার কোহিনূর বলেন, ‘বছরের পর বছর এভাবেই কাজগুলো হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সাল থেকে এভাবেই ছাপানো হয়। কখনো কোনো কথা ওঠেনি।’

এদিকে গত অর্থবছর শুধু নয়, এর আগের অর্থবছরের নির্দেশিকাও ঠিকঠাক ছাপানো হয়নি। প্রতি উপজেলায় ২৫০ কপি নির্দেশিকা ছাপানোর বরাদ্দ থাকলেও মাত্র কয়েক কপি ছাপিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে টানা কয়েক বছর। মহাপরিচালক, মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও এ নির্দেশিকা সেলের কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

অর্থ আত্মসাৎ করতে বাইরের প্রতিষ্ঠানে কাজ

অন্যদিকে আইনে এসব সরকারি বই ছাপানোর কথা সরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে এসব বই ছাপাতে হবে কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে। কিন্তু অর্থ আত্মসাৎ করতে এই কাজটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে করাচ্ছে এসআরডিআই।

জানা গেছে, গত অর্থবছরের এসব বই ছাপানোর আগ্রহ দেখিয়েছিল কৃষি তথ্য সার্ভিস। দরপত্রও দিয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে তদবির করে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এক ধরনের জোরপূর্বক অনাপত্তিপত্র নেয় এসআরডিআই সিন্ডিকেট।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের এখানে ছাপালে তাদের কোনো দুর্নীতি করার সুযোগ নেই। যে কারণে তারা অনাপত্তিপত্র নিয়ে অন্য জায়গা থেকে বইগুলো ছাপানোর কথা বলেন।’

এদিকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে নানান অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে শুরু করে জালাল উদ্দীনসহ একাধিক কর্মকর্তার এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে৷ অভিযুক্তদের মধ্যে আরও রয়েছেন ট্রেনিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সদ্য বিদায়ী প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এবং ডিজির দপ্তরের সংযুক্ত কর্মকর্তা মেহেদী হাসান।

এ সংস্থার বঞ্চিতদের অভিযোগ, মহাপরিচালকের মদতে এ চক্রটি প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছে নানা কৌশলে। পছন্দের অফিসারদের বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে বিভাগীয় কার্যালয় ও গবেষণাগারে বদলি করে উৎকোচ নেওয়া, নিয়োগ বাণিজ্য, কম্পিউটার সামগ্রী, যন্ত্রপাতি ও গবেষণার সরঞ্জাম ক্রয় না করেই টাকা আত্মসাৎ, গবেষণার কাজ না করেই টাকা উত্তোলন এবং কম্পিউটার সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের নামে টাকা লুটপাট করেছে।

এনএইচ/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।