মায়ের গর্ভ থেকেই বৈষম্যের শিকার কন্যাশিশুরা

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৬:২৬ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২৪
ফাইল ছবি

বরিশাল সদরের মধ্যবিত্ত এক পরিবারের গৃহিণী রাজিয়া সুলতানা (ছদ্মনাম)। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে দারুণ সময় কাটছিল তার। বছর ঘুরতেই গর্ভবতী হওয়ার খবরে পুরো পরিবার আনন্দে মেতে ওঠে। তবে সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। গর্ভবতী হওয়ার পর শুরু থেকে পুরো পরিবারের অত্যধিক সমাদর পেলেও আল্ট্রাসনোগ্রামে গর্ভের সন্তান ‘কন্যা’ জানার পর পাল্টে যায় চিত্র। শুরু হয় অবহেলা আর বঞ্চনা।

রাজিয়া সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র ছেলে। যার কারণে শুরু থেকেই অনেক যত্ন পাচ্ছিলাম শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমি যখন গর্ভবতী হলাম তখন পরিবারের আনন্দ দেখে অবাক লেগেছে। আমার দুই ননদ আর শাশুড়ি আমাকে অনেক যত্ন করতো। কিন্তু যখন টেস্ট করে জানা গেল সন্তান মেয়ে, তখন পরিস্থিতি পাল্টে গেলো। মনে হলো সব দোষ আমার। অবস্থা এমন হয়েছিল সন্তান জন্মের দিনও শাশুড়ি আমাকে দেখতে আসেননি।

আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে কথা হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সমাজে এখনও কন্যা সন্তানকে ভালোভাবে গ্রহণ করেন না অনেকে। এ জন্য শুধু পরিবার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা দায়ী বলে মনে করেন তারা। সমাজ ও রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের নানান বৈষম্যের কারণেই মানুষের মাঝে এ ধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছে। ফলে মায়ের গর্ভ থেকেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কন্যাশিশুরা।

তাদের মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ শিশু, যাদের বয়স আঠারো বছরের কম। আর শিশুদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ কন্যাশিশু, যাদের পেছনে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন ছয় মাসে ১৮ জন কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার ২০৫ জন, অপহরণ ও পাচারের শিকার ১৩ জন, আত্মহত্যা করেছে ১০৫ জন, ৬৮ জনকে হত্যা, পানিতে ডুবে ১৩৯ জন, অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় ছয়জন, যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ২ জন, গৃহশ্রমিক হিসেবে কর্মরত একজন শিশু নির্যাতনের শিকার, রহস্যজনক মৃত্যু ১৮ জনের, অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার একজন শিশু।

চলতি বছর মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না বলে রায় দেন হাইকোর্ট। এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত দেশের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যাতে গর্ভাবস্থায় লিঙ্গ পরিচয় শনাক্তকরণকে নিরুৎসাহিত করে এবং গাইডলাইন কঠোরভাবে অনুসরণ করে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভবতী মায়েদের আল্ট্রাসনোগ্রামে সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে সেটি জানার জন্য করা হয় না। সাধারণত ১৮ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয় সন্তানের জন্মগত ত্রুটি আছে কি না সেটি টেস্ট করার জন্য। এ সময় বাচ্চার মোটামুটি গঠন হয়ে যায়। ফলে আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে গর্ভের সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে সেটি বোঝা যায়। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রাম বাচ্চার লিঙ্গ নির্ণয় উদ্দেশ্য নয় বরং বাচ্চার গ্রোথ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেটি এর মূল উদ্দেশ্য। তবে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও চিকিৎসক নিয়ম ভেঙে সন্তানের লিঙ্গ সম্পর্কে পরিবারকে জানিয়ে দেন।

এ বিষয় অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমরা নবজাতকের লিঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিদিন সম্মুখীন হই। তবে আজকালের আধুনিক সমাজে অনেকের মধ্যে ছেলে-মেয়ের বৈষম্য কিছুটা কমেছে। তবুও অনেকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানতে চায় ছেলে নাকি মেয়ে। আমরা কখনই এটা বলি না, সরকারের তরফ থেকে বলা আছে সেটি যেন বলা না হয়। কারণ সেটি বললেই পরিবারের মধ্যে অনেকরকম প্রতিক্রিয়া হয়। অধিকাংশ সময় দেখা যায় গর্ভে মেয়ে সন্তান জানার পর বাসার আনন্দময় পরিবেশটা নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত এগুলো আমরা ফেস করি। বাংলাদেশে পরিস্থিতিটা কিছু পরিবর্তন হলেও সেই নেতিবাচক মনোভাবটা কিছু ক্ষেত্রে রয়েই গেছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের কাছে এ ধরনের সমস্যার কথা শুনেছি। যেমন অনেকেই বলে থাকেন এর অন্যতম কারণ সম্পত্তির উত্তরাধিকার চিন্তা করে হয়। মনে করা হয় মেয়েরা সম্পত্তি কম পাচ্ছে, তারা সম্পত্তি রক্ষা করতে পারবে না। গ্রামগঞ্জে এখনও অনেক বাল্যবিয়ে হয়, এর অন্যতম কারণ কন্যা সন্তানটিকে বোঝা মনে করে দ্রুত বিদায় করা।

গর্ভবতী মায়েদের ওপর চালানো এক জরিপ থেকে জানা যায়, গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারের ৯০ শতাংশের প্রত্যাশা প্রথম সন্তান ছেলে হোক। এর পরের সন্তান ছেলে বা মেয়ে হলেও সেটি নিয়ে তেমন ভাবনা তার থাকে না। অনেকেই দুটি সন্তান হওয়ার পর আবার সন্তান নেন ছেলের আশায়। পরপর তিনটি মেয়ে হওয়ার কারণে সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো ঘটনাও জরিপে উঠে এসেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন নারী জাগো নিউজকে বলেন, আমার তিনটি মেয়ে সন্তান আছে। প্রত্যেকের জন্মই সিজারে। সুতরাং কতটা ধকল আমার ওপর দিয়ে গেছে সেটা শুধু আমিই জানি। তারপরও আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন চাচ্ছে আমি যেন আরেকটা বাচ্চা নেই, এবার হয়তো ছেলে হবে সেটাই তাদের ধারণা। কিন্তু আমিও যে একজন মানুষ সেটা তাদের বোঝাবে কে। সত্যিকার অর্থে আমি মনে করি আমার এ তিন কন্যা সন্তান কোনো অংশই ছেলে সন্তানের চেয়ে কম নয়।

গর্ভপাতের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর রিফাত বিন সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, আমার কাছে এ মুহূর্তে গর্ভপাতের ঘটনা আছে কি না সেই তথ্য নেই। তবে এখনও মনে করা হয় মেয়েরা বোঝা। কারণ হলো মেয়েরা সবসময় আমাদের ঘরে থাকবে না, তাদের জন্য বিনিয়োগ করে লাভ নেই। আর ছেলে তো সবসময় থাকবে। এ ধরনের একটি বৈষম্য আসলে ছোটবেলা থেকেই তৈরি করা হয়। যার কারণে পুত্র ও কন্যা দুজনের ছোটবেলা বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করা হয়। আমরা মনে করি, এ বৈষম্য রোধে বাধা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। কারণ রাষ্ট্রের আইনকানুনের মধ্যে কিছু ঝামেলা আছে। সমাজের চিন্তাধারার সমস্যা আছে। আর পরিবার তো নানানভাবে প্রভাবিত হয়। তিনটা জায়গায়ই বাধাটা রয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে এ ধারণা আমরা পোষণ করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, শুধু গ্রামেই না শহরেও অনেকক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায়। আমরা সবসময় দোষটা দিয়ে আসছি গ্রামাঞ্চলে বা যেখানে শিক্ষার হার কম সেখানে এমনটা বেশি ঘটে। কিন্তু শহরেও শিক্ষিত পরিবারেও অনেকক্ষেত্রে সেটা হয়। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। এটা তো শুধু শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয়, সামগ্রিকভাবে এমন একটা চিন্তা তৈরি করে রাখা হয়েছে। যারা এ ধারণা পোষণ করছেন তারাও তো সমাজের একটা অংশ। যার কারণে অনেকসময় শিক্ষিত বাবাও মনে করছে আমার একটা ছেলে দরকার। উত্তরাধিকার, বিনিয়োগ যেটাই বলি তার কাছে মনে হচ্ছে আমার একটা ছেলেই দরকার। এটার অন্যতম কারণ হচ্ছে কন্যা যে দক্ষ জনশক্তি বা সম্পদ সে হিসেবে দেখাই হয়নি। তাই মেয়েরাও যে সম্পদ, তারাও যে দক্ষ জনশক্তি সেটি আরও বেশি করে সমাজের সামনে তুলে ধরতে হবে। মেয়েরা তো এখন সবক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস বলেন, বৈষম্যটা শুরু হয় মায়ের গর্ভ থেকেই, সেটা একটা পটভূমি। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটি প্ররোচিত করে বিশেষ করে বাবা-মাকে সেটা হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন রীতি-নীতি, বিশ্বাস, সামাজিক চিন্তা-ভাবনা। যেমন আমাদের দেশে মেয়েরা শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় পিছিয়ে থাকে। পারিবারিক-ভাবে মেয়েরা সাধারণত জমির বা ভূমির আইনগুলো অনুযায়ী মেয়েদের সমান অধিকার থাকে না। ফলে একটা মেয়ের জন্মের পর এমনভাবে তাকে রাখা হয় যে সে বাবা-মায়ের সন্তান হলেও পরিবার ও সমাজের জন্য তেমন কিছু নিয়ে আসতে পারছে না। ফলে পরিবারের খরচ বা বোঝা হিসেবে তাকে দেখা হয়। কারণ সব জায়গায় বৈষম্যের শিকার হয়ে সে বেড়ে উঠছে। কিন্তু একজন ছেলেকে ইতিবাচকভাবে দেখা হয়। বলা হয়, সে শিক্ষিত হবে, চাকরি করবে, বাবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে কাজ করতে পারবে। এটাও সামাজিক রীতি-নীতির অংশ। ফলে বাবা মা মনে করে আমার যদি মেয়ে হয় সে তো শুরু থেকেই নেগেটিভ জায়গায় চলে যাবে। সেজন্য গর্ভ থেকেই বলা হয় মেয়েরা বৈষম্যের শিকার হয়। বৈষম্যের শুরুটা বাবা-মা করলেও এটি সমাজের রীতি-নীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়।

তিনি আরও বলেন, অনেক বাব-মা আছে কন্যা সন্তানের অপেক্ষায় থাকে। তারা পুত্র বা কন্যা উভয়কেই সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বড় করে থাকেন। কিন্তু এ সংখ্যাটা খুবই কম। এ সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। কন্যা সন্তান বোঝা না, বরং কন্যা সন্তান পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে সে শিক্ষিত হতে পারে, পরিবারের দক্ষ হতে পারে, পরিবারের হাল ধরতে পারে, একইভাবে রাষ্ট্রের হাল ধরতে পারে, অর্থনীতিতে সমানভাবে অবদান রাখতে পারে সেটি নিয়ে কাজ করতে হবে। সমাজের অনেক কার্যক্রম আছে যেটা ছেলেরাই করবে তেমন একটি সংস্কৃতি আমরা তৈরি করেছি। ফলে পরিবারের ছেলে না থাকলে সেই পরিবার অসহায় সেটি সমাজ বলছে। কিন্তু বিয়ের পর যে মেয়ে নিজের পরিবারের দায়িত্বও নিতে পারে সেটি সামাজিকভাবে মনে করা হয় না, ফলে নিজেদের ভবিষ্যতের স্বার্থে বাবা-মাকেও পুত্র সন্তানের কথা ভাবতে হয়।

আইএইচআর/এমএএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।