জাতীয় জলবায়ু অর্থায়নে আঞ্চলিক ন্যায্যতা নিশ্চিতের দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ এএম, ০৬ অক্টোবর ২০২৪
সিক্স সিজন হোটেলে সেমিনার আয়োজন করে সিপিআরডি/ ছবি- সংগৃহীত

দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। খরাপ্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ট্রাস্ট ফান্ড থেকে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৪৩টি। অথচ দেশের দুই উপকূলীয় বিভাগ চট্টগ্রাম এবং বরিশালে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৮১ প্রকল্প। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে খরাপ্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ৬৩টি প্রকল্প চলমান।

রোববার (৫ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকার গুলশান-২ এ এক স্টাডি শেয়ারিং সেমিনারে এসব তথ্য উঠে আসে। সিক্স সিজন হোটেলে এ সেমিনার আয়োজন করে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)।

সিপিআরডি ও হেক্স/ইপিইআর কর্তৃক পরিচালিত এ গবেষণায় মাঠ পর্যবেক্ষণ অংশ পরিচালনা করা হয় দেশের খরাপ্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং কুড়িগ্রাম জেলায়।

দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করা প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও জলবায়ু বিপদাপন্ন মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে বরাদ্দ পদ্ধতি, ন্যায্যতা, উপযুক্ততা, কার্যকারিতা নিরূপণে এই গবেষণা করা হয়।

সেমিনারে গবেষণা ফলাফলের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামছুদ্দোহা।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জলবায়ু বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আকস্মিক দুর্যোগজনিত জলবায়ু ঝুঁকির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ ধীরলয়ের দুর্যোগের (বিশেষ করে খরা) ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবিলায় অর্থায়নের গুরুত্ব তুলনামূলক কম প্রতিফলিত হয়েছে।

এছাড়া, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বরাদ্দকৃত প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে, যেগুলোর আর্থিক মূল্য ২ হাজার ৯৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এছাড়া বরাদ্দ প্রকল্পের যথাযথ মনিটরিং ও মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। ফলে এ প্রকল্প থেকে নির্মিত অবকাঠামো ঝুঁকি কমানোর পরিবর্তে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থিমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৭টি প্রকল্প, যার আর্থিক মূল্য মাত্র ৩২ কোটি ২৪ লাখ টাকা। গবেষণায় দেখা গেছে স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৭৯ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার আর্থিক মূল্য এক হাজার ৩৯৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে পয়োনিষ্কাশন উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে, যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার সম্পর্ক কম। সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করা কৃষি মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যথাক্রমে পেয়েছে ২৩টি এবং ৯টি প্রকল্প।

আরও পড়ুন

২০২২-২৩ অর্থবছরেও জাতীয় জলবায়ু বাজেটের ৪২ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রকল্প গেছে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা থিমে।

সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০ এর পদ্ধতিগত সংস্কার এবং জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে প্রকল্প বরাদ্দ এবং প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফলাফল-কেন্দ্রিক মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।

তিনি জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজন ভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত বরাদ্দ নিশ্চিত করার দাবি জানান। পাশাপাশি সমতল ভূমির আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক/স্বতন্ত্র অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি এবং এটিকে ন্যাপ (এনএপি) অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।

এছাড়া তিনি প্রতিটি জলবায়ু বিপন্ন এলাকার জন্য আলাদা বিপদাপন্নতা নিরূপণসমীক্ষা, সকল লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক জীবিকা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এনডিসি বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্বন নির্গমন সংকোচন পদ্ধতি উন্মোচনের ওপর জোর দেন।

সেমিনারের গেস্ট অব অনার ঢাকার সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন করিন হেনচোজ পিগনানি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মানবকল্যাণ সবচেয়ে জরুরি বিষয়।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কোনো একক এবং সর্বব্যাপী সমাধান নেই। কাজেই আমাদের জীবনের ব্যবহারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে, একই সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন সমাধান পরিকল্পনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন পরিকল্পনায় অর্থবহ সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতা অর্জন করা সম্ভব। স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।

পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলা করতে হলে স্থানীয় প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, আর্থসামাজিক অবস্থাগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যা জলবায়ু ঝুঁকিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে তিনি জলবায়ু অর্থায়নের কাঙ্ক্ষিত ফল নিশ্চিত করতে অর্থায়নকে সংশ্লিষ্ট সব খাতের সঙ্গে সমন্বিত করার ওপর গুরুত্ব দেন।

সমাপনী বক্তব্যে হেক্স/ইপিইআর কান্ট্রি ডিরেক্টর ডোরা চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী ও সুন্দর নীতিকাঠামো আছে। কিন্তু প্রচণ্ড কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা এবং টপ-ডাউন পরিকল্পনা পদ্ধতির কারণে এখনো জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জন অধরা থেকে গেছে। তিনি জাতীয় জলবায়ু বাজেট বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো আরও বেশি বিবেচনায় নেওয়া এবং ন্যায়সঙ্গত বরাদ্দের দাবি জানান।

এসআরএস/কেএসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।