চট্টগ্রামে তেলবাহী জাহাজে আগুন

পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তদন্ত কমিটির পাঁচ পর্যবেক্ষণ, চার সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৯:০৪ এএম, ০১ অক্টোবর ২০২৪

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে পেট্রোলিয়াম জ্বালানিবাহী ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ও আগুন লাগার ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) গঠিত তদন্ত কমিটি।

সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতেই বিপিসি প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির আহ্বায়ক ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরিফ হাসনাত। এসময় কমিটির অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি পাঁচটি পর্যবেক্ষণ এবং চারটি সুপারিশ দিয়েছে।

জাগো নিউজের হাতে আসা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সোমবার ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারির ৭ নং ডলফিন জেটিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন বাংলার জ্যোতি ট্যাংকার জাহাজটিতে বিস্ফোরণের পর অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় জাহাজের ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন নিহত হন।

জানা গেছে, জাহাজটি ৩৮ বছরের পুরোনো। অনেক আগেই জাহাজটি স্ক্র্যাপিং করার সিদ্ধান্ত ছিল বিএসসির। অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরেও জাহাজটি ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনা তদন্তে তিনটি পৃথক কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএ) এবং বিএসসি।

সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফ হাসনাতকে আহ্বায়ক ও সংস্থাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং ও শিপিং) মো. মোস্তাফিজার রহমানকে সদস্য সচিব করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিপিসি। বিপিসির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এটিএম সেলিম স্বাক্ষরিত পত্রে গঠিত কমিটিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার, বিপিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন) মো. জাহিদ হোসাইন, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) মুজিবুর রহমান চৌধুরী, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) আসিফ মালিক ও যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) মো. হেলাল উদ্দিন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আবুধাবি থেকে প্রায় ৯৮ হাজার ৩৮৩ মেট্রিক টন মারবান ক্রুড অয়েলবাহী মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগেসি গত ১৭ সেপ্টেম্বর কুতুবদিয়া বহির্নোঙরে আসে। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ক্রুড লাইটারিং শুরু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে এমটি বাংলার জ্যোতি ১১ হাজার ৭১৬ দশমিক ৪৪৬ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল নিয়ে ডলফিন জেটি-৭ এ আসে। সকাল ১০টায় খালাস শুরু হয়। সকাল ১০টা ৫৪ মিনিটে ক্রুড খালাসের সময় জাহাজের সম্মুখভাগে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন লাগে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিকাণ্ডে তিনজন নিহত হন। তন্মধ্যে একজন জাহাজের ডক ক্যাডেট ও দুইজন বিএসসির মেরিন ওয়ার্কশপের কর্মচারী।

কমিটির পাঁচ পর্যবেক্ষণ:

বিপিসির গঠিত কমিটি ৫ পর্যবেক্ষণ দিয়েছে প্রতিবেদনে। ক) এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজের সম্মুখভাগে অবস্থিত ফোর পিক স্টোর (জাহাজের রশি, নোঙর, স্পেয়ার পার্টস রাখার স্থান) হতে বিস্ফোরণের ফলে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে মর্মে কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। উক্ত ফোর পিক স্টোর-এ বিপুল পরিমাণ ফ্লামেবল গ্যাস জমা হওয়ার কারণে এ ধরনের তীব্র বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে কমিটি মনে করে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে জাহাজের সম্মুখভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

খ) দুর্ঘটনার পূর্বে জাহাজ হতে প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল খালাস সম্পন্ন হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। জাহাজে বিদ্যমান অবশিষ্ট প্রায় ১০ হাজার ৯১৬ দশমিক ৪৪৬ মেট্রিক টন কার্গো নিরাপদে রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে কার্গোর গুণগত মান অক্ষুণ্ন রয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যাচ্ছে। আগুন কার্গো ট্যাংকে ছড়িয়ে পড়লে জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারতো।

গ) বিএসসি'র সূত্রে জানা যায়, জাহাজে বিদ্যামন অবশিষ্ট কার্গো খালাসের লক্ষ্যে জাহাজের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি পরিদর্শন করবেন। জাহাজটি নিরাপদ হিসেবে প্রত্যায়িত হলে জাহাজের অন্যান্য মেশিনারিজ ঠিক থাকা সাপেক্ষে কার্গো খালাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করতে প্রায় ২২ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হবে। কার্গো খালাস সম্পন্ন করা হলে জাহাজটি মেরামত/ সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরিয়ে নেওয়া হবে।

ঘ) অপর লাইটার জাহাজ এমটি বাংলার সৌরভ কার্গোবোঝাই করে ডলফিন জেটি-৭ এ অপেক্ষায় রয়েছে। এমটি বাংলার জ্যোতি সরিয়ে নেওয়ার পর এমটি বাংলার সৌরভ ডলফিন জেটি-৭ এ বার্থিং করবে। মাদার ভ্যাসেলে বিদ্যমান অবশিষ্ট কার্গো এমটি বাংলার সৌরভ এর মাধ্যমে খালাস সম্পন্ন করা হবে।

ঙ) বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ জাহাজ দুটি ১৯৮৭ সালে নির্মিত। জাহাজ দুটির আয়ুস্কাল প্রায় ৩৭ বছর। এই দুইটি জাহাজের বিকল্প জাহাজ দেশের অভ্যন্তরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ ধরনের জাহাজের বিকল্প না থাকায় উক্ত জাহাজ ২টি যথাযথ মেরামত/রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে চালু রাখা হয়েছে।

চার সুপারিশ:

বিপিসির গঠিত ৭ সদস্যের কমিটির প্রতিবেদন চারটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো

ক) দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন, ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও বিদ্যমান লাইটার জাহাজ দুইটির ব্যবহারের উপযুক্ততা নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠনের জন্য বিএসসিকে অনুরোধ করা যেতে পারে।

খ) বিএসসির লাইটার জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল লাইটারিং কার্যক্রম পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে অপারেশন অ্যান্ড মেনটেনেন্স ঠিকাদার নিয়োগ দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা গেলে নিরাপদে ক্রুড অয়েল খালাস করা সম্ভব হবে।

গ) এসপিএম এর মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপারেশন অ্যান্ড মেনটেনেন্স ঠিকাদার নিয়োগ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজকে কার্যকরভাবে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব কি না বা সম্ভাব্য বিকল্প এর বিষয়ে বিএসসি'র মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে।

ঘ) জেটিসমূহে বিদ্যমান অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাদি আরও আধুনিকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বহির্নোঙর থেকে প্রায় ১০ হাজার টন ক্রুড নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গাস্থ ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে আসে এমটি বাংলার জ্যোতি। জেটিতে বার্থিং করা অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ফায়ার ফাইটিং টিম অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে।

এমডিআইএইচ/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।