পতেঙ্গা

জাহাজটি ৩৮ বছরের পুরোনো-ত্রুটিপূর্ণ, স্টোরে জমা গ্যাসেই বিস্ফোরণ

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৯:৩৯ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজ/সংগৃহীত

পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারির ৭ নম্বর ডলফিন জেটিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মালিকানাধীন বাংলার জ্যোতি ট্যাংকার জাহাজে বিস্ফোরণ হয়। এতে মারা যান তিনজন। স্টোরে জমে থাকা গ্যাস থেকেই জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজটিতে বিস্ফোরণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, জাহাজটি ৩৮ বছরের পুরোনো। অনেক আগেই জাহাজটি স্ক্র্যাপিং করার সিদ্ধান্ত ছিল বিএসসির। অনেকটা ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরেও জাহাজটি ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। দুর্ঘটনায় নিহত তিনজন হলেন- জাহাজের ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, বিএসসির ফোরম্যান নুরুল ইসলাম ও শ্রমিক মো. হারুন। এ ঘটনা তদন্তে তিনটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএ) এবং বিএসসি।

বিপিসির গঠিত কমিটির সদস্যরা জাহাজটি পরিদর্শন করছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্টোররুমে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ হয়েছে। সম্ভবত নিহত তিনজনই ওই স্থানে ছিলেন।-পদ্মা অয়েলের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) আসিফ মালিক

সূত্র জানায়, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফ হাসনাতকে আহ্বায়ক ও সংস্থাটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যানিং ও শিপিং) মো. মোস্তাফিজার রহমানকে সদস্য সচিব করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিপিসি। বিপিসির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এটিএম সেলিম স্বাক্ষরিত চিঠিতে গঠিত কমিটিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আজকের মধ্যেই প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

জাহাজটি ৩৮ বছরের পুরোনো-ত্রুটিপূর্ণ, স্টোরে জমা গ্যাসেই বিস্ফোরণ

এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাত সদস্যের অভ্যন্তরীণ আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে গঠিত কমিটিকে ১ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সাত সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান বিএসসি। বিএসসির সচিব (সরকারের উপসচিব) আবু সাফায়াৎ মুহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে ওই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার কারণ, দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণী, অনুরূপ দুর্ঘটনা রোধকল্পে ভবিষ্যতে করণীয় সুস্পষ্ট সুপারিশসহ সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

বিপিসি ও বিএসসির দুই কমিটিতে রয়েছেন বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার। তিনি সোমবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন। বিপিসির গঠিত কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও দুর্ঘটনাকবলিত জাহাজটি পরিদর্শন করেন।

জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাহাজের স্টোররুমে বিস্ফোরণটি হয়। স্টোররুমে খুব সম্ভবত গ্যাস জমে ছিল। নিয়মমাফিক জাহাজের স্টোর খুললে একটি নির্ধারিত ফ্যান চালু করতে হয়। ওই ফ্যানটি চালু করতেই বিস্ফোরণটি হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।’

আমরা ইচ্ছা করে জাহাজটি ব্যবহার করিনি। দেশের স্বার্থে, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলার জ্যোতিকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কারণ বিপিসি তাদের এসপিএম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসপিএম নির্মাণ হয়েছে। এসপিএম পুরোপুরি কার্যকর হলে আমাদের ট্যাংকার জাহাজ দুটির আর প্রয়োজন হবে না।- বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক

তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের সময় স্টোরের মধ্যে নিহত তিনজনই ছিলেন। তিনজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে একজনের মরদেহ চিহ্নিত করা যায়নি। এখন মরদেহের ময়নাতদন্ত চলছে। সবমিলিয়ে কমিটির সবাই বসে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

বিপিসির গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) আসিফ মালিক ঘটনাস্থল থেকে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিপিসির গঠিত কমিটির সদস্যরা জাহাজটি পরিদর্শন করছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্টোররুমে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ হয়েছে। সম্ভবত নিহত তিনজনই ওই স্থানে ছিলেন।’

স্ক্র্যাপিং করার কথা ছিল জাহাজটি

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এমটি বাংলার জ্যোতি জাহাজটি ১৯৮৬ সালে নির্মিত হয়। ১৯৮৮ সালে জাহাজটি নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজটির মালিক বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। পুরোনো হওয়ায় জাহাজটি ইতোমধ্যে স্ক্র্যাপিং করারও সিদ্ধান্ত নেয় বিএসসি। দুর্ঘটনার আগেও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বিপিসি তাদের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) বাণিজ্যিকভাবে চালু না করায় অনেকটা বাধ্য হয়েই এমটি বাংলার জ্যোতিকে ক্রুড লাইটারিংয়ে ব্যবহার করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক।

সোমবার সন্ধ্যায় তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ইচ্ছা করে জাহাজটি ব্যবহার করিনি। দেশের স্বার্থে, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলার জ্যোতিকে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কারণ বিপিসি তাদের এসপিএম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসপিএম নির্মাণ হয়েছে। এসপিএম পুরোপুরি কার্যকর হলে আমাদের ট্যাংকার জাহাজ দুটির আর প্রয়োজন হবে না।’

জাহাজটি ৩৮ বছরের পুরোনো-ত্রুটিপূর্ণ, স্টোরে জমা গ্যাসেই বিস্ফোরণ

তিনি বলেন, ‘আরও আগে থেকেই বিপিসি এসপিএম চালুর কথা ছিল। সে অনুযায়ী বাংলার জ্যোতি ও বাংলার সৌরভ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এসপিএম পুরোপুরি চালুর কথা রয়েছে। তখন চাইলেও ইন্টারন্যাশনাল রুটে আমি জাহাজটি দুটি চালাতে পারবো না। তারপরেও যদি বিপিসির ক্রুড লাইটারিং করতে হয়, সেজন্য জাহাজ দুটি মেরামতের জন্য একমাসের সময় চাইবো। এক মাসের মধ্যেই জাহাজটির ইঞ্জিনের যত কাজ আছে তা করে নেবো।’

কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাহাজের প্রি-ডকিং শিডিউল থাকে। কিন্তু এ জাহাজের ক্ষেত্রে কোনো ডকিং শিডিউল ছিল না। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জাহাজটি আমরা ব্যবহার করছি। কারণ এসপিএম চালু হলে জাহাজ দুটির কোনো প্রয়োজন পড়বে না। আবার এখন এসপিএম চালু না হলেও বিপিসির ক্রুড লাইটারিং করার জন্য দুটি জাহাজ কিনতে হলে অন্তত ৬শ থেকে ৭শ কোটি টাকা লাগবে। নতুন জাহাজ কিনলেও এসপিএম চালু হলে তাও কাজে আসবে না।’

এর আগে, সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বহির্নোঙর থেকে প্রায় ১০ হাজার টন ক্রুড নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ডলফিন জেটিতে আসে এমটি বাংলার জ্যোতি। জেটিতে বার্থিং করা অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ফায়ার ফাইটিং টিম অগ্নিনির্বাপণে কাজ করে। নিহত হন তিনজন।

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।