পট পরিবর্তন

ক্ষতির পরিমাণ কমলো মেট্রোরেল-সেতু ভবন মেরামতে

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ১২:১৫ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

• আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মেট্রোরেলের ক্ষতি বলা হয়েছিল ৩৫০ কোটি টাকা। এখন ২০ লাখে চালু কাজীপাড়া স্টেশন, মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা

• সেতু ভবনের ক্ষতি বলা হয়েছিল ৩০০ কোটি টাকা, এখন মন্ত্রণালয়ে হিসাব দেওয়া হয়েছে ১১২ কোটি টাকার

কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মেট্রোরেল, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটে। এ হামলায় কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন মেরামতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে বলা হয়েছিল।

তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অনেক দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। মাত্র ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকায় কাজীপাড়া স্টেশন চালু করেছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচে চালু করা সম্ভব বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

‘অল্প টাকায় কাজীপাড়া স্টেশন চালু করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এভাবে যদি সব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তা হলে দেশ এগিয়ে যাবে। তাই এই দৃষ্টান্ত যাতে বাংলাদেশে অব্যাহত থাকে। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন তা ফলো করেন।’-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান

বনানীতে সেতু ভবনে হামলার পর বলা হয়েছিল এ ভবনের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এখন বলা হচ্ছে, আদতে ভবনটির ওই পরিমাণ ক্ষতি হয়নি। আগের হিসাবটি ছিল কাল্পনিক।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে যেসব স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তার প্রায় সব হিসাব কাল্পনিক ছিল বলে মনে করেন অংশীজনরা। তারা জানান, শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকলে হয়তো তারা এই ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বাড়িয়ে দেখাতেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি। এখন যেসব স্থাপনা মেরামতে খরচের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তা বিশ্বাসযোগ্য। তারপরও স্বচ্ছতার সঙ্গে সরকারকে টাকা ব্যয় করতে হবে।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার উন্নয়নের নামে বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তারা জনস্বার্থের নামে যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এখন মেট্রোরেল, সেতু ভবন মেরামতে যে হিসাবটি দেওয়া হচ্ছে, তা তারই একটি ছোট দৃষ্টান্ত।

‘কাজীপাড়া স্টেশনটি ঠিকঠাক করতে আপাতত আমাদের খুব বেশি অর্থ ব্যয় হয়নি। তবে মিরপুর-১০ স্টেশনের যেসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, সেগুলো আমদানি করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা যে হিসাব করেছি, তাতে মনে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনটি মেরামতে ১০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে না।’ ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অল্প টাকায় কাজীপাড়া স্টেশন চালু করে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এভাবে যদি সব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তা হলে দেশ এগিয়ে যাবে। তাই এ দৃষ্টান্ত যাতে বাংলাদেশে অব্যাহত থাকে। ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন তা ফলো করেন।

ক্ষতির পরিমাণ কমলো মেট্রোরেল-সেতু ভবন মেরামতে

মেট্রোরেলে ক্ষতি ৩৫০ কোটি টাকা!

গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রো স্টেশনের নিচে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফলে সেদিন বিকেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে ডিএমটিসিএল। এর পরদিন মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ।

‘অগ্নিকাণ্ডের পর আনুমানিক হিসাব করে সেতু ভবনের ক্ষতি ৩০০ কোটি বলা হয়েছিল। তবে এ হিসাবটি ছিল কাল্পনিক। ভবনটি যদি নতুন করে নির্মাণ করা হতো, তা হলে এই পরিমাণই অর্থই খরচ হতো।’ বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক রশিদুল হাসান

২৭ জুলাই সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না। মেরামতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে।'

তবে গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ৯ সেপ্টেম্বর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এ পদে নিয়োগ পান প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রউফ। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই দুটি স্টেশন মেরামতে এতো বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়বে না।

পরে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশন চালু হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশনও দ্রুত চালু করা হবে বলে জানায় সংস্থাটি। এ স্টেশনে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তাই এটি সংস্কারে হয়তো ১০০ কোটি টাকার মতো লাগবে।

‘অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের পর তাৎক্ষণিক ওই হিসাবটা করা হয়েছিল। পরে আবার সঠিকভাবে ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে, যা আগের টাকার চেয়ে অনেক কম।’ ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম

জানতে চাইলে আব্দুর রউফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাজীপাড়া স্টেশনটি ঠিকঠাক করতে আপাতত আমাদের খুব বেশি একটা অর্থ ব্যয় হয়নি। তবে মিরপুর-১০ স্টেশনের যেসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, সেগুলো আমদানি করতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে আমরা তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন হাতে পাবো। তখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং খরচের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা যে হিসাব করেছি, তাতে মনে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশনটি মেরামতে ১০০ কোটি টাকার বেশি লাগবে না।’

ক্ষতির পরিমাণ কমলো মেট্রোরেল-সেতু ভবন মেরামতে

সেতু ভবনে ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা!

গত ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সেতু ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সেতু ভবনের কেয়ারটেকার রবিউল ইসলাম বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সেতু ভবনের ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, আসামিরা সেতু ভবন ভাঙচুর করে ভেতরে থাকা ৩২টি জিপ গাড়ি, ৯টি পিকআপ, ৭টি মাইক্রোবাস, একটি মিনিবাস, ৫টি মোটরসাইকেল, একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে পুরো ভবনটি ভস্মীভূত হয়ে যায়। আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন হয়।

তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর এই ভবনের ১১২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। পরে গত ১৮ আগস্ট ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ভবন পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) রশিদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সেতু ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর আমরা ভেবেছিলাম, ভবনটি হয়তো আর ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু পরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলা ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনের বাকি তলাগুলো ব্যবহার করা যাবে। সে অনুযায়ী এখন সেতু ভবনের ছয় থেকে ১০ তলা পর্যন্ত অফিস চলছে।’

রশিদুল হাসান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের পর আনুমানিক হিসাব করে সেতু ভবনের ক্ষতি ৩০০ কোটি বলা হয়েছিল। ভবনটি যদি নতুন করে নির্মাণ করা হতো, তা হলে এই পরিমাণই অর্থই খরচ হতো।’

ক্ষতির পরিমাণ কমলো মেট্রোরেল-সেতু ভবন মেরামতে

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা!

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই মহাখালীতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। আগুনে ৯ তলা ভবনটির সামনের অংশ পুড়ে পুরোপুরি কালো হয়ে গেছে। আর ভবনটির সামনে ও পার্কিংয়ে থাকা অর্ধশতাধিক গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়। অন্তত পাঁচশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।

২৭ জুলাই সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন পরিদর্শন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি এই ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত চক্রকে দায়ী করে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন।

ক্ষতির পরিমাণ কমলো মেট্রোরেল-সেতু ভবন মেরামতে

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির ক্ষতি ২১১ কোটি টাকা!

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। একই সময় প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। এই দুটি সংস্থা পৃথকভাবে এই পরিমাণ টাকা চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করেছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো অর্থসহায়তা পায়নি।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম মুঠোফোনে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ড ও ভাঙচুরের পর তাৎক্ষণিক ওই হিসাবটা করা হয়েছিল। পরে আবার সঠিকভাবে ক্ষতির হিসাব করা হয়েছে, যা আগের টাকার চেয়ে অনেক কম।’ তবে সঠিক হিসাবটা বলতে পারেননি তিনি।

এমএমএ/এমএমএআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।