গুলিবিদ্ধ রায়হানের অস্ত্রোপচার

মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল অক্ষমতা জানালেও সফল নিউরোসায়েন্স

আবদুল্লাহ আল মিরাজ
আবদুল্লাহ আল মিরাজ আবদুল্লাহ আল মিরাজ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৪ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কিশোর রায়হান আহমেদ-সংগৃহীত ছবি
  • সফল সার্জারিতে রায়হানের জীবন বাঁচলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে লাগবে লম্বা সময়
  • বিদেশমুখী না হয়ে দেশের চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখা উচিত বললেন চিকিৎসক

দশম শ্রেণির ছাত্র রায়হান আহমেদ, বাড়ি সিলেট। ১৬ বছর বয়সী এই কিশোর গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে সিলেট নগরীতে সরব ছিল। দুপুরে খাওয়া ও বিশ্রামের জন্য বড় ভাই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। এরপর শেখ হাসিনার দেশ থেকে পালানোর খবরে বিজয় উল্লাস করতে সবার সঙ্গে আবারও রাজপথে নামে রায়হান। কিন্তু এই বিজয় উল্লাসে নেমেই মরহুম আজাদ চত্বরের পাশে তার মাথায় গুলি লাগে। বর্তমানে সে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ ১ এর ৪ নম্বর বেডে ভর্তি আছে।

রায়হান এখন শুনতে পারে, কিন্তু কথা বলতে চেষ্টা করেও আওয়াজ বের হয় না। দুই পা এখনো প্যারালাইজড। কতদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে তা জানা নেই। আবার সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হবে কি না তাও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। তবে ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করেন তারা।

সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল-সংগৃহীত ছবি
সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল-সংগৃহীত ছবি

মাথায় গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত রায়হান প্রাণে বাঁচবে কি না তা নিয়ে ছিল সংশয়। সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিতে চাইলেও সেখানকার চিকিৎসকরা মেডিকেল হিস্টোরি দেখে তার সার্জারি করতে অক্ষমতা জানান। তবে এই সার্জারি বাংলাদেশেই নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের হাতে সফলভাবে সম্ভব হয়।

রায়হানের বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিলাম ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ডালী পাড়ায়। সে সিলাম পিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট সে।

৫ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তার ভাই মুজিবুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ৪ আগস্ট বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমরা সিলাম পিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করি। এর পরদিনও একই জায়গায় আন্দোলন শুরু হয়। সেদিন দুপুর ১টার দিকে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেই। কিন্তু বিকেল ৩টায় সরকার পতনের খবরে দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। এরপর আমরা আজাদ চত্বরে আসি। সেখানে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত ছিল। তার পাশেই ছিল দক্ষিণ সুরমা থানা।

মুজিবুর রহমান জানান, যখন সব আশা নিভে আসছিল ডা. মাহফুজ বলেছেন কিছু রিস্ক আছে তোমরা চাইলে আমরা সার্জারি করতে পারি। আমরা তখন তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দেই। আমার ভাইকে বাঁচাতে চাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে এই সার্জারি সফল হয়। আমার ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসে। ৯ সেপ্টেম্বর তার সার্জারি হয়। দেড় ঘণ্টার সার্জারি শেষে আধা ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরে।

তিনি জানান, বিজয় উল্লাসের মিছিল থেকে থানায় হামলা হবে মনে করে সেখান থেকে বের হতে ফাঁকা গুলি করে সেখানকার পুলিশ। কয়েকজন পুলিশ সরাসরি গুলিও করে। তাদের মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইয়ারদৌস হাসানের নির্দেশে গুলি চালানো হয়। তাদের গুলিতে সেখানে দুজন আহত ও একজন মারা যায়।

চিকিৎসাধীন রায়হান ও গুলিবিদ্ধ অবস্থার ছবি
চিকিৎসাধীন রায়হান ও গুলিবিদ্ধ অবস্থার ছবি

মুজিবুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি লাগে। সেখানকার মানুষ তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত সে সেখানেই ছিল। এরপর এলাকার বিত্তশালীদের আর্থিক সহযোগিতায় ১৭ তারিখ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এখানে এসে ভর্তি করা হয় নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. মাহফুজুর রহমানের অধীনে। তার অস্ত্রোপচার অনেকটা জটিল হওয়ায় ডাক্তাররা জানান সার্জারিতে ভয় আছে। এরপর আমরা হাসপাতালের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যোগাযোগ করি। তবে সেখানকার চিকিৎসক জানান সার্জারি করে ভালো কিছু হবে না। সার্জারির সময় মৃত্যুও হতে পারে। এরপর চলতি মাসের ১ তারিখ সিঙ্গাপুরে ফাইল পাঠানো হয়। ৪ সেপ্টেম্বর তারা এই সার্জারি করতে অক্ষমতা জানান।

তিনি বলেন, যখন সব আশা নিভে আসছিল ডা. মাহফুজ বলেছেন কিছু রিস্ক আছে তোমরা চাইলে আমরা সার্জারি করতে পারি। আমরা তখন তার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের হাতে ছেড়ে দেই। আমার ভাইকে বাঁচাতে চাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে সার্জারি সফল হয়। আমার ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে আসে। ৯ সেপ্টেম্বর তার সার্জারি হয়। দেড় ঘণ্টার সার্জারি শেষে আধা ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে।

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে কথা হয় রায়হানের বাবা নানু মিয়ার সঙ্গে। তিনি আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। সন্তান বেঁচে ফেরায় আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান এবং ডাক্তার নিজ আগ্রহ থেকে চিকিৎসা দেওয়ায় তাকেও ধন্যবাদ জানান।

নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল-ফাইল ছবি
নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল-ফাইল ছবি

তিনি জাগো নিউজকে জানান, রায়হান সম্পূর্ণ সুস্থ কখন হবে তা জানা নেই। তবে ডাক্তার বলেন সময় লাগবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই জটিল সার্জারি করা চিকিৎসক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, রায়হান আমাদের এখানে ভর্তি ছিল। তার কমপ্লেক্স ডিপরেস ফ্র্যাকচার। আমাদের একটি অপারেশনের প্ল্যান ছিল। তার ব্রেনের রক্তনালির সাইনাসে হাড়ভাঙা অংশ ঢুকে ছিল। এই সার্জারিতে ঝুঁকি থাকায় আমরা তার বাবা ও ভাইকে বিষয়টি জানাই। তখন তারা সিঙ্গাপুর বা দেশের বাইরে কোথাও করানোর কথা বলি। সিঙ্গাপুর থেকে তাদের জানায়, এটি করে তেমন লাভ হবে না। এ বিষয়ে করার মতো খুব একটা কিছু নেই। তখন তারা দেশে করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি যখন তাদের (সিঙ্গাপুরের) দেওয়া জবাবটি দেখি। তারা এই সার্জারির ঝুঁকি ও এটি করে খুব একটা উন্নতি হবে না বলে দুঃখ প্রকাশ করে। তাদের মতামতে আমার আপত্তি ছিল। এই রোগীর ক্ষেত্রে সার্জারি বাধ্যতামূলক ছিল। সার্জারি ছাড়া তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সার্জারি করলে তার অবস্থার অবশ্যই কিছুটা উন্নতি হবে। এই দুটি পয়েন্টে তাদের মতামতের বিষয়ে আমার আপত্তি ছিল।

তিনি বলেন, আমরা রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে সার্জারি করার ইচ্ছে প্রকাশ করি। একইসঙ্গে সার্জারির টেবিলে মৃত্যু ঝুঁকির বিষয়টিও জানাই। পরে তাদের সম্মতিতে আমি ও আমার কয়েকজন সহযোগী অপারেশন করি এবং আলহামদুলিল্লাহ তা সফল হয়েছে।

বাংলাদেশের নিউরো সার্জনরা এ ধরনের সার্জারি করতে সক্ষম। তাই বিদেশমুখী না হয়ে দেশের চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখা উচিত। আমরা বিশ্বমানের সেবা দিতে পারবো বলে আশাবাদী। সার্জারি প্রাকটিসের ওপর নির্ভর করে। বিদেশে একজন সার্জন হয়তো তার জীবদ্দশায় ৫-৭ হাজার সার্জারি করেছেন। অথচ আমাদের সিনিয়র নিউরো সার্জনরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার সার্জারি করেন। আমরা হয়তো প্রযুক্তির দিকে কিছুটা পিছিয়ে কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা এগিয়ে। প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও দিনকে দিন কমে আসছে।

তিনি আরও বলেন, সার্জারিতে আমাদের এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগেছে। এর ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই রোগীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। ৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় শুরু করেছি দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে শেষ হয়েছে। ১টার দিকে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে।

চিকিৎসক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান-সংগৃহীত ছবি
চিকিৎসক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান-সংগৃহীত ছবি

সার্জারির আগেই তার ব্রেনের একটা অংশ ড্যামেজ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ফলে তার শরীরের একটা অংশ প্যারালাইজড, তার কথা অস্পষ্ট। এই সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠবে। সময়ের ব্যবধানে তা উন্নতির দিকে যাবে, কিন্তু সময়টা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না। এক থেকে দুই বছরও লাগতে পারে। ভালো ফিজিওথেরাপি দিলে পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থেকেই যায়। আলহামদুলিল্লাহ, সে বেঁচে যাবে কিন্তু কিছু সমস্যা থাকতে পারে। নিয়মিত ফলোআপে থাকলে অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে বলে আশা করি।

ডা. মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের নিউরো সার্জনরা এ ধরনের সার্জারি করতে সক্ষম। তাই বিদেশমুখী না হয়ে দেশের চিকিৎসকদের ওপর আস্থা রাখা উচিত। আমরা বিশ্বমানের সেবা দিতে পারবো বলে আশাবাদী। সার্জারি প্র্যাকটিসের ওপর নির্ভর করে। বিদেশে একজন সার্জন হয়তো তার জীবদ্দশায় ৫-৭ হাজার সার্জারি করেছেন। অথচ আমাদের সিনিয়র নিউরো সার্জনরা ৩০ থেকে ৪০ হাজার সার্জারি করেন। আমরা হয়তো প্রযুক্তির দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে কিন্তু অভিজ্ঞতায় এগিয়ে। প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও দিনকে দিন কমে আসছে।

এএএম/এসএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।