বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ফাইল ছবি

দেশের পূর্বাঞ্চলের চার জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজের বসতভিটায় ফেরা শুরু করেছে মানুষ। যদিও কয়েকটি উপজেলার মানুষ এখনো পানিবন্দি। পানি নামা শুরু হলেও দ্রুত কমছে না। এই ধীরগতির কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বন্যা।

ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলের স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যার পানি নামায় ধীরগতি নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, উজানে বৃষ্টি কমলেও কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতি ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে। পানি নামছে খুবই ধীরগতিতে।

আমরা এরই মধ্যে খাল সংলগ্ন বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি। বিভিন্ন বাজারের বর্জ্য খালে গিয়ে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি লোকেশন দিয়ে অভিযোগ করে আমরা ব্যবস্থা নেবো।- নোয়াখালী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল

কারণ হিসেবে তারা বলছেন, অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নদী-খাল দখল প্রধান কারণ। এছাড়া খালের ওপর দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ, কালভার্ট, ময়লার ভাগাড়, বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়িঘর নির্মাণ বন্যার পানি না নামার জন্য দায়ী।

পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বন্যার পানি নামছে না

চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে পানি খুবই ধীরগতিতে নামছে। সিলেটে হাওর-বিল থাকায় সেখানে আকস্মিক বন্যার পানি দ্রুত নামে। কিন্তু নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন স্লুইস গেট, কালভার্ট, বাঁধ তৈরি করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এখানে এলজিইডি যেভাবে মন চেয়েছে নদীর প্রবাহ ঠিক না রেখে খালের মধ্যেই বাঁধ বা রাস্তা তৈরি করেছে।’

বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

‘কিশোরগঞ্জ হাওরের মধ্যে রাস্তার কারণে বন্যার তীব্রতা বেড়ে গেছে। পানি হাওর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে না। এভাবে লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী ও কুমিল্লার অনেক খালের ওপর দোকান, ভরাট করে মার্কেট তৈরি, কচুরিপানা আর ময়লার স্তূপে পানিপ্রবাহ বন্ধ। ফলে বন্যার পানি নামছে না। এতে নিম্নাঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি, রাজনৈতিকভাবেও খাল-নদী দখল হয়েছে। এ অঞ্চলে ডাকাতিয়া ও মেঘনাসহ ছোট নদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত শাখা-প্রশাখা নদী-খালগুলো অকেজো হয়ে আছে। নোয়াখালীর রহমত খালী খালের বিভিন্ন জায়গায় দখল রয়েছে। ফলে পানি দ্রুতগতিতে নামছে না।- রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ

তিনি বলেন, ‘সামনে শুকনো মৌসুম আসছে। আমাদের এখনই বের করতে হবে কোথায় খালের পানি, নদীর পানি বাধাগ্রস্ত হয়। এখন ম্যাপিং করতে হবে। এগুলো চিহ্নিত করে বাধা দূর করতে হবে। এতে স্থানীয় মানুষের অবশ্যই পরামর্শ নিতে হবে। তাহলে পরবর্তী বন্যা জলাবদ্ধতায় আমরা এর সুফল পাবো। আমাদের স্থানীয় সরকার খুব বেশি পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের পরামর্শ নেয় না। ফলে আমরা উন্নয়ন করে সুফল পাচ্ছি না।’

জানা যায়, গত তিনদিন বৃষ্টি না হলেও কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানি ধীরগতিতে নামছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দি। ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও জেলার দুটি উপজেলায় এখনো পানি আছে।

বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

ফেনী

জাগো নিউজের ফেনী প্রতিনিধি জানান, দাগনভূঁইয়া উপজেলার সিন্দুরপুর, রাজাপুর, পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়নে এখনো হাঁটুপানি। এছাড়া সোনাগাজীর ৯টি ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গা এখনো পানিবন্দি। সদর পৌরসভার কিছু জায়গা ছাড়া এখনো ফরহাদনগর, লেমুয়াসহ নিম্নাঞ্চলে পানি রয়েছে। তবে ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজীর পানি পুরোপুরি নিষ্কাশন হয়েছে।

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে ধীরগতিতে পানি নামার ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি যুক্ত হচ্ছে। বৃষ্টি একদম কমে গেলে দ্রুত উন্নতি হবে আশা করি।- বন্যা পূর্ভাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান

কুমিল্লা

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ১১ ইউনিয়ন, চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১৩ ইউনিয়নে এখনো পানি রয়েছে। এছাড়া ব্রাহ্মণপাড়া ও বুড়িচংয়ের বিভিন্ন ইউনিয়নে পানি জমার খবর পাওয়া গেছে। কিছু জায়গায় পানি নিষ্কাশন হলেও রাস্তাঘাট এখনো চলাচলের উপযোগী নয়। কুমিল্লায় গোমতী এবং মেঘনার সঙ্গে শাখা-প্রশাখা খালগুলো অধিকাংশই দখলে। বিভিন্ন খালের মাঝখানে বাঁধ দিয়েছে প্রভাবশালীরা। ফলে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

নোয়াখালী

একই অবস্থা নোয়াখালীর। সেখানে চাটখিল উপজেলার চারটি ইউনিয়ন, সোনাইমুড়ী উপজেলার দুটি ইউনিয়ন ও সেনবাগের পাঁচটি ইউনিয়নসহ বেগমগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো পানিবন্দি।

বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

‘পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিচ্ছে না’

নোয়াখালীর ইয়ুথ হোপ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মানুষ পানিবন্দি। বৃষ্টি নেই, তবুও পানি কমছে না। এদিকের সব খালে স্থাপনা রয়েছে, প্রশাসনের চোখের সামনেই খাল দখল হচ্ছে। সাবেক রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মাছের প্রজেক্ট করে খালে বাঁধ দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে আমাদের করুণ পরিণতি। কেউ বাড়িতে পানিবন্দি, কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে কষ্ট ভোগ করছে।’

‘লোকেশন দিয়ে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেবো’

নোয়াখালী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘নোয়াখালীতে অনেক খাল রয়েছে। পানি নামার প্রবাহে ধীরগতি। আমরা এরই মধ্যে খাল সংলগ্ন বিভিন্ন স্থাপনা ভেঙে দিয়েছি। বিভিন্ন বাজারের বর্জ্য খালে গিয়ে ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি লোকেশন দিয়ে অভিযোগ করে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

লক্ষ্মীপুর সদর থানা, কমলনগর, রায়পুর, রামগতি ও চন্দ্রগঞ্জ উপজেলায় কোথাও কোমর সমান, কোথাও হাঁটু সমান বন্যার পানি জমা হয়ে আছে।

বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

লক্ষ্মীপুর পশ্চিম জামিরতলি এলাকার রোকসানা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হানিত (পানিতে) কষ্ট করে চলি। ঘর-দুয়ার সব ভাঙি গেছে বন্যায়। কোনো রকম জীবন বাঁচছে। হুতজি (ছেলেমেয়ে) লই অনেক কষ্টে আছি। বাবা সাতদিন ধরে পানিতে ডুবে আছি। বউ (পুত্রবধূ) হোলাহাইনরে (সন্তান) দূরে রাখছি। সাতদিন ধরে হানিতে (পানিতে) খুব কষ্ট। হানি কমবে কবে?’

‘এলজিইডির অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণে খালের পানিপ্রবাহ ঠিক নেই’

লক্ষ্মীপুর জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ-জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেনী ও নোয়াখালী সদর, চাটখিল, বেগমগঞ্জ উপজেলার পানি লক্ষ্মীপুর দিয়ে যাচ্ছে। এই জেলা নিচু হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বেশি। লক্ষ্মীপুরে গত ৩০ বছরে এমন বন্যা হয়নি। এ অঞ্চলে ভুলুয়া নদী, ডাকাতিয়ার পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে সেটি লক্ষ্মীপুর দিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, তবে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মাছের ঘের, খাল দখল, এলজিইডির অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণে খালের পানিপ্রবাহ ঠিক নেই। না হলে পানি আরও আগেই নেমে নদীতে চলে যেত। আমরা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছি। এক্ষেত্রে সরকারের অন্য মন্ত্রণালয় ও সাধারণ মানুষের সহায়তা চাচ্ছি। একই সঙ্গে মানুষকে নদী-খাল দূষণের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।’

খাল-বিল অকেজো হওয়ায় পানি দ্রুত নামছে না

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে একটা সময় প্রচুর সংখ্যক খাল ছিল। প্রতিটি মেইন রোডের পাশে সিঅ্যান্ডবি খাল ছিল। এখন সেগুলো নেই। গত ১৫ বছরে প্রশাসন খাল-বিলের উন্নয়ন করেনি। খাল দখল করে দোকান, মার্কেট, বাড়িঘর অপরিকল্পিত ব্রিজ- সব হয়েছে।’

বন্যার পানি নামায় কেন ধীরগতি?

‘প্রভাবশালীদের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি, রাজনৈতিকভাবেও খাল-নদী দখল হয়েছে। এ অঞ্চলে ডাকাতিয়া ও মেঘনাসহ ছোট নদীগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত শাখা-প্রশাখা নদী-খালগুলো অকেজো হয়ে আছে। নোয়াখালীর রহমত খালী খালের বিভিন্ন জায়গায় দখল রয়েছে। ফলে পানি দ্রুতগতিতে নামছে না। মানুষ কষ্ট ভোগ করছে।’

‘বন্যার পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি যুক্ত হয়ে উচ্চতা বাড়ছে’

তবে আকস্মিক এ বন্যার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ ও ভারী বর্ষণ বন্যা দীর্ঘায়িতকরণে প্রভাব রাখছে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, ২০ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত পূর্ণিমার প্রভাব ছিল। ওই সময়ে সাগরে উচ্চ জোয়ারের কারণে পানি সাগরে প্রবেশ করতে সমস্যা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ভারী বৃষ্টি ছিল। নোয়াখালীতে গত ১৬ থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ৭৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বন্যার পানির সঙ্গে বৃষ্টির পানি যুক্ত হয়ে পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। তাই ওই অঞ্চলে বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।’

বন্যা পূর্ভাবাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে ধীরগতিতে পানি নামার ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অন্যদিকে বৃষ্টির পানি যুক্ত হচ্ছে। বৃষ্টি একদম কমে গেলে দ্রুত উন্নতি হবে আশা করি।’

আরএএস/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।