আন্দোলনে হাত-পা হারানো তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়

মফিজুল সাদিক
মফিজুল সাদিক মফিজুল সাদিক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:৩৯ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০২৪

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)। পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানের নিচতলায় ক্যাজুয়ালটি-২। এই ইউনিটে প্রবেশ করতেই দেখা গেলো, এক তরুণ বিছানায় শুয়ে চিৎকার করছে। তার আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। বৈমষ্যবিরোধী আন্দোলনে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় সে। পায়ের গোড়ালি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে গুলিতে। শরীরের অন্য স্থানের মাংস কেটে লাগানো হয়েছে ডান পায়ের গোড়ালিতে। কিন্ত সেখানে তৈরি হয়েছে ক্ষত। হাসপাতালের স্টাফরা যখন ক্ষতস্থান জীবাণুমুক্ত করছিলেন, তখনই চিৎকার করছিলেন এই তরুণ।

শুধু এই তরুণ নয়, এখানকার ৫৬টি বেডের সব কটিতেই ছাত্র আন্দোলনে গুরুতর আহতরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়ায় তাদের কারো পা কেটে ফেলা হয়েছে। কারো আবার পায়ে রড লাগানো হয়েছে। কারো গুলি লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে হাড়। এমনই একজন মোহাম্মদ জাকির শিকদার। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর সদরে।

নিটোরের-২ নং ওয়ার্ডের ‘জি ১৪’ বেডে শুয়ে চিন্তায় মগ্ন জাকির। সাত বছর আগে বাবা হারানো জাকিরের এবার হারিয়েছে ডান পা। জাকিরের মা ও দুই ভাইবোন নির্ভর করে তার উপার্জনের ওপর। গুলশান-১ নম্বরে একটি শোরুমে চাকরি করতেন তিনি। ১৮ জুলাই ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে বাড্ডা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। এরপর নিটোরে দুটি অপারেশন হয়। কিন্তু গুলিতে পায়ের রগ ছিড়ে যাওয়ায় পচন ধরে। পরে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়ে জাকিরের পা কেটে ফেলেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম জাকিরের চিন্তা, কীভাবে মা ও দুই ভাইবোনের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেবেন।

জাকির বলেন, আমার বাবা নেই। মা ও দুই ভাইবোন আমার ওপর নির্ভর করে। সংসার চলে না। আমার পা নাই। সব দিক থেকে খুব চিন্তায় আছি। ড. ইউনূস স্যারকে (অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা) বলবো, আমাদের একটা কাজের ব্যবস্থা করুন। যাতে আমার সংসারটা চলতে পারে।

আন্দোলনে হাত-পা হারানো তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়

হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডে কান্নাকাটি করছে মোহাম্মদ সিফাত (১৪)। পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাইস্কুলের ৮ম শ্রেণির এই ছাত্র ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৯টায় মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল পায়ে। প্রাথমিকভাবে মিরপুর আলোক হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে নিটোরে ভর্তি করা হয়। পুলিশের গুলিতে ডান পায়ের হাঁটুর হাড় ও মাংস উড়ে গেছে। পায়ের মধ্যে রড লাগিয়ে শরীরের অন্য স্থানের মাংস কেটে লাগানো হয়েছে। পুরো পায়ে রড দিয়ে টানা দেওয়া। প্রচণ্ড ব্যাথায় মাঝে মধ্যেই চিৎকার করছে সিফাত।

সিফাতের পাশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন মুন্না (১৯)। মোহাম্মদপুরে একটি হোটেলে চাকরি করতেন। তার আয় দিয়েই মূলত তাদের সংসার চলতো। তার ডান পায়ের হাড় পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত। এরই মধ্যে ৮টি অপারেশন হয়ে গেছে। তবুও ডান পা আগের অবস্থায় ফেরা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মুন্নার মতো অনেকে বৈমষ্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। তারা এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। নতুন সরকারের ঘোষণার পর বর্তমানে হাসপাতালের পক্ষ থেকে ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হলেও এতদিনে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেকের পরিবার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে যতদিন আছি ততদিন চিকিৎসা বিনামূল্যে পেলেও বাড়ি ফেরার পর দীর্ঘদিন ধরে চলা চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে জোগাড় করবো তা নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়।

বাবা হারা মেহেদী। বাবা মারা যাওয়ার পর চার বোন ও দুই ভাইয়ের সংসারের হাল ধরতে শরীয়তপুর থেকে গুলশান-১ নম্বর এলাকায় একটি ফুলের দোকানে কাজ নেন। কাজ শেষ করে রাত ৮টার পর মধ্য বাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন। পথে গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। পরে ঢাকা মেডিকেল হয়ে আনা হয় পঙ্গুতে।

আন্দোলনে হাত-পা হারানো তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়

এখন পর্যন্ত মেহেদীর ৭টি অপারেশন হয়েছে। আরও একাধিক অপারেশন লাগবে। এ পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া নিয়ে প্রায় লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। বর্তমানে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ওর পায়ের হাড় গুঁড়া হয়ে গেছে। নার্ভ (শিরা) ছিঁড়ে গেছে। সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে। তাই বাড়িতে ফেরার পর কীভাবে সেই টাকা জোগাড় করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন মেহেদী।

পরিবারের হাল ধরতে বরগুনার বেতাগী উপজেলা থেকে গত মাসে ঢাকায় আসেন ডিগ্রি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মামুন। কাজ নেন রেস্টুরেন্টে। ১২ দিন কাজের মাথায় গত ১৯ জুলাই রামপুরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন। সেদিন থেকেই ভর্তি নিটোর হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি-২ এর জি ১৩ বেডে।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়ে গেছে। বর্তমানে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও বাড়িতে ফিরে কী করবো, কী খাবো, কীভাবে সংসার চালাবো, তা নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়। বাবা বৃদ্ধ। তেমন কিছুই করে না। বড় ভাইয়ের মাথায় সমস্যা। আর আমি যে কবে সুস্থ হবো তার ঠিক নেই। আমাদের পরিবারটা ভেসে যাবে।

আন্দোলনে হাত-পা হারানো তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায়

বর্তমানে নিটোরে ১৪২ জন রোগী ভর্তি আছেন, যারা আন্দোলনে হতাহতের শিকার হয়েছেন। সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যে সব রোগী পা হারিয়েছে ভবিষ্যতে এসব রোগীর কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন হাসপাতালের পক্ষ থেকে করা হবে বলে জানায় নিটোর।

নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের সবার খরচ নিটোর বহন করছে। বর্তমানে মোট ১৪২ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, অপারেশন সব আমরা বিনামূল্যে দিচ্ছি। আন্দোলনে আহত রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড একটা ওয়ার্ড করা হয়েছে। যেসব রোগী হাত-পা হারিয়েছে তাদের কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হবে। আমাদের পক্ষে যা কিছু করা দরকার, সামর্থ্য অনুযায়ী করবো। কোনো কিছুর ত্রুটি রাখছি না।

আন্দোলনে হতাহত তরুণদের রাষ্ট্র স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, সদ্য বিদায়ী স্বৈরাচারের গুলিতে এসব তরুণ পঙ্গু হয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্রই তাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে। এ বিষয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাব তুলে ধরবো। যাতে এসব তরুণকে পুনর্বাসন করা হয়। আমি মনে করি, এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব তরুণকে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।

এমওএস/এমএইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।