৪০০ কোটির মালিক ‘পানি জাহাঙ্গীরের’ বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু দুদকের

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিয়ন) ৪০০ কোটি টাকার মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ‘৪০০’ কোটির মালিক বনে যাওয়ার গুরুতর অভিযোগ আনেন স্বয়ং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ক্ষমতায় থাকাকালে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বাসায় কাজ করে গেছে, পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না! কী বলবো, এটাই বাস্তব। আমি জানতে পেরে তার কার্ড সিজ করেছি, তাকে চাকরি থেকে বের করে দিয়েছি, যা করার আমি ব্যবস্থা নিয়েছি।’

দুদক সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী পরিচয় ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের পদ, চাকরি নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করেছেন জাহাঙ্গীর। বাগিয়েছেন নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদ, গড়েছেন কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। এবার দুর্নীতিবাজ ওই নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, নোয়াখালীর চাটখিল থানার নাহারখালী গ্রামে জাহাঙ্গীরের জন্ম। তার বাবার নাম মৃত রহমত উল্লাহ কেরানী। মায়ের নাম আজিজা বেগম। তার বর্তমান ঠিকানা ফ্ল্যাট নম্বর- ৪/এ, বাসা নম্বর-১৬, রোড নম্বর-১৫ (নতুন), (পুরাতন-২৮), ধানমন্ডি, ঢাকা।

জাহাঙ্গীর আলমের গ্রামের লোকজন ও স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, তিনি অর্থবিত্তের মালিক হতে শুরু করেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। (সাবেক) প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর পরিচয় ব্যবহার করে তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, বদলিসহ নানান তদবির করতেন।নোয়াখালীর রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, প্রশাসনে তদবিরসহ নানান কাজ করতেন। জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি নোয়াখালী-১ আসন (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন, তার নিজের নামে প্রায় ২১ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার স্ত্রী কামরুন নাহারের নামে রয়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার সম্পদ। জাহাঙ্গীর নিজের নামে সাড়ে চার একরের বেশি কৃষিজমি, ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার অকৃষিজমি, মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে ৭ তলা ভবন, গ্রামের বাড়িতে একতলা ভবন ও মিরপুরে দুটি ফ্ল্যাট দেখিয়েছেন (যার দাম ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা)।

চাটখিলে পৈতৃক ভিটায় করেছেন চারতলা বাড়ি। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, দাম ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা। জাহাঙ্গীর পরিবারের একটি আটতলা বাড়ি রয়েছে নোয়াখালী শহর মাইজদীর হরিনারায়ণপুর এলাকায়। বাড়িটিতে ১৯টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৮টি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তিনতলার একটি ফ্ল্যাট ব্যবহার করে জাহাঙ্গীরের পরিবার। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ টাকা ও ব্যাংকে মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা, এবং স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবের স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

এছাড়া স্ত্রীর নামে একটি গাড়ি আছে, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অংশীদারি ফার্মে তার মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা।

এছাড়া তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, মো. জাহাঙ্গীর আলম এ কে রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানিরও মালিক। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের একজন উপপরিচালক। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য পাঠাতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নির্দেশনায় আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে কোনো হিসাব থাকলে সেসব হিসাবের লেনদেন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩(১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা নির্দেশনা দেওয়া হলো।

সূত্র জানায়, চলতি বছর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ দুর্নীতিবাজদের তথ্য একের পর এক ফাঁস হওয়ায় নিজেকে নিরাপদ রাখতে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন জাহাঙ্গীর। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশটির ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থান করছেন তিনি।

এসএম/এমএএইচ/এমএস