‘কোনো রাজনৈতিক দলের ৫ বছরের বেশি জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব না’
‘বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে পাঁচ বছরের বেশি জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব না। শেখ হাসিনার সব থেকে বড় ভুল ছিল দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। তিনি যদি ক্ষমতা ধরে না রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেন তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগের এমন অবস্থা হতো না।’
সোমবার (১২ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে ‘ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব এবং অভ্যুত্থানের স্পিরিট রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক সংস্কার সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এ সংলাপের আয়োজন করে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম সংলাপ সঞ্চালনা করেন।
সংলাপে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান বলেন, আমরা যখন রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাচ্ছি, সেখানে আমাদের কথারও সংস্কার করতে হবে। আমরা আসলে কী বলতে চাচ্ছি সে কথারও সংস্কার করতে হবে। সংখ্যালঘুদের প্রতি আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। আমরা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারি এবং ন্যায়ের কথা বলতে পারি তাহলে সংস্কার সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে আমাদের যেমন আশা আছে, তেমনি শঙ্কাও আছে। তারা যে সংস্কারের কথা বলছে তাতে রাষ্ট্র মেরামত হতে অনেক সময় লেগে যাবে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমাদের সমাজে দখলদারত্ব শুরু হয়ে গেছে। যেটা আমাদের সাংবাদিক সমাজেও দেখা যাচ্ছে। আমাদের সামনের দিন অনেক কঠিন। বাংলাদেশের রাষ্ট্র শুধু পাঁচ শতাংশ মানুষের। বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ প্রতিনিয়ত মৌলিক অধিকারের জন্য লড়াই করে গেছে। তাই রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে এই ৯৫ শতাংশ মানুষের কথা মাথায় রেখে সংস্কার করতে হবে। সরকার যদি পুলিশ-র্যাব নিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়, আর সেখানে জনগণ যদি গণরোষের নামে পুলিশের ওপর হামলা চালায়, এমন মানসিকতা থাকলে এই রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব না। কোনো রাষ্ট্রে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে সেখানে সংস্কার হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ২০২৪ এ আমাদের যে অভ্যুত্থান হয়েছে তা ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিকদের সমন্বয়ে সর্বজনীন অভ্যুত্থান। এর মধ্যদিয়ে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণে প্রথম এ দেশের কোনো সরকারকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। তবে এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে তাদের সমালোচনা করতে হবে, তাদের চোখে চোখে রাখতে হবে, যেন কেউ এ দেশে আর স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। আমাদের কিন্তু ৭১ সালের পর দেশ বেহাত হয়ে গেছে, ৭৫ এর পরে দেশ বেহাত হয়ে গেছে, ৯০ এর পর বেহাত হয়ে গেছে। কিন্তু ২৪ সালে এসে সে অর্জন আমরা বেহাত হতে দিতে পারি না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো। বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল হয়ে এখন পর্যন্ত এই কাঠামো আমাদের এখানে বড় হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনা কিন্তু তার এই আমলাতান্ত্রিক কাঠামোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর কেউ যেন তা করতে না পাতে সেজন্য আমাদের এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, আমরা যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছি, তা কিন্তু আমাদের সংবিধান পুরোপুরি পালটে ফেলার জন্য নয়। আমরা রাষ্ট্রের কিছু কাঠামোর পরিবর্তনের কথা বলছি। যদিও আমাদের এখন যে সংবিধান আছে তা সঠিক হলেও বর্তমান সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে এই সংবিধান কাজ করছে না। নতুন সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা বর্তমান সংবিধানে ছিল সেটাকে নিয়ে আমরা নতুন আরও কিছু যোগ করে গণবান্ধব সংবিধান তৈরি করতে পারি। যেখানে নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
সংলাপে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ২৪ এর এই গণঅভ্যুত্থান বিপ্লবে পরিণত হয়নি। এটাকে বিপ্লবে পরিণত করতে হবে যেন শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচার আমাদের সমাজে আর তৈরি হতে না পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটু বেশি তাত্ত্বিক হয়ে গেছে। তাদের প্রথম যে দায়িত্ব পালন করা দরকার তা হচ্ছে বাজারে সুফল দেওয়া। মানুষ যদি এই অন্তর্বর্তী সরকারের সুফল না পায় তাহলে জনগণই এই সরকারের পেছনে পড়বে। পাশাপাশি এই অভ্যুত্থানের ছাত্রদের খুন করেছে যারা, সেই দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা ও দুর্নীতিবাজ এবং অর্থপাচারকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সরকার কোথায় ভুল করছে তা দেখার জন্য একটি ছায়া সরকার গঠন করতে হবে।
এমওএস/ইএ/জেআইএম