ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
তৌহিদুজ্জামান তন্ময় তৌহিদুজ্জামান তন্ময় , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, ১১ আগস্ট ২০২৪
অধিকাংশ থানার সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে/জাগো নিউজ

কাটতে শুরু করেছে আতঙ্ক
মামলা ও গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে ছাই
লুট হয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদ
ঢাকায় ৪৫ থানার কার্যক্রম শুরু
সারাদেশে ৬৩৯ থানার মধ্যে ৫৩৮ থানার কার্যক্রম শুরু

মোহাম্মদপুর থানা চারতলা বিশিষ্ট। ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে সহিংসতায় পুড়েছে থানাটির বেশিরভাগ কক্ষ। থানা চত্বরে থাকা গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাগজপত্র, নথি, চেয়ার-টেবিল সব পুড়ে ভস্মীভূত। নেই কোনো অস্ত্রও। বলা যায় পুরো ভবনটি কঙ্কালসার।

শুধু মোহাম্মদ থানা নয়, ঢাকার বেশ কয়েকটি থানা ভবনের চিত্র একই। গত কয়েক দিনের সহিংসতায় দুর্বৃত্তরা থানায় হামলার পর নিহত হন অনেক পুলিশ সদস্য। তবে কমিটি করলেও নিহত পুলিশ সদস্যদের সঠিক সংখ্যা এখনো জানে না পুলিশ সদর দপ্তর। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো এখনো কার্যক্রম শুরুর উপযোগী হয়নি। যেগুলোতে শুরু হয়েছে সেগুলোতে চলছে সীমিত কার্যক্রম।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও প্রাণহানি হয়। শেষ তিন দিন (শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে-পরে) থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে সাহস পাননি। স্থাপনা পাহারা দেওয়ার জন্য আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।

পুলিশের নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম গত ৭ আগস্ট পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরদিন তিনি পুলিশ সদস্যদের কর্মস্থলে যোগদানের ক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

শনিবার (১০ আগস্ট) সরেজমিনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানার মধ্যে ২৯টি থানায় কার্যক্রম শুরুর তথ্য পাওয়া যায়। বাকি ২১টির কার্যক্রম এখনো শুরু করা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত এসব থানায় বসার মতো অবস্থা নেই বলে জানায় পুলিশ সূত্র।

প্রাথমিকভাবে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। তবে মামলা নেওয়ার মতো এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। থানায় হামলা ও ভাঙচুরের পর দুর্বৃত্তরা থানা থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। তবে কতটি অস্ত্র লুট হয়েছে সেটি জানা যায়নি।- আদাবর থানার ওসি মাহবুবুর রহমান

রাজধানীর আদাবর থানায় সরেজমিনে দেখা যায়, থানার বাইরে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা দিচ্ছে। থানার ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে গেলে সেনাবাহিনী তার পরিচয় জানতে চাচ্ছে। দুপুর ১টার দিকে থানার ওসিসহ ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য মিটিং করেন। তবে থানার চেয়ার-টেবিল পুড়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়েই মিটিং সারতে হয়। এরপর ৭-৮ জন শিক্ষার্থী থানায় প্রবেশ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন।

আরও পড়ুন

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার প্রতিটি কক্ষে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেই চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। থানার ভেতরে সবগুলো গাড়ি ভাঙচুর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

মোহাম্মদপুর থানায় সরেজমিনে দেখা যায়, থানার গেটে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চেয়ার-টেবিল নিয়ে পুলিশ সদস্যদের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল, সিমকার্ড, ব্যাজ, ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধারের তালিকা করছেন। থানা ভবনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী থানার প্রতিটি রুমে পুড়ে যাওয়া কাগজপত্র গুছিয়ে পরিষ্কার করছে।

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপক চন্দ্র সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা থানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। আমাদের থানার কোনো রুম এখনো ঠিকঠাক হয়নি। চেয়ার-টেবিলও নেই যে বসে কাজ করবো। তবে ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক হবে।’

থানা থেকে কতগুলো অস্ত্র লুট হয়েছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এখনো লুট হওয়া অস্ত্রের তালিকা করা হয়নি। তালিকা করে পরে জানানো হবে।’

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ সদস্য জানান, মোহাম্মদপুর থানায় ৫ আগস্ট হামলা করে সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার গেট এখনো বন্ধ। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। তবে গেটে কোনো পুলিশ সদস্যদকে দেখা যায়নি।

রমনা থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানায় কোনো হামলা কিংবা ভাঙচুর করা হয়নি। তবে গেট বন্ধ এবং কোনো পুলিশ সদস্য নেই।

তেজগাঁও বিভাগের সবগুলো থানা (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল) চালু হয়েছে। তবে সব থানায় এখনই জিডি-মামলা করা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তেজগাঁও, হাতিরঝিল ও শেরেবাংলা নগর থানায় মামলার এজাহার দায়ের করা যাচ্ছে।- তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক

৫ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডা থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানাটিতে বসে কাজ করার মতো অবস্থা নেই। জানা যায়, সেনাসদস্যদের পাহারায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য থানায় এসেছেন। তবে এখনো জিডি কিংবা মামলার কার্যক্রম শুরু হয়নি।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাইনুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। দুটি মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। একটি পরিচয়পত্র হারানোর জিডি হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, শনিবার (১০ আগস্ট) বিকেল ৩টা পর্যন্ত সারাদেশের মোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৮৪টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৪৫৪টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ডিএমপি সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, শনিবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ৪৫ থানার কার্যক্রম চালু হয়েছে। হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ায় বাকি পাঁচটি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এসব থানা রোববার (১১ আগস্ট) চালু হতে পারে। এ পাঁচটি থানা হলো- খিলক্ষেত, উত্তরা পূর্ব, পল্টন, যাত্রাবাড়ী ও কদমতলী।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। তবে মামলা নেওয়ার মতো এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। থানায় হামলা ও ভাঙচুরের পর দুর্বৃত্তরা থানা থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। তবে কতটি অস্ত্র লুট হয়েছে সেটি জানা যায়নি।’

তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘তেজগাঁও বিভাগের সবগুলো থানা (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল) চালু হয়েছে। তবে সব থানায় এখনই জিডি-মামলা করা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তেজগাঁও, হাতিরঝিল ও শেরেবাংলা নগর থানায় মামলার এজাহার দায়ের করা যাচ্ছে।’

থানা-কারাগারের লুট হওয়া অস্ত্র সেনা ক্যাম্পে জমা দেওয়ার অনুরোধ
৯ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্ততে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ অতি দ্রুত নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

নৌবাহিনীর নিরাপত্তায় উপকূলীয় ২৯ থানার কার্যক্রম শুরু
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহায়তা ও নিরাপত্তায় উপকূলীয় অঞ্চলের ২৯ থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। থানাগুলো হলো- ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চরফ্যাশন, দক্ষিণ আইচা, দুলারহাট, শশীভূষণ, বরগুনা সদর, বামনা, বেতাগী, আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, মংলা, রাঙ্গাবালী, খুলনা সদর, খালিশপুর, হরিণটানা, লবণচরা, কয়রা, দিঘলিয়া, দাকোপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া।

ধ্বংসস্তূপ থানা, করা যাচ্ছে না জিডি-মামলা

বিজিবির নিরাপত্তায় সীমান্তবর্তী ২১ থানার কার্যক্রম শুরু
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রংপুর ও যশোর রিজিয়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১১টি থানা এবং খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১০টি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বিজিবির নিরাপত্তায় এরই মধ্যে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী দিনাজপুরের হাকিমপুর থানা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম থানা, ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর থানা, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া থানা, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি, রৌমারী, চর-রাজিবপুর, কচাকাটা ও ঢুষমারা থানাসহ ১১টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

অপরদিকে, খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, দেবহাটা ও কলারোয়া থানা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা ও জীবননগর থানা, মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর ও গাংনী থানা এবং কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানাসহ মোট ১০টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

টিটি/এএসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।