ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় বাথুয়া গ্রামে বইছে আনন্দের বন্যা
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় হাসিনা সরকারের। এরপর বৃহস্পতিবার গঠন করা হয় অন্তবর্তী সরকার। ১৭ সদস্যের সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার শিকারপুর ইউনিয়নে বাথুয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. ইউনূস এখন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। এই অর্থনীতিবিদ সরকারের প্রধান হওয়ায় নিজ জন্মভূমি এবং যেখান থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু, সেই জোবরা গ্রামেও সীমা নেই আনন্দের। সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, যোগ্য হিসেবেই দায়িত্ব পেয়েছেন ড. ইউনূস। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি তার হাত ধরে আবার ঘুরে দাঁড়াবে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন হবে বলেও আশা করছেন তারা।
ব্যবসায়ী পিতার ঘরে জন্ম নিলেও শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউনূসের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় পাশের জোবরা গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল তার সামাজিক ব্যবসা। তিনি ক্ষুদ্রঋণকে সামাজিক ব্যবসার মডেল হিসেবে তুলে ধরেন। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নে তার ক্ষুদ্রঋণের মডেল সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়। জোবরার তেভাগা সেচ ও খামার প্রকল্প থেকে পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। বিশেষায়িত এ ব্যাংকের মাধ্যমে সারাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বিপ্লব ঘটে। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পায়।
ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় নিজ গ্রামে আনন্দের বন্যা বইছে। গ্রামবাসী বলছেন, ড. ইউনূস নিজ যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতায় নোবেল জিতেছেন। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্ক ও মেধা কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারবেন তিনি।
- আরও পড়ুন
- উপদেষ্টাদের প্রথম সভায় যেসব সিদ্ধান্ত এলো
- অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টারা কে কোন দায়িত্ব পেলেন
বাতুয়া গ্রামের বাসিন্দা ৭০ বছর বয়সী আবুল হাসেম। তিনি বলেন, ড. ইউনূস মেধাবি ছিলেন। এ গ্রামেই তার জন্ম। তার বাবা হাজী মোহাম্মদ দুলামিয়া সওদাগর ব্যবসায়ী ছিলেন। নগরীর বক্সিরহাটে স্বর্ণের দোকান ছিল দুলামিয়া সওদাগরের।
বাথুয়া গ্রামে ড. ইউনূসের আত্মীয়-স্বজন, ছবি: জাগো নিউজ
আবুল হাসেম বলেন, ড. ইউনূস তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের পূর্ব বাতুয়া আলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম) লেখাপড়া করেন। পরে বাবা পরিবার নিয়ে শহরে চলে যান। তিনি যখন নোবেল পুরষ্কার পান তখন গ্রামে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। এখন সরকারের প্রধান হওয়ায় এই আনন্দ আরও বেড়ে গেছে। পাশাপাশি তার কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। আমরা আশা করছি তিনি দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হবেন।
ওই গ্রামের আরেক বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন। এখন দেশ আরও সমৃদ্ধ হবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। আশা করছি চট্টগ্রামেও আরও বেশি উন্নয়ন হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালে গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরে আসেন ড. ইউনূস। ভাই-বোনদের সবাই পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরসহ দেশে-বিদেশে বসবাস করেন। মাঝে-মধ্যে গ্রামে যান। নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে রয়েছে পারিবারিক যোগাযোগ।
শুক্রবার সকালে কথা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চাচী শামসুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, আগে প্রায় প্রতিবছর ঈদে গ্রামে বেড়াতে আসতেন। এখন ব্যস্ততার কারণে কম আসেন। গ্রামে এলে আমার বাসায় আসেন। তিনি সমুচা খুব পছন্দ করেন। আমার বাসায় এলে সমুচা আর চা খেতেন।
জোবড়া গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক
আরেক বাসিন্দা গোলাম সরওয়ার চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশের যে অবস্থা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ড. ইউনূস একজন সঠিক মানুষ হিসেবে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন। তিনি একজন যোগ্য মানুষ। মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই এই চিত্র পাল্টে দেবেন। আমাদের আশা, তিনি নিশ্চিতভাবে সফল হবেন।
চাচাতো বোন শাহীন হাসরিন (পপি) বলেন, ড. ইউনূস আমাদের এলাকার কৃতি সন্তান। আমরা তাকে নিয়ে অনেক গর্ব করি। ২০০৬ সালে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর আমাদের আশা ছিল তিনি দেশের জন্য আরও কিছু করবেন। আমাদের বিশ্বাস তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন। উনি সফল হবেন, এটা আমাদের বিশ্বাস।
আরেক চাচাতো ভাই শওকত ইকবাল বলেন, ছোটকাল থেকেই দেখেছি ড. ইউনূস অত্যন্ত মেধাবি, সহজ-সরলও। সহজে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন।
যে ক্ষুদ্রঋণ মডেল ড. ইউনূসকে নোবেল জিতিয়েছেন, সেই ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল হাটহাজারীর অন্যপ্রান্তের গ্রাম জোবরা থেকে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় জোবরা গ্রামের মানুষও খুশি। তেভাগা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিতে সমৃদ্ধ গ্রাম হিসেবে জোবরাকে গঠন করার ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের ভূমিকা ছিল অনন্য। ড. ইউনূসের সরকারপ্রধান হওয়ার খবরে জোবরা গ্রামেও বইছে আনন্দের বন্যা।
ড. ইউনূসের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়
জোবরা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের গৃহবধু সুফিয়াকেই প্রথম ঋণ দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। সুফিয়া বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। সুফিয়া বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বর্তমানে বেঁচে আছেন নুর নাহার বেগম। তিনি বলেন, ড. ইউনূস জোবরা গ্রামের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। তার কারণে জোবরা গ্রামকে সারাবিশ্ব চেনে। নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর তিনি আমাদের গ্রামে এসেছিলেন। আশা করছি এখন আমাদের গ্রামেরও আরও উন্নয়ন হবে।
সুফিয়ার নাতি মো. বাবুল বলেন, ড. ইউনূস আমার নানীকে দুঃসময়ে ঋণ দিয়েছিলেন। ওই ঋণে আমার নানীর পরিবারে স্বচ্ছলতা আসে। যখন গ্রামে এক টাকাও কারও কাছে মিলতো না, তিনি আমার নানীর সেই দুঃসময়ের বন্ধু। নোবেল জয়ের পর তিনি জোবরা এসেছিলেন। আমরা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। তখন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে আমাদের দুজনকে দুটো রিকশা উপহার দেওয়া হয়।
তফাজ্জল হোসেন বাবুর্চি। একসময় রিকশা চালাতেন। ভাড়া রিকশা চালিয়ে সংসারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতেন। জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় ড. ইউনূস প্রথমে পাঁচটি রিকশা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি দেওয়া হয় তফাজ্জলকে। তফাজ্জল তেভাগা সেচ ও খামার প্রকল্পেরও সদস্য। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, জোবরা গ্রামে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে আমাকে আড়াইশ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ওই ঋণ আমি শোধ করেছিলাম। পরের বার একটি রিকশা দিয়েছিলেন। ঋণ শোধ করে আমি ওই রিকশার মালিকও হয়েছিলাম। তিনি (ড. ইউনূস) আমাকে চিনবেন।
এমডিআইএইচ/এমএইচআর/জিকেএস