অন্তর্বর্তী সরকার
উপদেষ্টাদের প্রথম সভায় যেসব সিদ্ধান্ত এলো
ব্যবসায়ীদের উজ্জীবিত করা, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, বাজার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুক্রবার (৯ আগস্ট) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের প্রথম বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। এখনো রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই, শিক্ষার্থীরা রাস্তা ম্যানেজমেন্ট করছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি না যে কালই (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) খুলে দেবো। শিক্ষক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যারা দায়িত্ব নিয়েছি আমাদের সব মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত থাকবেন। কীভাবে তারা সম্পৃক্ত থাকবেন, এটার কাঠামো কী হবে, এটা আমরা পরবর্তীতে চিন্তা করবো।’
অন্তর্বর্তী সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, ‘সব সেক্টরের রিফর্ম (সংস্কার) নিয়ে আমরা কথা বলেছি। এভাবে চলে না, চলতে পারে না, সিস্টেমটা আমাদের বদলাতে হবে। সেই রিফর্মগুলো একা তো আর করা যাবে না। সমাজের সবার সঙ্গে কথা বলা হবে, সবার সঙ্গে কথা বলে রিফর্ম এজেন্ডা ঠিক করে আমরা আলাপ-আলোচনায় যাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠকে অর্থের বিষয়ে কথা হয়েছে। আর্থিক খাতগুলো শুধু চালু করলেই হবে না, সক্রিয় করতে হবে। সেখানে নেতৃত্বের স্থানে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন যেগুলোতে আছে, অনতিবিলম্বে সেসব পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
‘ব্যবসাকে উজ্জীবিত করার জন্য যত ধরনের সুরক্ষা নেওয়া যায়, সেটাকে আমাদের চিহ্নিত করে সেই সুরক্ষাগুলো আমাদের নিতে হবে। যে ব্যবসায়ীরা হতোদ্যম হয়ে গেছেন তাদের যাতে আবার উজ্জীবিত করা যায়।’
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘জনগণের জীবন-জীবিকার কষ্ট লাঘব হবে, বাজারের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণ, অর্থের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণ, সেটাও অগ্রাধিকার পাবে অর্থ মন্ত্রণালয় যখন পরিকল্পনা করবে সেখানে।’
বিস্তারিত কর্ম পরিকল্পনার জন্য একটু সময় লাগবে। আজই তা হয়ে যাবে না বলেও জানান রিজওয়ানা হাসান।
এ সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে বৈঠকে সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়াদের বিষয়ে এখন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। আপনি কী রিফর্ম চান সেটা না বুঝে তো আমি মেয়াদের কথা বলতে পারবো না। রিফর্ম যদি আপনারা না চান তাহলে আরেক কথা। কাজেই এখন মেয়াদ মেয়াদ করে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা সবাই যাতে দেশে একটা গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করতে পারি, সেটার প্রস্তুতির জন্যই তো এই অন্তর্বর্তী সরকার। সে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যেটুকু সময় দরকার শুধু সেটুকু সময়ই আমরা নেবো। শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের দিকেই আমাদের যাত্রা করতে হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় তো প্রধান উপদেষ্টার অধীনে। তিনি কি বৈঠকে বলেছেন এইচএসসি পরীক্ষা কবে নাগাদ শুরু হতে পারে- জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, ‘তিনি এটা বলতে পারেননি। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলার একটা সম্পর্ক রয়েছে। ওইটাকে অ্যাড্রেস করার সঙ্গে সঙ্গে এটাও অ্যাড্রেস হবে।’
বৈঠকে অর্থপাচার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের যিনি দায়িত্বে রয়েছেন তিনি বলেছেন, যত রকমের ইভিল প্র্যাকটিস আছে, সেগুলোকে যদি অ্যাড্রেস করতে হয়- অনেক জায়গায় পদ শূন্য হয়ে আছে। সঠিক লোক দিয়ে সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে একটি দুর্নীতি বা একটি ব্যাড প্রাকটিস নিয়ে আজ আলোচনা হয়নি।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে র্যাব এবং পুলিশের প্রতিনিধিরা বসবেন। সেখানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলেও জানান এ উপদেষ্টা।
আপনারা দীর্ঘদিন ধরে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। আইনটি বাতিল করবেন কি না- এ প্রশ্নে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা বলেন, ‘কতগুলো ক্ষমতা একটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পড়লে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সরকার যখন অগণতান্ত্রিক হয়ে পড়ে তখন এটার অপপ্রয়োগ হয়। কোন বিধানগুলো অপপ্রয়োগ করা যাচ্ছে, সেটা চিহ্নিত করে বাতিলের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন
বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির কথা শোনা যাচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার ব্যাপারে কথা হয়েছে। এখানে আইজিপিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার কাছে কী তথ্য আছে? ওনার কাছে যে তথ্য আছে, সেটা আবার যা প্রচার হচ্ছে সবসময় তা মিলছে না। উনাদের অনেকগুলো থানাও তো ফাংশনাল না। তাই ওনার কাছে সব তথ্য থাকবে, সেটাও আমরা ধরে নিতে পারি না। কথা হয়েছে, যত দ্রুত পুলিশ যাতে (কাজে) নেমে যায়। আমরা সবাই যেন পুলিশকে সাহায্য করি।’
চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের কথা বলা হয়েছিল। সে বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে- এ বিষয়ে এ উপদেষ্টা বলেন, ‘আজ এ বিষয়ে কোনো কথা হয়নি।’
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হবে কি না- জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সিস্টেম পরিবর্তনের জন্যই তো শিক্ষার্থীরা লড়াই করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনে গণহত্যার বিচারের ব্যাপারে বলা হয়েছে। কীভাবে বিচারটা নিশ্চিত করলে এটা স্বচ্ছ হবে এবং এ ঘটনা জীবনে কোনোদিন পুনরাবৃত্তি হবে না। সেটার জন্য কোন পথে আমরা যাবো, সে পথগুলো কী সেটা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। এটার একটা উত্তর আপনারা সহসাই পেয়ে যাবেন। আমরা ওইটা নিশ্চিত করবো যে, প্রত্যেকটা গুলির (ঘটনার) আমরা বিচার চাইবো। এটা যাতে আর না হয়। রিফর্মের জন্য ওই রকমই একটা স্বচ্ছ অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে রংপুর যাবেন আগামীকাল। সঙ্গে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টাও যাবেন।’
‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটা বুঝতে হবে যে আজই সমস্যার সমাধান হবে না, কিন্তু সমস্যার সমাধান যত দ্রুত করা যায় সে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে পরবর্তীতে আইজিপি এসেও যোগ দিয়েছেন।’
কিছু কিছু জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে আপাতত একটা রক্ষা বলায় সৃষ্টির চেষ্টা করা হবে। এটা নিয়েও আজ আমাদের আইজিপির সঙ্গে কথা হয়েছে।’
উচ্চ আদালতে বিচারকাজ চালু করতে আইন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘আইন উপদেষ্টা সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে কত দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা যায় সে ব্যবস্থা নেবেন।’
‘যত শিক্ষার্থী এ আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, সবার পরিবারকে ডেকে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা যমুনাতে একদিন বসবেন। তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার সুব্যবস্থা করারও একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
যারা আন্দোলন করেছে তাদের বিরুদ্ধে অনেক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা বলেন, ‘এর আগেও অনেক রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। হয়রানিমূলক সেসব মামলা কী করে বন্ধ করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু আইন আছে যেগুলোর আপনারাও (সাংবাদিক) ভুক্তভোগী। যেমন- আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, এখন আবার সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল হলেও ওগুলোর অধীনে অনেকের শাস্তি হয়েছে, অনেকে জেলে আছেন, অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। হয়রানিমূলক মামলার মধ্যে এসব মামলা আনা হবে। আইনগুলো যাতে আর স্বাধীন মতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে না পারে, যাতে বিরোধী মত দমনে ব্যবহৃত হতে না পারে- সেটা নিয়েও পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনা হবে।’
আরএমএম/কেএসআর/এএসএম