কোটা আন্দোলন
শরীরে গুলির ক্ষত, জীবনে অনিশ্চয়তা
কারও পেটে গুলি, কারও পিঠে। কারও গুলি পায়ে। কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও দুটি। কেউ কেউ ভর্তি অনেকগুলো ছররা গুলির ক্ষত নিয়ে। গুলিতে কারও হাড় ভেঙে চুরমার, কেউ দেখছে না চোখে।
চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সংঘর্ষের আটদিন পর শুক্রবার (২৬ জুলাই) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের চিত্র এটি। ওয়ার্ডগুলো ভারী হয়ে উঠেছে আহতদের কান্নায়। ভবিষ্যৎ জীবন ঘিরে অনিশ্চয়তা।
গুলিতে ডান পায়ের দুটো হাড় ভেঙে চুরমার নগরের ইসলামীয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইয়াসের। শুক্রবার (২৬ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কান্না জড়ানো কণ্ঠে পাশে দাঁড়ানো বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, আব্বা আমি কি আর হাঁটতে পারবো না?
ডাক্তার ভালোমন্দ কিছু বলেনি। মনে হচ্ছে উনি পঙ্গু হয়ে গেছেন। আমার এক বছরের একটা সন্তান আছে। সামনের জীবন কীভাবে চলবে বুঝতে পারছি না।–আহত হকারের স্ত্রী হাফসা
ইয়াস জাগো নিউজকে বলেন, ‘চান্দগাঁও থানা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হই। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি পা নাড়াতে পারছি না।’
একই ঘটনায় পা, বুক ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বহদ্দারহাট এলাকার হকার মো. আবুল বাসার (২৮)। তার পায়ের হাড়ও গুলিতে গুঁড়ো হয়ে গেছে। তিনিও হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে ভর্তি। পাশে বসে ছিলেন স্ত্রী হাফসা বেগম।
আরও পড়ুন
- মেট্রোরেলে তাণ্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত, ক্ষতি পৌনে ৪০০ কোটি
- কোটা আন্দোলনের ব্যানারে তাণ্ডব চালায় ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা
- ডিএনসিসির ১০ আঞ্চলিক কার্যালয়ের ৬টিতেই ভাঙচুর-আগুন
- জীবন বাঁচাতে ৯৯৯-এ ফোন দেন পুলিশ সদস্যরাও
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে আম কিনে তা ভ্যানে করে বিক্রি করতো আমার স্বামী। ঘটনার দিন সংঘর্ষ শুরু হলে দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে গুলিবিদ্ধ হন।’
‘ডাক্তার ভালোমন্দ কিছু বলেনি। মনে হচ্ছে উনি পঙ্গু হয়ে গেছেন। আমার এক বছরের একটা সন্তান আছে। সামনের জীবন কীভাবে চলবে বুঝতে পারছি না।’- যোগ করেন হাফসা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ ও ১৮ জুলাই চট্টগ্রামে দুদিনের সংঘর্ষে প্রায় আড়াইশ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছেন সরকারি এ হাসপাতালে। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন অন্তত ৪০ জন। ১৮ জুলাই একদিনেই চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ৭৬ জনকে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয় ৩০ জনকে। আহতদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ, ১০ পথচারী ছাড়া বাকিরা ছিলেন শিক্ষার্থী।
অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সৌমেন জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলনে ঘিরে সংঘর্ষে আহত অন্তত ৩০ জনকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধসহ গুরুতর ইনজুরি হওয়ায় প্রায় সবারই ছোট-বড় অপারেশনের প্রয়োজন হয়েছে।
প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি একেবারেই অহিংস ছিল। পরে একটি গোষ্ঠীর তৎপরতায় আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। সে সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।- চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম
চোখে আঘাত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এদের মধ্য একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তিনি এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ছররা গুলিতে তার চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
কক্সবাজার সরকারি কলেজের ওই শিক্ষার্থী হলেন আমিরুল ইসলাম আরিফ (২২)। তিনি বলেন, ‘ডান চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। একবার অপারেশন হয়েছে, আরও অপারেশনের প্রয়োজন হবে।’
বহদ্দারহাটের সংঘর্ষে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর সুজন (১৪)। সে জানায়, ১৮ জুলাই দুপুরে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা থেকে ভাত খেতে বাসায় যাওয়ার সময় খাঁজা রোডের গলিতে গুলিবিদ্ধ হয়।
সুজনের মা নুর নাহার বলেন, ‘অভাবের তাড়নায় ছেলেকে কাজে দিয়েছিলাম। বাড়ি আসার সময় হাঁটুতে গুলি লেগেছে। আল্লাহকে বিচার দিলাম, আমার মাসুম শিশুকে যারা গুলি করছে তাদের বিচার আল্লাহ করবে।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার চাঁদপুরে আহত হন যুবক আবদুল মজিদ (২০)। তার শরীরের প্রায় ৭০ শতাংশ পুড়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য চাঁদপুর থেকে চমেকে নিয়ে আসেন স্বজনরা। তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
১৬ জুলাই নগরের ষোলশহরে গুলিবিদ্ধ হয় মো. আকাশ (১৭) নামে এক কিশোর। সে পেশায় একজন গ্যারেজকর্মী। ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. প্রান্ত বড়ুয়া বলেন, ‘আকাশের পেটে থাকা বুলেট অপারেশন করে অপসারণ করা হয়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
আকাশের বাবা মো. এনাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুপুরে ভাত খেয়ে বাসা থেকে গ্যারেজে যাওয়ার সময় ষোলশহরে গুলিবিদ্ধ হয় আকাশ। রাস্তা থেকে কারা যেন তুলে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। আমি ফোন পেয়ে হাসপাতালে আসি।’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংঘর্ষের ঘটনায় পাঁচজনকে নিহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, যার চারজন ছিলেন গুলিবিদ্ধ। পরে গুলিবিদ্ধ এক শিক্ষার্থীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।’
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি একেবারেই অহিংস ছিল। পরে একটি গোষ্ঠীর তৎপরতায় আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। আমাদের ৬৪ জন পুলিশ আহত হয়েছেন। থানা ও পুলিশ ফাঁড়িসহ অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী বাধ্য হয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।’
চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দুদিনের সংঘর্ষে নিহতরা হলেন- চট্টগ্রাম কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম (২২), এমইএস কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ (২০), সরকারি আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী তানভীর আহমেদ (১৮), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২২), বহদ্দারহাটের মুদি দোকানের কর্মী সায়মন (২২) ও মুরাদপুরের ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মোহাম্মদ ফারক (৩৪)।
এএজেড/এএসএ/এএসএম