কেটে গেছে ৫ বছর
শুরুই হয়নি ৩৪ বাফার গুদামের নির্মাণকাজ, ব্যয় ৩২২ কোটি
সঠিক সময়ে কোনো প্রকল্প শেষ না হলে ব্যয় বাড়ে। অপচয় হয় সরকারি অর্থের। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশনা থাকে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের। পাঁচ বছর আগে সার সংরক্ষণে ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। অথচ দীর্ঘ এ সময়ে নির্মাণকাজই শুরু হয়নি। এরই মধ্যে নানান খাতে ব্যয় হয়েছে ৩২২ কোটি টাকা।
‘সার সংরক্ষণ ও বিতরণের সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প নিয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকাশিত নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
আইএমইডির পরামর্শক্রমে একটি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা এবং মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, সার ব্যবসায়ী ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আইএমইডি।
প্রকল্পের দুর্বল দিক
আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুযায়ী যথাসময়ে অর্থ বরাদ্দ, ছাড় ও ব্যয় না হওয়া। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ততার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম জমি ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি। শিগগির জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ না হলে জমির দাম আরও বাড়বে। আশঙ্কা থাকবে প্রকল্প ব্যয়ের ওপর প্রভাব পড়ার। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শঙ্কা থাকছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
আপদকালীন ৮ লাখ মেট্রিক টন সারের মজুত নিশ্চিতকরণ ও দেশে সারের মজুত সুনিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ উদ্দেশ্যে বিসিআইসি প্রকল্পটি নেয়। প্রধান কাজ সারাদেশের সাত বিভাগের ৩৪ জেলায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ করা।
প্রকল্পের নির্মাণকাজ কেন শুরু হয়নি আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবো। সে বিষয়ে আমরাসহ বেশকিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ধীরগতি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে আমাদের সুপারিশ দেওয়া হবে।- আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন
ব্যয়
মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে জুন ২০২১ নাগাদ বাস্তবায়নের কথা ছিল। এর পরে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ জুন ২০২২ নাগাদ বাড়ানো হয়। ২০২৩ সালে নতুন করে জুন ২০২৫ নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয়। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৮২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা (সংশোধিত)। প্রকল্পটি দেশের ৩৪টি জেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। পাঁচ বছর কেটে গেলেও প্রকল্পের নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি।
আরও পড়ুন
- সার সংরক্ষণে চার জেলায় হচ্ছে বাফার গুদাম, ব্যয় ২৪৬ কোটি টাকা
- ৩ বছর পর চালু হলো ভৈরব বিএডিসি সার গুদাম
আইএমইডির পরামর্শ
আইএমইডি মনে করে, প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য ছাড় করা অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রকল্প দপ্তরের মাধ্যমে প্রতি অর্থবছরের শুরুতে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যে সব জেলার ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হয়নি, সে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বাড়িয়ে দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে হবে। প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য তদারকি জরুরি। প্রতিবেদনের কপি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সঠিক সময়ে কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা জানতে চাওয়াসহ দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশও দেবে আইএমইডি।
অগ্রগতিতে অসন্তোষ আইএমইডির
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, “আমরা কিছু চলমান প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ করেছি। এতে দেখা গেছে কিছু প্রকল্পে অগ্রগতি খারাপ। নানা কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে অন্যতম ‘সার সংরক্ষণ ও বিতরণের সুবিধার্থে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৩৪টি বাফার গুদাম নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প।”
আরও পড়ুন
‘প্রকল্পের নির্মাণকাজ কেন শুরু হয়নি আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবো। সে বিষয়ে আমরাসহ বেশকিছু প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ধীরগতি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে আমাদের সুপারিশ দেওয়া হবে। যাতে প্রকল্পের যেখানে গ্যাপ আছে সেটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।’
যা বলছে বিসিআইসি
বিসিআইসি জানায়, নানা কারণে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করা যায়নি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন থাকায় সে বছরে কোনো অর্থ বরাদ্দ ও ছাড় হয়নি। চলতি অর্থবছর প্রকল্পের অনুকূলে ৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ছাড় হলেও কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি।
মে, ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৩২২ কোটি ৪৩ টাকা বা ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় পণ্য কেনার সাতটি, কার্য ক্রয়ের ছয়টি ও তিনটি সেবা ক্রয়ের প্যাকেজ রয়েছে। পণ্য কেনার সাতটি প্যাকেজের মধ্যে তিনটি প্যাকেজের ক্রয়কাজ সম্পন্ন। ছয়টি প্যাকেজের আওতায় ১৮টি লটের ৩৪টি সাইটের মধ্যে ১৪টির দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন। ফলে ৩৪টি বাফার গুদামের নির্মাণকাজ এখনো শুরু হয়নি।
প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু না হওয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) ও বিভাগীয় প্রধান (পরিকল্পনা বিভাগ) কাজী আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প শুরু হওয়ার জন্য নকশাসহ কিছু কাজ শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে পাস হয়। প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। তবে এটার জন্য আমি নির্দিষ্ট ব্যক্তি নই। একজন পিডি আছেন, ওনার সঙ্গে কথা বললে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।’
প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে তার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দেওয়া একজন ফোন ধরে বলেন, স্যার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন না।’
চ্যালেঞ্জ জমি অধিগ্রহণ
প্রকল্পের অন্যতম প্রধান কাজ ৩৪টি জায়গার জন্য ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা। কিন্তু বাস্তবে মূল ডিপিপি অনুমোদনের প্রায় তিন-চার বছর পর জমির মূল্য পরিশোধের চাহিদাপত্র পাওয়া যায়। এখন মাদারীপুর, পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া ও কুড়িগ্রাম জেলার ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।
প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে বৈদ্যুতিক খুঁটি, রেলওয়ের জমি, খাসজমি, নদী শ্রেণির জমি, রাস্তা সংক্রান্ত জটিলতা, জনপ্রতিনিধিদের স্থান পরিবর্তনের প্রস্তাব ইত্যাদি জটিলতা ছিল। কিছু কিছু জায়গার মালিকের জমি অধিগ্রহণ প্রত্যাহারের আবেদন ও আবেদন নিষ্পত্তিতে সময় ব্যয় হয়েছে বিধায় জমি অধিগ্রহণ বিলম্বিত হয়েছে।
চলতি অর্থবছর কার্যক্রমের ছয়টি প্যাকেজের আওতায় ১৮টি লটের ৩৪টি সাইটের মধ্যে ২৪টির দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, যা যথাসময়ে মূল্যায়ন শেষ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া এ প্রকল্পের একাধিক প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনে প্রকল্পের অগ্রগতি মন্থর হয়েছে।
এমওএস/এএসএ/এমএস