চ্যানেল২৪’র অনুসন্ধান
ফাঁস হয়েছিল ৪৬তম বিসিএসের প্রিলির প্রশ্নপত্র
সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) অধীনে অনুষ্ঠিত সবশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষার আগের রাতে চুক্তিতে রাজি হওয়া প্রার্থীদের নির্ধারিত স্থানে নিয়ে গিয়ে তাদের প্রশ্ন ও উত্তর পড়ানো হয়। পরে সকালে নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে ওই প্রার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেন।
প্রশ্ন পেয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দেওয়া এসব প্রার্থীরা উত্তীর্ণও হয়েছেন। প্রিলিতে পাস করার পর চুক্তিতে থাকা প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল চক্রটি।
চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। শুক্রবার (১২ জুলাই) রাত ৯টায় প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয়। এতে প্রশ্নফাঁসের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্নফাঁসে কারা কীভাবে জড়িত
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পিএসসির কর্মচারী সাজেদুল ইসলাম সাজু ৪৬তম বিসিএসের প্রশ্নফাঁসকাণ্ডের মূলহোতা। তার কাছে থেকে ৪৬তম বিসিএস প্রিলির প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন মাহমুদুল হাসান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের এক শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি নাটোরে। সম্প্রতি মাহমুদুল বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরা পারসন হিসেবে কাজ শুরু করেছেন।
আরও পড়ুন
- কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি, ‘সন্দেহে’ প্রশ্ন প্রণয়নকারীরাও
- খলিলের ফাঁস করা প্রশ্নে ৩ বিসিএস ক্যাডার, আতঙ্কে অন্যরাও
- যেভাবে ফাঁস হতো পিএসসির প্রশ্ন
৪৬তম বিসিএসের প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ঘটনা অকপটে স্বীকার করে মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ‘পিএসসির কর্মচারী সাজেদুল ইসলাম সাজু আমাকে মোহাম্মদপুর থেকে একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখানে আমাকে সকালের দিকে ২০০ নম্বরের এমসিকিউ প্রশ্ন দেন। ওইটা আমি পড়লাম। পড়ার পর হলে গিয়ে দেখি কমন পড়ছে। এক লাখ টাকার বিনিময়ে এ চুক্তি হয়েছিল।’
এ বিসিএসে প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দেন রুবেল নামে আরও একজন প্রার্থী। তিনিও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার আগের রাতে মাহমুদুল (ঢাবির সাবেক ছাত্র) ভাই আমাকে আইডিবির সামনে আসতে বলেন। সেখান থেকে তারা আমাকে গাড়িতে করে মোহাম্মদপুর নিয়ে যান। মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় আমাদের রাত ৯-১০টার দিকে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেয়। ওই বাসায় আরও লোকজন ছিলেন। তারা আমাদের সারারাত ওই প্রশ্নগুলো সমাধান করিয়েছেন। তারপর আমাদের সকালে ছেড়ে দিয়েছেন। পরে আমরা সবাই যে যার কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি।’
রুবেল আরও বলেন, ‘প্রিলির জন্য ওই রাতে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ প্রশ্ন পড়ানো হয়েছে। প্রিন্ট করা কাগজে তাদের ওই প্রশ্নগুলো সরবরাহ করা হয়। মোহাম্মদপুরের বাসার যে রুমে আমি প্রস্তুতি নিয়েছি, সেখানে ৮-৯ জন ছিলেন। আর ওই বাসায় আমার মতো আরও ১০০ জন প্রশ্ন পেয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। আমার সঙ্গে ২ লাখ টাকায় প্রশ্ন পাওয়ার বিষয়ে চুক্তি হয়।’
মাহমুদুল ও রুবেল ছাড়াও আরও ৬ জন শিক্ষার্থীর তথ্য উঠেছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানে। যারা প্রশ্নপত্র পেয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করেছেন।
আরও পড়ুন
- প্রশ্নফাঁস: পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ কারাগারে ১১ জন
- আবেদ আলীর অভ্যাসই ‘অপকর্মে জড়ানো’
- দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত আবেদ আলীসহ ৭ জন
গত ২৬ এপ্রিল ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে ২০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নেন ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬১ চাকরিপ্রার্থী।
গত ৯ মে ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে পিএসসি হয়। এতে উত্তীর্ণ হন ১০ হাজার ৬৩৮ জন। আগামী ২৮ আগস্ট থেকে এ বিসিএসের লিখিথ পরীক্ষা শুরুর কথা রয়েছে।
প্রথম প্রতিবেদন ও প্রতিক্রিয়ায় যা যা ঘটেছে
গত ৭ জুলাই পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সবশেষ গত ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁস হয়। পরীক্ষা শুরুর ১ ঘণ্টা আগেই চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদকের হোয়াটসঅ্যাপে চক্রটি প্রশ্ন পাঠায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চক্রটি ৩৩তম থেকে ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে আসছে। এতে পিএসসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।
প্রতিবেদনটি প্রচারের পর সিআইডি অভিযান চালিয়ে পিএসসির সাবেক-বর্তমান ৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার করে। চক্রে পিএসিসির আরও ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
অন্যদিকে পিএসসি গ্রেফতার ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে এবং দুদককে তাদের সম্পদ অনুসন্ধানে অভিযোগ করেছে। তাছাড়া কোচিং ব্যবসায় জড়িত এমন পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য আরও কয়েকজনকে নোটিশ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে পিএসসি সূত্র।
এএএইচ/ইএ