প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের হিড়িক, থাকছেন ‘আস্থাভাজনরা’

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৪ এএম, ১১ জুলাই ২০২৪
গত ছয় মাসে প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েছে/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ছয় মাসে অন্তত অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন, যা গত বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। সরকারের ‘আস্থাভাজন’ হিসেবে পরিচিতরাই এক্ষেত্রে এগিয়ে। প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ারই অংশ। তবে এ ধরনের নিয়োগ প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয় বলে দাবি জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের।

সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যেহেতু আবার ক্ষমতায় এসেছে, কৃতজ্ঞতা হিসেবে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের চুক্তিতে নিয়োগ দিচ্ছে। এ কারণে ভোটের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আরও বেড়েছে। এতে নিচের পদের কর্মকর্তারা ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাদের মাধ্যমে অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি করছে।

কোনো কোনো কর্মকর্তার চুক্তির মেয়াদ একাধিকবার বাড়ানোয় অসন্তোষ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা। তারা বলছেন, চুক্তি এমনিতেই শৃঙ্খলা নষ্ট করে, পদোন্নতির পথ রোধ করে। এর ওপর বারবার চুক্তির মেয়াদ বাড়ালে সংকট তীব্র হয়। অনেকে নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সততা দিয়ে কর্মজীবন উজ্জ্বল রাখলেও শেষে নিজেকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় না দেখে একরাশ হতাশা নিয়ে অবসরে যান।

আমরা ৩০ বছর ধরে বলে আসছি চুক্তির চাকরি হচ্ছে তুষ্টির চাকরি। যিনি চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ পান, তিনি আইন-কানুন অনুসরণ না করে মনিব বা কর্তাকে সব সময় খুশি করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। চুক্তিভিত্তিক চাকরি যত বাড়বে প্রশাসন তত দুর্বল হয়ে যাবে।- সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান

বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম, সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ‘বাছ-বিচারহীন’ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

৬ মাসে অর্ধ শতাধিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গত ছয় মাসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভোটের পর অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগের বছর একই সময়ে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ২০ জনের মতো। চলতি বছর চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব, কৃষি সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, রাজউক চেয়ারম্যান, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা আছেন।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে যে অধস্তন কর্মকর্তা বঞ্চিত হন সেটা জনপ্রশাসনমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। তবে যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা দেশের স্বার্থে বলেও দাবি মন্ত্রীর।

চাকরি আইনে যা আছে

মূলত ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ৪৯ ধারার ক্ষমতাবলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। আইনের ৪৯ ধারার ১-উপধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি জনস্বার্থে কোনো কর্মচারীকে চাকরি হইতে অবসর গ্রহণের পর, সরকারি চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করিতে পারিবেন। উপধারা-২ এ বলা হয়েছে ‘উপ-ধারা (১) এর অধীন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী অবসর-উত্তর ছুটি ভোগরত থাকিলে, উক্ত ছুটি স্থগিত থাকিবে এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সমাপ্তির পর উক্ত অবশিষ্ট অবসর-উত্তর ছুটি ও তৎসংশ্লিষ্ট সুবিধা ভোগ করা যাইবে।’

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে পারেন। আর মুক্তিযোদ্ধা হলে অবসরের বয়স ৬০ বছর।

যে লোকটি সচিব হওয়ার যোগ্য তাকে নিচ থেকেই বিদায় নিতে হচ্ছে। তার হতাশার কথা চিন্তা করেন। এটা তো জাতির হতাশা। একজন যোগ্য ব্যক্তি সচিব হলে সে চুরি করতো না, দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিতো।- সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান

চলমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ১ মার্চ তখনকার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হলে এজন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ৩০ বছর ধরে বলে আসছি চুক্তির চাকরি হচ্ছে তুষ্টির চাকরি। যিনি চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ পান, তিনি আইন-কানুন অনুসরণ না করে মনিব বা কর্তাকে সব সময় খুশি করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। চুক্তিভিত্তিক চাকরি যত বাড়বে প্রশাসন তত দুর্বল হয়ে যাবে। যারা পদোন্নতিপ্রত্যাশী তারা হতাশ হবে, ন্যায্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হবেন।’

সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপনি যদি কর্তাদের পারপাস সার্ভ করতে পারেন তবে আপনি উচ্চপদে যাবেন, আপনার চুক্তিও হবে। একই সরকার আবার ক্ষমতায়, তারা তাদের আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের খুশি করবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটার একটা অংশ এ চুক্তি।’

তিনি বলেন, ‘যারা এখন ভালো অফিসার হিসেবে চিহ্নিত, যারা কর্মদক্ষ কিন্তু পদলেহন করে না, তারা তো উপসচিব, যুগ্মসচিব থেকেই অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, প্রমাণ আছে। কিন্তু তাদের ওপরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

‘যে লোকটি সচিব হওয়ার যোগ্য তাকে নিচ থেকেই বিদায় নিতে হচ্ছে। তার হতাশার কথা চিন্তা করেন। এটা তো জাতির হতাশা। একজন যোগ্য ব্যক্তি সচিব হলে সে চুরি করতো না, দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিতো। তার যোগ্য পদে না যেতে পারা তো তার যেমন ব্যক্তিগত ক্ষতি, একই সঙ্গে দেশেরও ক্ষতি।’

ফাওজুল কবির খান আরও বলেন, ‘আগে সরকার চিন্তা করতো তাদের যাতে সুনাম হয়। সেজন্য রাজনৈতিক পরিচয় যাই থাকতো যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য জায়গায় বসাতে কার্পণ্য করতো না। মন্ত্রীরা সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতেন। এখন সেটা নেই।’

প্রধানমন্ত্রী সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করেন। এখন আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ভালো লোক খুঁজে নিয়োগ দিতে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে যার সুযোগ ছিল তিনি হয়তো বঞ্চিত হন।- জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন

ভোটের আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে কয়েকজন সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করেন। এখন আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি ভালো লোক খুঁজে নিয়োগ দিতে। আমরা সব সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকে নিরুৎসাহিত করি, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনও রয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে যার সুযোগ ছিল তিনি হয়তো বঞ্চিত হন।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় দেশের স্বার্থে, দেশের কল্যাণে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাউকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।’

গত ৬ মাসে যে শীর্ষ কর্মকর্তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আগে থেকেই চুক্তিতে ছিলেন। তার এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ গত ৪ জুলাই শেষ হয়। গত ২৬ জুন তার চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও চুক্তিতে দায়িত্ব পালন করছেন। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ ১১ জুলাই শেষ হবে। গত ৫ জুলাই তারও চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

গত ৩০ জুন চুক্তিতে আরও এক বছরের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগ পান মো. আলী হোসেন। গত ২ জুলাই আলী হোসেনের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীরও চুক্তির মেয়াদ এক বছর বেড়েছে। চাকরির মেয়াদ শেষে তিনি আগে থেকেই এক বছরের চুক্তিতে ছিলেন। সেই মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়। তার চুক্তির মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে গত ২৬ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকারের গত ১১ জুন অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। গত ৯ জুন তাকে এক বছরের জন্য একই পদে চুক্তিতে নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

গত ৯ এপ্রিল জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. মোশারফ হোসেন ভুঁইয়ার চুক্তির মেয়াদ ৯ মাস বাড়ানো হয়। ২১ এপ্রিল জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমদের চুক্তির মেয়াদও বাড়ানো হয় ৬ মাস।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তারের চাকরির মেয়াদ গত ১১ মার্চ শেষ হওয়ার কথা। চুক্তিতে তাকে এক বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে গত ৭ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব ওয়াহিদুল ইসলামের মেয়াদ ৬ মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

আরও পড়ুন

এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবীরের অবসরে যাওয়ার কথা। তিনিও গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান।

চলতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের চুক্তির মেয়াদও দুই বছর বেড়েছে।

গত ৪ এপ্রিল দুই বছরের চুক্তিতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ পান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার। ৩ এপ্রিল জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের মহাপরিচালক পদে মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরীকে ফের নিয়োগ দেয় সরকার।

গত ২৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব থাকার সময় অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান। পরে ৪ জুলাই তাকে চুক্তিতে দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির প্রধান পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়।

অবসরে যাওয়া গ্রেড-১ কর্মকর্তা সারওয়ার মাহমুদকে গত ২৪ মার্চ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনও এক বছরের চুক্তিতে রয়েছেন। আগামী ১৩ অক্টোবর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। তিনিও আরও এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন বলে জানা যায়।

আরএমএম/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।