বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড

অল্প বৃষ্টিতেই সেই ১৬ পাহাড়ে ধস, বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা

ইকবাল হোসেন
ইকবাল হোসেন ইকবাল হোসেন , নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ১২:৪৫ পিএম, ০২ জুলাই ২০২৪
বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়/জাগো নিউজ

বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে ঝুঁকিতে থাকা সেই ১৬ পাহাড়ে ধস শুরু হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়ে সাড়ে চার বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো।

৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলোতে ধস শুরু হওয়ায় সড়কটি দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনগুলো রয়েছে ঝুঁকিতে। বৃষ্টি আরও বাড়লে বড় ধসের আশঙ্কা করছেন এ সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরা।

সরেজমিনে বায়েজিদ-ফৌজদার লিংক রোডে গিয়ে দেখা যায়, চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই পাহাড়গুলোর অনেক স্থানে ধসে পড়ছে। দুটি স্থানের পাহাড় ধসের মাটি ফুটপাতসহ মূল সড়কে চলে এসেছে। পাহাড় ধসের ঝুঁকির মধ্যেও সড়কটি দিয়ে যাতায়াত করছে অসংখ্য যানবাহন।

বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের ১৬ পাহাড় মানসম্মতভাবে কাটার বিষয়ে আমরা এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনসহ ড্রয়িং ডিজাইন সহকারে আমাদের প্রস্তাবনা পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি। প্রস্তাবনাটি অনুমোদন ও নির্দেশনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর হয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।- প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার

লিংক রোডের জঙ্গল সলিমপুর রাস্তার মাথায় কথা হয় স্থানীয় সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা বায়েজিদ হয়ে সলিমপুরে নিয়মিত যাতায়াত করি। এখন রাস্তার পাশের পাহাড়গুলোতে ধস শুরু হয়েছে। একেকটি খাঁড়া পাহাড়ের উচ্চতা একশ ফুটেরও ওপরে। বিশেষ করে বায়েজিদ থেকে ফৌজদারহাটগামী সড়ক অংশের লাগোয়া কয়েকটি পাহাড়ের মধ্য অংশ ধসে মাটি রাস্তায় নেমে এসেছে। এতে পাহাড়ের ওপরের অংশে আরও বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’

কামরুল ইসলাম নামে এক অটোরিকশা চালক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এশিয়ান উইম্যান ইউনিভার্সিটির মুখ থেকে জঙ্গল সলিমপুর রুটে সিএনজি অটোরিকশা চালাই। এখন বর্ষা শুরু হওয়ায় পাহাড়গুলো ভিজে নরম হয়ে আছে। রাস্তার পাশের সিডিএর কাটা পাহাড়গুলো এখন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বৃষ্টিতে পাহাড়ের ওপরের অংশে ধস শুরু হলে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর ওপরেও পড়তে পারে।’

https://www.jagonews24.com/

সংযোগ সড়ক প্রকল্প

জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসনের জন্য প্রায় ২৭ বছর আগে মূল শহরের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে সংযুক্ত করে বাইপাস সড়ক করার উদ্যোগ নেয় সিডিএ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি নির্মাণে প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের অংশ হিসেবে ৯২০ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। দীর্ঘ সময় পরে মূল বাইপাস সড়ক নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পরে ২০১৯ সালের ১২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়।

আরও পড়ুন

৬ কিমি রাস্তার জন্য কাটা হয় ১৬ পাহাড়

প্রকল্পের আওতায় একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ছয়টি ব্রিজ এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ কিমি রাস্তা নির্মাণের জন্য কাটা হয় ১৬টি পাহাড়। তবে শহরের এক প্রান্তে অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় পাহাড়গুলো কাটার প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো সমালোচনা ছিল না।

অল্প বৃষ্টিতেই সেই ১৬ পাহাড়ে ধস, বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা

অনুমোদনের তিনগুণ পাহাড় কাটে সিডিএ

পরবর্তীসময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেপরোয়া পাহাড় কাটার তথ্য উঠে এলে নড়েচড়ে বসে পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০২০ সালের শুরুতে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন একেবারে নতুন রাস্তাটি নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নেওয়া হলেও সিডিএ পাহাড় কেটেছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট।

২০২০ সাল থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। পাহাড় কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যে জরিমানা করেছে, সেটির বিষয়ে আপিল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।- সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস

ওই ঘটনায় সিডিএকে নোটিশ দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি শুনানিতে ডাকে পরিবেশ অধিদপ্তর। শুনানিতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি এবং ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়।

অনুমোদিত পাহাড় কাটায় জরিমানা

শুনানি শেষে সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী। এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নকশা না মেনে পাহাড় কাটার অভিযোগ তোলেন সিডিএর বিরুদ্ধে। পরে জরিমানার বিষয়টি নিয়ে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে আপিল করে সিডিএ। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ খাঁড়া পাহাড়গুলো নতুন করে কাটার জন্য ২০২০ সালের ২৩ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে নতুন করে আবেদন করে ৩ লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চায় সিডিএ।

অল্প বৃষ্টিতেই সেই ১৬ পাহাড়ে ধস, বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা

সিডিএ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকল্পে আগে কাটা ১৬টি পাহাড় ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার জন্য ২০২০ সালে সিডিএ নতুন করে প্রস্তাবনা দিলেও তা না করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদন চাওয়া হলেও ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কাটার অনুমতি মেলেনি।

এরপর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কাটা ও সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতসহ প্রতিবেদন চায় পরিবেশ অধিদপ্তর। তখন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রকল্পটির পরিচালক ও চুয়েটের দুই শিক্ষকের সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য বুয়েটের দুই শিক্ষক ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করেন।

পরবর্তীসময়ে পরামর্শকসহ পুরো কাজের জন্য সিডিএকে আর্থিক প্রস্তাবনা দেয় চুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম। তবে চুয়েটের ওই বিশেষজ্ঞ টিমের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় নতুন করে বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি নামের আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় সিডিএ। পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। তারা প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ পাহাড় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার পরামর্শ দেয়। এরপর পরামর্শকের প্রতিবেদনের বিষয়ে অবগত করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় সিডিএ।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৬ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও আপিল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. ফারহিনা আহমেদের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বোর্ডে সিডিএ পাহাড় কাটার মামলাটি শুনানি হয়। শুনানি শেষে আগের ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা কমিয়ে ৫ কোটি টাকা জরিমানা পুননির্ধারণ করে আপিল বোর্ড।

অল্প বৃষ্টিতেই সেই ১৬ পাহাড়ে ধস, বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা

আপিল বোর্ডের নির্দেশনা মোতাবেক পাহাড়গুলো কাটা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয় সিডিএ। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পের পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের ১৬ পাহাড় মানসম্মতভাবে কাটার বিষয়ে আমরা এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনসহ ড্রয়িং ডিজাইন সহকারে আমাদের প্রস্তাবনা পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি। বর্তমানে আমাদের প্রস্তাবনাটি অনুমোদন ও নির্দেশনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর হয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।’

এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২০ সাল থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আমরা এখন পাহাড়গুলো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক কাটার পদক্ষেপ নেবো। এরই মধ্যে পাহাড় কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যে জরিমানা করেছে, সেটির বিষয়ে আপিল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।