তিস্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেল

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৪২ এএম, ২৫ জুন ২০২৪
ছবিতে বাঁ দিক থেকে ইমতিয়াজ আহমেদ, সাইফুল আলম ও মাহমুদুর রহমান মান্না

• ‘বড় কিছু হয়েছে বলা মুশকিল’
• ‘খুব বড় কিছু আমরা দেখিনি’
• ‘বাংলাদেশের স্বার্থের কথা আছে বলে মনে হয়নি’

এক পক্ষকালের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরমধ্যে টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৮ জুন ভারতে যান তিনি। তিনদিনের সফর শেষে দেশে ফিরেন ১০ জুন। এর ঠিক ১১ দিনের মাথায় ২১ জুন দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ফের ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী। সফর শেষে দেশে ফেরেন ২২ জুন।

বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফরটি ঘিরেই সব আলোচনা। এ সফরে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও স্বার্থ সুরক্ষা কতটুকু হলো, এ নিয়ে চলছে চুলচেলা বিশ্লেষণ। বিএনপিসহ সমালোচকরা বলছেন, প্রাপ্তির কিছুই নেই। এখানে সরকার তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি। তবে আওয়ামী লীগের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সফরে বড় আকারে প্রাপ্তির কিছু নেই। শুধু বন্ধুত্বের জানান দেওয়া হলো। তিস্তার পানিবণ্টনও যে হচ্ছে না, এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেছে। বরং এ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে নতুন করে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

এ সফরে বড় আকারে প্রাপ্তির কিছু নেই। শুধু বন্ধুত্বের জানান দেওয়া হলো। তিস্তার পানিবণ্টনও যে হচ্ছে না, এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেছে। বরং এ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে নতুন করে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।- বলছেন বিশ্লেষকরা

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে গত শুক্রবার (২১ জুন) রাষ্ট্রীয় সফরে নয়াদিল্লি যান শেখ হাসিনা। দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে দেশে ফেরেন শনিবার (২২ জুন)। এ সফরে দুদেশের মধ্যে ১০টি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর মধ্যে সাতটি নতুন এবং তিনটি নবায়ন করা হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, এ সফরে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল যোগাযোগ স্থাপন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। বাংলাদেশের কাছ থেকে রেল ট্রানজিট চায় ভারত। এছাড়া তিস্তা প্রকল্পে অংশগ্রহণের প্রস্তাবও দিয়েছে প্রতিবেশী দেশটি। শুধু তা-ই নয়, এ নিয়ে ঢাকায় কারিগরি দল পাঠানোর বিষয়েও সায় দিয়েছে ভারত।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পরীক্ষামূলকভাবে আগামী মাসেই বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেল চলবে। তবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিস্তারিত বক্তব্য আসেনি। রেল ট্রানজিটের শর্তগুলোও উঠে আসেনি।

এ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভারত সফরে নিজেদের অধিকার, আন্তর্জাতিক আইনের অধিকারের কথাগুলো বলতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের কাছে সরকার সেবাদাসে পরিণত হয়ে গেছে। শুধু ভারত নয়, আশপাশের সব প্রতিবেশী দেশের কাছে তারা পুরোপুরি মাথা নিচু করে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। মিয়ানমার থেকে গুলি আসে, জবাবটাও পর্যন্ত তারা দিতে পারে না।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ফলপ্রসূ দাবি করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পর্ককে জোরদার করতে হবে। শেখ হাসিনা এ সফরে তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ছিল অত্যন্ত চমৎকার, ফলপ্রসূ ও আন্তরিকতাপূর্ণ।

এ সফরে মাধ্যমে বড় কিছু হয়েছে, সেটা বলা মুশকিল। তবে, দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, উভয় দেশ কানেক্টিভিটির ক্ষেত্র বাড়াতে চায়; দ্বিতীয়ত, তিস্তার পানিবণ্টন আর হচ্ছে না।- অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

‘এ সফরে দুদেশের সম্পর্কের অগ্রগতি ও অর্জনগুলো স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। যেখানে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে এবং ১৩টি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা এসেছে’- যোগ করেন তিনি।

ভারতসহ অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিরাজমান অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোর শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

‘বড় কিছু হয়েছে বলা মুশকিল’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, এ সফরে মাধ্যমে বড় কিছু হয়েছে, সেটা বলা মুশকিল। তবে, দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, উভয় দেশ কানেক্টিভিটির ক্ষেত্র বাড়াতে চায়; দ্বিতীয়ত, তিস্তার পানিবণ্টন আর হচ্ছে না।

তিনি বলেন, কানেক্টিভিটির বিষয়টা যেন আরও বড় আকারে বা নতুন ক্ষেত্রে হতে পারে, যেমন- মেরিটাইম, রেল, স্পেস- এগুলোর ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এগুলোর ওপর কাজ করা হবে। অনেক সময় সমঝোতা চুক্তি হয়, বাস্তবায়ন হয় না। বড় ধরনের সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে বড় কিছু নেই যদিও, তবে আরও কানেক্টিভিটি যেন হয়, সে চেষ্টা থাকবে।

‘এখন সেটার ওপর কাজ হবে, বিনিয়োগ হবে কি না, নতুন লোন হবে কি না ইত্যাদি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হবে। আমাদের নিজেদের যে কানেক্টিভিটি চাচ্ছি নেপাল-ভুটানের সঙ্গে, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না, দেখা দরকার।’

অধ্যাপক ইমতিয়াজের ভাষ্য, তিস্তার ব্যাপারে মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে, পানিবণ্টন আর হচ্ছে না। তার পরিবর্তে যেটা এসেছে, বাংলাদেশের তিস্তা ম্যানেজম্যান্ট প্রকল্পে ভারতের অংশগ্রহণের ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। তারা লোক পাঠিয়ে এসেস করবে, কীভাবে এখানে তারা অংশগ্রহণ করতে পারে! তবে যেটা দেখা দরকার- চীনের সঙ্গে এরই মধ্যে বাংলাদেশের যেহেতু এ ধরনের আলোচনা হয়ে গেছে, প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে যাবে, তখন এ বিষয়ে বড় ধরনের চুক্তি হবে কি না! হলেও ভারতের কোনো ভূমিকা থাকবে কি না!

প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে দুদিনের সফর করে এলেন, কিছুই পাননি। গিয়েছেন কেন সেটারও যৌক্তিকতা দেখিনি। দুই প্রধানমন্ত্রী মিলে যে কথা বলেছেন, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা আছে বলে আমার মনে হয়নি।- মাহমুদুর রহমান মান্না

তিনি বলেন, তবে এখন সেটা পরিষ্কার যে, পানিবণ্টন আর হচ্ছে না। যেটা প্রতিবারই বলা হতো- মমতা ব্যানার্জি বা পশ্চিমবঙ্গের কারণে হচ্ছে না, ভবিষ্যতে হবে, নির্বাচনে জিতলে হবে, ইত্যাদি। আমরা সবসময় বলে আসছি- তিস্তার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। সেখানে তারা বিনিয়োগ করবে কি না, এককভাবে আসবে কি না, নাকি চীন এলে তাদের কোনো ভূমিকা থাকবে, এ জায়গায় কোনো কিছু থাকলে নতুন কিছু হবে। না হলে এই সফরে নতুন কিছু নেই।

‘খুব বড় কিছু আমরা দেখিনি’

ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কটা দীর্ঘমেয়াদি, ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়। এর বহুমাত্রিকতা আছে। একটা বা দুটো বৈঠকে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, সেরকম সম্পর্ক ভারত-বাংলাদেশের নয়। ভারত একেবারেই প্রতিবেশী। ভারতের যে অর্থনীতি, রাজনীতি ও অবয়ব; তার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও অবয়বের একটা সংশ্লিষ্টতা আছে।

‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ভারতের অবদান আছে। সেই সময়ের সম্পর্কটিই এখনো বহমান। এটি কখনো খুবই ভালোভাবে চলেছে, কখনো নানা রকম ধাক্কাও খেয়েছে। কারণ, এখন সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন রাষ্ট্র; সবকিছুর ওপর যেমন নির্ভর করে, স্বার্থের ওপরও নির্ভর করে। স্বার্থের সংঘাত কখনো কখনো হয়েছে। অভিন্ন অনেক কিছু আছে, যা আমরা মীমাংসা করেছি। কিছু অর্জন আছে, অপ্রাপ্তিও আছে।’
তিনি আরও বলেন, এবারের সফরটিকে প্রত্যাশার চেয়ে ভিন্নভাবে দেখি এই অর্থে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী টানা চতুর্থবার সরকার গঠনের পর তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ভারতে হলো। আরেকটা হলো- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের পর প্রথমেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন সফরের, রিসিভ করলেন। এটার একটা মাত্রা আছে। কারণ, তিনি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।

তিস্তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই গেল

সফরের প্রাপ্তি নিয়ে সাইফুল আলম বলেন, এ সফরে কিছু চুক্তি হয়েছে, কিছু নবায়ন হলো। সেখানে খুব বড় কিছু আমরা দেখিনি। দুটি বিষয় নতুন- সবুজায়ন ও সমুদ্রভিত্তিক সহযোগিতার কথা। দীর্ঘদিন তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি ঝুলে আছে। ১৩ বছর এটি নিয়ে আমরা প্রত্যাশার মধ্যে আছি। এবারের সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার বক্তব্যে বলেছেন, ভারতের একটি কারিগরি টিম তিস্তার ব্যাপারে বাংলাদেশে আসবে। আমরা জানি না, এ টিম কবে আসবে, কতদিন কাজ করবে, কোনো সীমারেখাও নেই। আসলে কী হবে, আমরা জানি না।

‘এরমধ্যে চীনের সঙ্গে আমাদের তিস্তা নিয়ে কথা হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবও আছে বাংলাদেশের কাছে। ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। সেখানে আমরা জানি না, ভারত থেকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে কতদিন অপেক্ষা করবো, কিংবা কারিগরি কমিটি কতদিন বসবে, কতদিনে শেষ করবে, ১৩ বছর তো গেল।’

‘এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন কারিগরি টিম আসবে বলেছে, তখন আবার এটা নিয়ে চীনের সঙ্গে আলাপ করা যাবে কি না, এ মুহূর্তে সেটাও বুঝতে পারছি না। সেখানে আমাদের একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল। সামনে গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন হবে সেটাও একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় আমাদের সীমান্তে হত্যা। এটা নিয়ে আমরা প্রতিশ্রুত আচরণ পাচ্ছি না, এখানেও একটা প্রত্যাশার জায়গা রয়ে গেছে’- বলেন জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক।

আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশের এখন ফরেন পলিসি ভারতীয় হয়ে গেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ভারতকে আমি যা দিয়েছি, আর কেউ দেয়নি।’ বিনিময়ে পেয়েছেন কী, তার কোনো জবাব নেই।

‘এই যে প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে দুদিনের সফর করে এলেন, কিছুই পাননি। গিয়েছেন কেন সেটারও যৌক্তিকতা দেখিনি। দুই প্রধানমন্ত্রী মিলে যে কথা বলেছেন, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা আছে বলে আমার মনে হয়নি। তাছাড়া বর্ডারে হত্যা, ব্যবসায়ে অসমতা ও আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমরা বহু দেখছি’- বলেন মান্না।

এসইউজে/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।