৮০ হাজার টাকার নিচে গরু মিলছে না ঢাকার গাবতলী হাটে
ঈদুল আজহার বাকি আর মাত্র চারদিন। এ ধর্মীয় উৎসবে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রিয় পশু কোরবানি দিতে সাধ্যের সবটুকু চেষ্টা করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকার একমাত্র স্থায়ী পশুর হাট গাবতলীতে আসতে শুরু করেছে কোরবানির পশু। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের নানান প্রান্ত থেকে ট্রাকে করে গরু আসছে গাবতলীতে। এখনো বেচাকেনা সেভাবে শুরু না হলেও বেশ আয়েশ করে চলছে দরকষাকষি।
ব্যাপারীদের দাবি, গরুর খরচের বিষয়ে ক্রেতাদের কোনো ধারণা নেই। যে কারণে গরুর দাম কম বলছেন তারা। ক্রেতারা তাদের দুঃখ-ব্যথা বোঝার চেষ্টা করেন না। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, আকাশচুম্বী দাম চাচ্ছেন ব্যাপারীরা। এর ফলে দরকষাকষি বেশি হচ্ছে। গরু দেখছেন ক্রেতারা, তবে সেভাবে বেচাকেনা শুরু হয়নি। এবার হাটে ৮০ হাজার টাকার কমে কোনো গরু মিলছে না।
মঙ্গলবার (১১ জুন) সরেজমিনে দেখা গেছে এমন চিত্র। হাটের প্রবেশমুখেই দেখা যায় হাসিলের জন্য বাঁধা রয়েছে একটি গরু। দুই মণ মাংস হবে না এমন আকারের গরুটি বিক্রি হয়েছে ৮১ হাজার টাকায়।
কালো-সাদা রঙের শংকর জাতের মাঝারি আকারের একটি গরু ১ লাখ ১ হাজার টাকায় কিনেছেন সাভারের আরেফিন সাঈদ। ব্যাপারীরা চার মণ মাংস হবে বললেও এ গরু থেকে তিন মণ মাংস মেলা ভার। হাটে গরুর দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ সাঈদের।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ব্যাপারীরা গরু ছাড়ছে না, দাম অনেক বলছে। বেলা ১১টায় হাটে ঢুকেছি, এখন বিকেল চারটা। পাঁচ ঘণ্টা ঘুরে একটা গরু কিনেছি।’
ঢাকায় এনে গরু বিক্রি করে যে দাম পেয়েছেন তাতে খুশি নন কুষ্টিয়ার সিদ্দিক ব্যাপারী। দেশি জাতের এক জোড়া গরু বিক্রি করেছেন দুই লাখ ৩০ হাজার টাকায়। তার দাবি, গরু দুটি থেকে ৮ মণ মাংস মিলবে। গাবতলী হাটে এনে আশানুরূপ দাম পাওয়া গেলো না। এর থেকে গ্রামের হাটে বিক্রি করলে আরও ভালো দাম পেতেন বলে দাবি তার।
জাগো নিউজকে সিদ্দিক বলেন, ‘বাড়িতে পালন করা দুইটা গরু বিক্রি করলাম মোট দুই লাখ ৩০ হাজার টাকায়। এখানে গরু নিয়ে এসে যে ভুল করেছি তা বলার নয়। অযথায় গাড়ি ভাড়া দেওয়া লাগলো। হাটে আর গরু নিয়ে আসবো না ভাই। এত দূরে খরচ করে এনে কোনো লাভ আছে! বাড়ি ফিরতে হয় কাঁদতে কাঁদতে।’
বাড়িতে পালন করা ৫টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন কুষ্টিয়ার আরেক ব্যাপারী শফিকুর রহমান। সোমবার বড় আকারের এসব গরু নিয়ে গাবতলী আসেন তিনি। গরুগুলোর বয়স হবে চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে একটা গরুর নাম রেখেছেন ‘কুষ্টিয়ার ডন’। ১৮ মণ মাংস মিলবে এমন গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ১২ লাখ টাকা। শুধু শফিকুর নন, একই এলাকার আরও ৫ জন মিলে কয়েকটি ট্রাক ভাড়া করে দেশি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন বাড়তি দামের আশায়।
আরও পড়ুন
- জমে উঠেছে পশুর হাট, বেশি হাসিল নেওয়ার অভিযোগ
- চট্টগ্রামে জমে ওঠার অপেক্ষায় কোরবানির পশুর হাট
- জমে উঠছে সিরাজগঞ্জের ৫৭ পশুর হাট
নিজের গরুর দামের বিষয়ে শফিকুর বলেন, ‘সব গরু আমার বাড়ির। একটা আছে ১৮ মণ ওজনের, দাম চাচ্ছি ১২ লাখ টাকা।’
ক্রেতাদের অভিযোগ গরুর বাড়তি দাম চাচ্ছেন ব্যাপারীরা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা আমাদের মনের কষ্ট বোঝে না। গরু পালন করতে কত খরচ হয় এটাও ক্রেতারা জানে না। গরুর খাবারের দাম বেশি, শ্রমিক রাখলে তাদের বেতনও বেশি। গরুপ্রতি দিনে খরচ হাজার-বারোশ টাকা। তাহলে মাসে খরচ কত আপনারাই বলেন! এছাড়া বিদ্যুৎ, সাবান, শ্যাম্পু, মশার কয়েলে খরচ আছে।’
রাজধানীতে কোরবানির পশু সাধারণত ঈদের এক থেকে দুইদিন আগে বেশি বিক্রি হয়। এখন যেসব গরু বিক্রি হচ্ছে অধিকাংশ ক্রেতাই ঢাকার আশপাশের এলাকার, বিশেষ করে কেরানীগঞ্জ, সাভারের। যাদের বাড়িতে খোলামেলা খালি জায়গা পড়ে আছে, তারাই মূলত গরু কিনছেন এখন। ঢাকা শহরে অধিকাংশ মানুষ ভাড়া ও ফ্ল্যাট বাসায় বসবাস করেন। কোরবানির গরু রাখার স্থানের বড় সংকট।
গরু কিনে পিকআপে বাসায় ফিরছিলেন কেরানীগঞ্জের জলিল হাজি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এক লাখ ৫৩ হাজার টাকায় গরু কিনলাম, বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে ক্রেতারা আসছেন মূলত গরুর দাম জানতে। এখনো কেনার প্রতি ততটা আগ্রহী নন কেউ। এবার দেশি জাতের মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি বলে জানান ব্যাপারীরা।
মিরপুর ৬০ ফিট ছাপরা মসজিদ এলাকা থেকে গাবতলীর হাটে আসেন আতাউল ইসলাম। সঙ্গে ছিল দুই ছেলে ও এক মেয়ে। জাগো নিউজকে আতাউল বলেন, ‘আমার বাজেট দেড় লাখ টাকা। কিন্তু গরুর দাম এবার অনেক বেশি। ব্যাপারীরা গরুর বাড়তি দাম চাইছেন। গত বছর যে গরু এক লাখ টাকায় কিনেছি এবার তার দাম ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়তি। তারপরও এই দামে ব্যাপারীরা গরু ছাড়তে চাইছেন না। তবে ঈদের একদিন আগে গরু ঠিকই ছাড়বে, দরকার হয় ঈদের আগের রাতে গরু কিনবো।’
হাটে গরুর দাম চড়া হলেও কোরবানির ঈদ উপলক্ষে দেশে গরু-ছাগলের ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রহমান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘দেশে পশুর কোনো ঘাটতি না থাকায় ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা এবার কোরবানির ঈদ ভালোভাবে করতে পারবেন। গত বছর প্রায় পাঁচ লাখ গবাদিপশু অবিক্রীত ছিল। এ বছর তার সঙ্গে আরও সাড়ে চার লাখ পশু যোগ হয়েছে। আমাদের দেশে চাহিদা এক কোটি ২৯ লাখ পশু, সেখানে আছে এক কোটি ৩০ লাখেরও বেশি।’
ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানীতে ১৬টি অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা চূড়ান্ত করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এবারের ঈদে মোট ২০টি হাট ইজারার দরপত্র আহ্বান করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এর মধ্যে গাবতলী স্থায়ী পশুর হাটসহ ৯টি হাট বসাতে চেয়েছিল ডিএনসিসি। এছাড়া ডিএসসিসি চেয়েছিল সারুলিয়া স্থায়ী পশুর হাটসহ ১১টি পশুর হাট বসাতে। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনাসহ নানান কারণে অস্থায়ী হাটের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এর মধ্যে আফতাবনগরে হাট বসানো নিয়ে দুই সিটি করপোরেশন দরপত্র আহ্বান করলেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় তা বন্ধ আছে।
এমওএস/কেএসআর/এমএস