লিবিয়ায় নিয়ে ভিডিওকলে রেখে নির্যাতন, ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১৬ পিএম, ০৪ জুন ২০২৪

চার লাখ টাকায় নরসিংদীর রোমেল মিয়াকে লিবিয়া নেওয়ার চুক্তি হয়। ৬ মার্চ দুই লাখ টাকা পরিশোধ করেন রোমেল। এরপর ১৪ মার্চ এক লাখ ২৪ হাজার টাকার সমপরিমাণ ডলার নিয়ে রহমত উল্লাহ ও বিল্লাল মিয়ার সঙ্গে রওনা দেন রোমেল। ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিশর হয়ে রোমেলকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। তাকে একটি কার্পেট কোম্পানিতে চাকরি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

কিন্তু সেখানে গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখেন রোমেল। যারা তাকে লিবিয়া নিয়ে যান তারা সবাই জিম্মি চক্রের সদস্য। তারা রোমেলকে আটকে রেখে নির্যাতন করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। টাকা না পাঠালে কখনো হাত কেটে ফেলবে, কখনো মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেন।

নিম্নবিত্ত রোমেলের পরিবার এত টাকা জোগাড় করতে না পেরে নরসিংদী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দ্বারস্থ হয়।

লিবিয়ায় নিয়ে ভিডিওকলে রেখে নির্যাতন, ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

ঘটনার তদন্তে নেমে দেশে অবস্থানরত এই সংঘবদ্ধ চক্রের হোতা সোহেলসহ (২৪) তিনজনকে গ্রেফতার করে পিবিআই। গ্রেফতার বাকি দুজন হলেন, ওয়াসিম হোসেন ও আকারিছ মিয়া।

মঙ্গলবার (৪ জুন) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পিবিআই নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।

তিনি বলেন, রোমেলকে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিশর হয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে নিয়ে তাকে আটকে রেখে স্বজনদের ভিডিও কলে রেখে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। ১০ এপ্রিল রোমেলের ভাই বাবুল ও তার স্বজনরা পিবিআই কার্যালয়ে এসে বিষয়টি জানান। টাকা না পাঠালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনাটি পুলিশকে জানালে রোমেলকে হত্যা করা হবে বলে জানায় চক্রের সদস্যরা।

লিবিয়ায় নিয়ে ভিডিওকলে রেখে নির্যাতন, ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার আরও বলেন, পরে পিবিআইয়ের তৎপরতা গোপন রেখে জিম্মিকারীদের দেওয়া চারটি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠানো হয়। চক্রটি টাকা রিসিভ করে আরও টাকা পাঠাতে তাগাদা দেয়। এ পর্যায়ে পিবিআইয়ের তিনটি টিম একযোগে ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব এবং নরসিংদীর রায়পুরা থানা এলাকায় অভিযান চালায়। এসময় ওয়াসিম হোসেন ও আকারিছ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল সেট, মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকা ও বিকাশ সিমসহ মোট ২২টি সিম কার্ড জব্দ করা হয়।

আরও পড়ুন: 

এসময় পিবিআই তথ্য পায়, জিম্মিকারীদের মূলহোতা সোহেল বাংলাদেশে রয়েছেন। তিনি যাতে পালাতে না পারেন সেজন্য সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে চিঠি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ১৯ এপ্রিল সোহেল দেশ থেকে দুবাই পালিয়ে যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। পরে সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে পিবিআই।

সোহেল রিমান্ডে অনেক তথ্য প্রদান করেন। পিবিআইয়ের তৎপরতায় সোহেলের মোবাইল দিয়ে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার পর রোমেলকে ছাড়তে রাজি হন জিম্মিরা।

অনেক নাটকীয়তার পর, সোহেলের কথামতো রোমেলকে একদিন ঘুরিয়ে রাত ৩টায় ত্রিপলিতে রহমত উল্লাহ নামে এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়। এরপর তাকে ত্রিপলি থেকে দেশে আনার জন্য পাসপোর্ট-ভিসা ও বিমান টিকিটের জটিলতা দেখা দেয়। পিবিআই লিবিয়ার অ্যাম্বাসিতে একাধিকবার কথা বলে অনেক চেষ্টার পর ২৪ মে রোমেলকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

লিবিয়ায় নিয়ে ভিডিওকলে রেখে নির্যাতন, ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

পুলিশ সুপার এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, আরও ১১ বাংলাদেশিকে জিম্মি অবস্থায় দেখেছেন বলে জানান ভুক্তভোগী রোমেল। বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। এছাড়া তদন্তে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ব্যাপক আর্থিক ট্রানজেকশন যাচাই করা হচ্ছে।

রোমেল বলেন, বিল্লাল-রহতউল্লা আমাকে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিশর হয়ে লিবিয়া নিয়ে যান। সেখানে দিনের পর দিন রেখে আমাকে নির্যাতন করা হয়। বাড়ির লোকজনকে ভিডিওতে রেখে মারধর করে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

তিনি বলেন, সেখানে কয়েকজন লোক ছিল। একজন যে প্রধান তাকে সবাই ‘বেয়াই’ বলে ডাকতো। এছাড়া দেলোয়ার, আরিফ, রুহুল, তানভীর, সাইফুল, আবুল, হৃদয় খান, তানভীর নামে আরও কয়েকজন ছিলেন। তারা বলতেন- ‘১২ লাখ টাকা দিবি নয়তো মেরে ফেলব।’ তারা বার বার টাকা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতেন, সময় দিতে রাজি না। তারা বলতো- ‘তোর মতো অনেক রুমেল হারায়ে গেছে, তোকেও মেরে ফেলবো।’

এসময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোমেল বলেন, কোনো সময় কল্পনা করি নাই বাংলাদেশের মুখ দেখবো। আমি ফিরে আসতে পারছি এজন্য পিবিআইকে ধন্যবাদ।

রোমেলের বাবা আসাদ বলেন, যখন আমার ছেলে যায় তখন রমজান মাস ছিল। আমরা গরীব মানুষ, ভিটা বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠাইছিলাম, পরে যখন আবার টাকা চায় আমরা কই থেকে টাকা দেবো? ছেলে ফিরে আসছে এজন্য আমি খুশি।

টিটি/জেডএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।