ঢাকায় পানি দূষণের বড় কারণ পোশাক কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:০৭ পিএম, ২৯ মে ২০২৪

বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প অন্যতম। কিন্তু এই খাত থেকে যে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমন হয়, তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ও এর আশপাশের নদ-নদী এবং খাবার পানি দূষনের অন্যতম উৎস হচ্ছে পোশাক কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত কেমিক্যাল ‘পিফাস’। যা মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। এমনকি লিভার নষ্ট ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, পোশাক কারখানার আশপাশের এলাকার পানির নমুনায় উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর পিফাস নামক রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার ওপরে।

বাংলাদেশে পিফাস নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যে কারণে এই গবেষণার ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানদন্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

গবেষণাটি করেছে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন এসডো এবং আইপেন।

পিফাস কি?

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ হিসেবে পরিচিত। দেশের অনেক কারখানা বিশ্বের প্রধান ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পোশাক তৈরি করে। তাদের বিভিন্ন পণ্যে পিফাসের উপস্থিত রয়েছে। যা তেল এবং দাগ-প্রতিরোধ করতে পারে। মোট বৈশ্বিক পিফাস ব্যবহারের প্রায় ৫০ শতাংশ ব্যবহার করে টেক্সটাইল শিল্প। পিফাস নির্গমনে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এ শিল্প।

গবেষণায় বলা হয়, পিফাস, পার- এবং পলিফ্লুরোঅ্যালকাইল রাসায়নিকগুলো ‘চিরস্থায়ী রাসায়নিক’ হিসেবে পরিচিত। কারণ এটি পরিবেশে জমা হয় ও স্থায়ীভাবে থাকে। যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। উর্বরতা, ভ্রূণ বিকাশ, এবং থাইরয়েড ও হরমোনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া কিছু পিফাস শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, লিভার নষ্ট করে এবং ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। এরই মধ্যে কিছু পিফাস স্টকহোম কনভেনশনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আরও কিছু নিষিদ্ধের ব্যাপারে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

গবেষণার ফলাফল

গবেষণাটি ২০১৯ সাল থেকে করা হচ্ছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের ৩১টি পানির নমুনার মধ্যে ২৭টিতে পিফাস পাওয়া গেছে। যার ১৮টি নমুনায় নিষিদ্ধ পিফাস রাসায়নিক পিএফওএ, পিএফওএস, অথবা পিএফএইচএক্সএস পাওয়া গেছে এবং ১৯টি নমুনায় প্রস্তাবিত ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রক সীমা (8.8 ng/L) অতিক্রম করেছে।

২০১৯ সালে কর্ণফুলী নদীর পানিতে সর্বোচ্চ পিফাস শনাক্ত করা হয়েছিল। যা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সীমার চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। সেই নমুনায় দুটি নিষিদ্ধ পিফাসেরও উপস্থিতি ছিল, একটির মধ্যে ডাচ সীমার চেয়ে ১,৭০০ গুণ বেশি এবং অপরটিতে ৫৪,০০০ গুণ বেশি।

আরেকটি নমুনা, ২০২২ সালে হাতিরঝিল লেক থেকে নেওয়া হয়। যাতে পিএফওএ এবং পিএফওএস উভয়ই উপস্থিত ছিল, যা ডাচ সীমার চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি।

এছাড়া উচ্চ পিফাস পাওয়া গেছে এমন নমুনা পোশাক কারখানার কাছাকাছি এলাকায়। এটা প্রমাণ করে যে, পোশাকশিল্পে পাওয়া পিফাস পানি দূষণের জন্য দায়ী।

এজন্য ২০২২ সালে দুটি জলপথে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ঢাকা এবং আদমজী ইপিজেড) কাছাকাছি আপস্ট্রিম ও ডাউনস্ট্রিমের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেখানে ডাউনস্ট্রিমের নমুনায় পিফাসের ঘনত্ব পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের চারটি কলের পানির নমুনার মধ্যে তিনটিতে পিফাস পাওয়া গেছে। যা যুক্তরাষ্ট্রের খাবার পানির জন্য নির্ধারিত পিএফওএ সীমার ওপরে (৪ ng/L)।

গবেষণাটি বাংলাদেশের পোশাকেও করা হয়েছে। পাঁচটি পোশাকের স্যাম্পলের সবকটিতেই পিফাস পাওয়া গেছে। আর একটি পুরুষের জ্যাকেটে নিষিদ্ধ রাসায়নিক পিএফওএ পাওয়া গেছে।

এসডো’র নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, বাজার বিশ্বব্যাপী হতে পারে, কিন্তু দূষণ স্থানীয় পর্যায়ে বেশি। স্টকহোম কনভেনশনের সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশকে পিফাস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক মান বাস্তবায়ন করা জরুরি।

স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে এসডো’র সিনিয়র পলিসি এবং টেকনিকেল উপদেষ্টা এবং গবেষণার প্রধান ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, নদী, লেক, কলের পানি, এবং পোশাকে পিফাস আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ও পরিবেশের জন্য গুরুতর হুমকি। তবুও শিল্পকারখানা এবং নীতিনির্ধারকরা সাড়া দিচ্ছেন না।

পোশাক শিল্পকারাখানায় পিফাসের নিরাপদ বিকল্প রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইপেন গ্লোবালের গবেষক এবং এ গবেষণার সহ-লেখক জিটকা স্ত্রাকোভা।

তিনি বলেন, মানব বিকাশের সব পর্যায় পিফাসের স্থায়ী এক্সপোজারের কারণে প্রচুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। টেক্সটাইল শিল্পকে তাদের পিফাস ব্যবহার দ্রুত বন্ধ করা উচিত এবং তাদের পণ্যে পিফাস সামগ্রী সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা উচিত।

এনএইচ/জেডএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।