‘বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ ও করণীয়’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৯ এএম, ২৪ মে ২০২৪

অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, পরিবেশবিদ এবং সুশাসন ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে ‘বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণ: করণীয় ও সীমাবদ্ধতা’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করা হয়।

বিআইডিএস কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত এই স্মারক বক্তৃতাটি দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এমএম আকাশ।

মূল প্রবন্ধে অধ্যপক এমএম আকাশ বলেন, বাংলাদেশকে বর্তমানে যদি এলএআইসি থেকে ইউএমআইসিতে হয় তাহলে দুটি বিষয় যুগপৎ খেয়াল রাখতে হবে। ক) সম্পদ বা পুঁজির সংগ্রহ, উৎপাদনশীল ব্যবহার ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা; খ) উৎপাদনের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করা। অসমতা ক্রমশ হ্রাস করা। প্রবৃদ্ধি অর্জন ও সমতা বিধান এই দুটি কাজ সম্ভব হবে না যদি উচ্চ আয়ের অধিকারীরা সঞ্চয় ও বিনিয়োগে উৎসাহী না হন।

তিনি বলেন, তারা যদি সহজে টাকা ধারা নেন, সহজে তা অপব্যয় করেন এবং সহজে শোধ না দিয়ে পরিত্রাণ পেয়ে যান, তাহলে পুঁজির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না। অন্যদিকে দেশে যদি পুঁজি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করা যায় অর্থাৎ বিনিয়োগ আবহাওয়া অনুকূল না হয়- তাহলে ব্যক্তি পুঁজির বহির্গমন অব্যাহত থাকবে। বিদেশি পুঁজিও দেশের দিকে আকৃষ্ট হবে না।

তিনি আরও বলেন, শুধু পুঁজির বাইরে যাওয়াটা আটকানো যথেষ্ট নয়। পুঁজির সঙ্গে কার্যকর দক্ষ শ্রমের সম্মিলনও দরকার। যোগ্য মানবসম্পদের যথাযথ উন্নয়ন দরকার। পরিমাণের দিক থেকে আমাদের এক্ষেত্রে সংকট নেই, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষতার ধরণ ও মানের প্রচুর সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে উপযুক্ত সংস্কার না করতে পারলে অনেক প্রতিভাবানকে যেমন আমরা দেশে ধরে রাখতে পারবো না, তেমনি অনেক শিক্ষিতই কর্মহীন বেকারে পরিণত হবে।

এছাড়া আমাদের মানবসম্পদকে মোটিভেট করে কাজে লাগানোর জন্য প্রচুর কর্মকুশলতা ভিত্তিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মেকানিজম বা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন তৈরি ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্ভিক্ষ বোধ, চরম দারিদ্র্য হ্রাস, উন্নত ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টি ইত্যাদি অর্জন হয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে এবং নারীদের অগ্রযাত্রা তরান্বিত হয়েছে। কিন্তু এতে এই মুহূর্তে আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। আমাদের এই প্রাথমিক উন্নতিই আমাদের সামনে কতকগুলি নতুন দ্বিতীয় স্তরের জরুরি সমস্যার সৃষ্টি করেছে যেগুলোর সমাধান ছাড়া আমরা UMIC বা তার পরবর্তীতে HIC হতে পারবো না।

আমাদের বড় বড় শব্দসমৃদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বর্তমানে তাই ইউটোপীয়ায় পরিণত হতে চলেছে। সেজন্য আমাদের অবিলম্বে বৈষম্য হ্রাস করতে হবে। সুশাসন কায়েম করতে হবে এবং মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ স্মৃতি সংসদের সভাপতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এর কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য একুশে পদকপ্রাপ্ত এম. এ. সাত্তার মণ্ডল-এই অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আহমদ-এর সহধর্মিণী রওশন জাহানও তার পরিবারবর্গ। অন্যান্যদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অধ্যাপক আহমদ এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কাজী মদিনা, ড. বদিউল আলম মজুমদার, মহিদুল হক খান, মমতাজুল করিম, ড, বদরুন্নেছা আহমেদ, হুমায়রা আহমেদ।

রওশন জাহান বলেন, আজ মোজাফ্ফর আমাদের মধ্যে নেই। তবে এখনো তার আদর্শ এবং লক্ষ্যে বিশ্বাসী এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথোপযোগী কর্মপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের সংগ্রামে দেশের বহু সংগঠন এবং নাগরিক সচেষ্ট আছেন সেটাই আমাকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়।

বিআইডিএস অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের কোনো একটা আয়োজনে যুক্ত থাকবে এটা পরম গৌরবের মন্তব্য করে বিনায়ক সেন তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের নতুন কিছু উৎস আছে গ্রোথের যেমন স্থানীয় শিল্পের বিকাশ ঘটেছে গত এক দশকে।

jagonews24

তিনি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের কথা উল্লেখ করে বলেন, টেকনোলজিক্যাল প্রগ্রেস ছাড়া গার্মেন্টস সেক্টর সেই পর্যায়ে প্রগ্রেস করতে পারবে না। আমাদের প্রথম প্রয়োজন ট্যারিফ র‌্যাশনালাইজেশন বলেও এ সময় তিনি মন্তব্য করেন। ইনফরমাল ও ফরমাল সার্ভিসেস নিয়ে অর্থাৎ সার্ভিস সেক্টর নিয়েও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে এ সময় তিনি বিশেষভাবে জোর দেন।

তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, চীন, রাশিয়া মিডল ইনকাম ক্রস বা রিচ করেছে আন্ডার রিলেটিভলি অথরিটিরিয়ান মডেল, দে ডিড নট রিক্যোয়ার এ ফুল ডেমোক্রেটিক মডেল। সুতরাং ডেমোক্রেসি ভার্সেস অথরিটিরিজিয়ান ডিবেটে মিডল ইনক্যাল ট্র্যাপ সৃষ্টি করবে কি না আমি সেই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই।

ড. এমএ সাত্তার মণ্ডল ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক আহমদের সাথে পরিচয়ের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, একজন মানুষের জ্ঞানের প্রতি কত পিপাসা থাকে সেটা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে দেখে আমি বুঝতে পেরেছি। প্রফেসর আহমেদ একটা প্রচণ্ড অনুরাগ ছিল তার ছাত্রদের প্রতি। তিনি তার গবেষণা ও উপস্থাপনার ভেতরে অর্থাৎ তিনি যা কিছুই করতেন, তিনি সবসময় তার ছাত্রদের সম্পৃক্ত করে রাখতেন।

এর আগে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ স্মারক বক্তৃতা যারা দিয়েছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল মকসুদ, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর প্রমুখ।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ১৯৩৬ সালের ২৭ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ২২ মে ২০১২ তারিখে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ও বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরস্ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের বোর্ড অব গভর্নরস্ এর সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউএন অর্গানাইজেশনস্, ইউনেস্কোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি হিউম্যান রিসোর্স ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলা একাডেমি, বারডেম, নজরুল একাডেমি, অর্থনীতি সমিতি ও অর্থনীতি শিক্ষক সমিতির জীবন সদস্য ছিলেন। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যেমন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ও বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এর পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে এমিরেটাস অধ্যাপক ছিলেন।

এমআরএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।